শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

চাঁদ দেখা : সমস্যা ও সমাধান-৫

মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

চাঁদ দেখা : সমস্যা ও সমাধান-৫


আমাদের করনীয়: “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা পালন করো এবং চাঁদ দেখেই ঈদুলফিতর উদযাপন করো”- *(বুখারী ও মুসলিমসহ প্রায় সব সহীহ হাদীসগ্রন্থই দ্র.) এ হাদীসখানা অনুযায়ী চাঁদ দেখা প্রশ্নে আমাদের সকলেরই দায়-দায়িত্ব আছে, তা অনস্বীকার্য। আর এ দায়িত্ব ‘ফরয়ে কিফায়া’ হিসাবে ধরে নেয়ার এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে শৃঙ্খলাবিধান ও ব্যবস্থাপনার সুযোগ করে দিয়ে আমাদের জন্য বিরাট সহযোগিতা করা -এর বাইরেও , প্রসিদ্ধ হাদীসাংশ-
“যে বা যিনি কোন ভালো ও কল্যাণকাজের পথ দেখান বা সুযোগ করে দেন বা সহযোগিতা করেন; তিনি সেই সংশ্লিষ্ট কাজ / আমল যারা করবেন তাঁদের সকলের সমপরিমাণ সওয়াব পেয়ে যাবেন” -এই ব্যাপক অর্থ বোধক ও মূলনীতিজ্ঞাপক হাদীসাংশের প্রতি একটু গভীরভাবে মনোযোগ দিলে আমরা বুঝতে পারবো যে,আলোচ্য সমস্যাকবলিত ও বিতর্কজনক পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানোর লক্ষ্যে, সুনির্দিষ্ট কমিটির বাইরে যদি আমরা কেউ সত্য সত্য চাঁদ দেখতে পাই, আর বসে না থেকে তড়িৎ গতিতে, প্রয়োজনে কিছু টাকা-পয়সা খরচ করেও, বিধি মোতাবেক সংবাদ/সাক্ষ্যটি স্থানীয় উপজেল/ জেলা বা কেন্দ্রিয় কমিটির বরাবরে যে কোন মূল্যে পৌঁছে দেই। আর তার ফলশ্রুতিতে সারা দেশের মানুষ ‘চাঁদ দেখা’ প্রশ্নে বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পায় এবং সংশয়হীনভাবে রোযা শুরু বা ঈদ উদযাপন করতে পারে। সেক্ষেত্রে সকলে রোযা রেখে বা ঈদ-ইবাদত পালন করে যে-পরিমাণ সওয়াব প্রাপ্ত হবেন সেই সকলের সমপরিমাণ সওয়াব তো এ লোকটি একাই পেয়ে যাবেন! কারণ, এটা তো হাদীসের কথা! সুতরাং সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোর বাইরে দূর-দূরান্তে, দেশের প্রান্তিক সীমায় যারা অবস্থান করেন তাঁদেরকে আমরা উক্তরূপে উৎসাহিত করতে পারে।


সার-সংক্ষেপ : উক্ত আলোচনা থেকে সার-সংক্ষেপ হিসাবে বলা যায়: ১) রোযা পালন ও ঈদ পালন যেমন সকলের দায়িত্ব, তারই প্রয়োজনে চাঁদ দেখা এবং তাতে সাহায্য করাও সব মুসলমানের দায়িত্ব; কেবল সরকারের একার দায়িত্ব নয়।
২। চাঁদ দেখা এবং তা প্রমাণে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করা অন্যতম একটি সওয়াবের কাজ।
৩। কেবল চাঁদ দেখাই যথেষ্ট নয়, দেখার সংবাদ/সাক্ষ্যটি সংশ্লিষ্ট কমিটির বরাবরে পৌঁছাতে হয়।
৪। কেবল চাঁদ দেখার সংবাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা প্রচার করা যাবে না; সাক্ষ্য হিসাবে প্রমাণিত হওয়া চাই।
৫। যিনি বা যারা চাঁদ দেখেছেন তাঁরা একান্ত কোন সমস্যায় কমিটির বরাবরে উপস্থিত হতে না পারলে, কমিটির কোন সদস্যকে সেখানে পাঠিয়ে তার সংবাদ ও সাক্ষ্য বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৬। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে মাহে রামাদানের রোযা একজন সৎ প্রত্যক্ষদর্শীর সংবাদেও প্রমাণিত হতে পারে; অবশ্য দু’জনের সাক্ষ্য হলে আরও উত্তম। তবে এতে সাক্ষ্য প্রক্রিয়া জরুরী নয়; যদিও তা হলে অধিক ভালো।
৭। আকাশ মেঘমুক্ত হলে, রোযা প্রমাণে কমপক্ষে দু’জনের সাক্ষ্য থাকা চাই; একদল বা আরও বেশী হলে, অধিক ভালো।
৮। কিন্তু ঈদের চাঁদের ক্ষেত্রে আকাশ মেঘলা হলে অবশ্যই দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্য বিধি মোতাবেক গৃহীত হওয়া চাই। আর ঈদের চাঁদের ক্ষেত্রে আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে, সেক্ষেত্রে কেবল দু’জনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট হবে না। সেক্ষেত্রে বরং ‘বেশ কয়েকজন’ বা ‘একদল মানুষ’ এর সংবাদ ও সাক্ষ্য থাকা জরুরী।
৯। উক্ত ‘বেশ কয়েকজন’ বা ‘একদল’ বলতে, নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা নেই। বিচারক বা তাঁর স্থলাভিষিক্ত ফায়সালাদানকারী ব্যক্তি বা কমিটির লোকজনের প্রবল ধারণা বা আস্থা-বিশ্বাস অর্জিত হয়ে যায় -এমন (৩/৪/৫ বা ততোধিকও হতে পারে) কয়জন হলেই হল। (আহসানুল ফাতাওয়া:মুফতী রশীদ আহমদ র. খ-৪, পৃ-৪৬৮, ৪৫৩-৪৮৮; যাযকারিয়া বুক ডিপো, ইউ.পি.ভারত; সংস্করণ-১৯৯৪খ্রি.)
১০। যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত স্পটের বাইরেও চাঁদ দেখা যাওয়া সম্ভব; তাই অন্য কেউ চাঁদ দেখলে, তার মূল্যায়ন করতে হবে।
১১। স্পটসংখ্যা বাড়াতে হবে।
১২। উপজেলা/জেলা পর্যায়ের কমিটির সঙ্গে স্থানীয়দের যোগাযোগের সুবিধার্থে সেখানকার স্থানীয় কারও টেলিফোন/মোবাইল নম্বর দিয়ে দিতে হবে।
১৩। কেন্দ্রিয় কমিটি বা স্থানীয় কমিটির প্রদত্ত ফোন নম্বরসমূহে প্রত্যক্ষদর্শীদের যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উৎসাহিত করতে হবে।
১৪। উপরে উল্লেখকৃত তথ্যসূত্রের শরীয়া আইন গ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, ‘চাঁদ দেখা কমিটির সদস্যদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ফিকহ-বিশেষজ্ঞ আলেম হওয়া চাই।’ তারপরও, অধম মনে করি, সংখ্যাগরিষ্ট না হোক, সমসংখ্যক না হোক; কিন্তু এমন কয়েকজন অবশ্যই হওয়া চাই যেন দেশের মানুষ আস্থাবান হতে পারে যে, আলোচ্য চাঁদ দেখা, না দেখার সিদ্ধান্ত আলেমগণই দিয়ে থাকেন বা তাঁদের নির্দেশনা মোতাবেকই দেয়া হয়ে থাকে। সুতরাং অনিচ্ছাকৃত কোন সমস্যা হলে সেক্ষেত্রেও, সরকারকে দোষারোপ করার কোন যুক্তি নেই।
১৫। যে ইসলামিক ফাউন্ডেন অফিসের সভাকক্ষে চাঁদ দেখা হয় সেই একই অফিসে সরকারের নিয়োগ দেয়া তিনজন বিশেষজ্ঞ আলেম রয়েছেন; যা বর্তমানে সারা দেশের মানুষই জানেন। চাঁদ দেখা, কোন সমস্যা হোক বা না হোক, জনগণ বার বার এঁদেরকেই ফোন দিয়ে থাকে; এঁরা তখন বলতে বাধ্য হন, ‘আমরা তো কমিটির সদস্য নই; তাই কিভাবে কি হয়েছে...বলতে পারছি না!’ -এতে নেতিবাচক বিভিন্ন প্রশ্ন উথ্থাপিত হয়, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং এ তিনজন আলেমকে স্থায়ী সদস্য হিসাবে অন্তর্ভূক্তি বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
১৬। চাঁদ দেখা প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট ফাতাওয়ার কিতাবাদিতে অত্যন্ত স্পষ্টভাষ্যে বলা হয়েছে, শরীয়ত নির্দেশিত পন্থা-প্রক্রিয়ার বাইরে ‘ইলমে নুজূম’ বা হিসাব বিজ্ঞানের বিশেষ কোন প্রক্রিয়া অথবা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চাঁদ প্রমাণ করার কসরত শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং তেমন চিন্তা-চেতনা অসমীচীন বলেই মনে হয়।
১৭। দেশের মানুষকে চাঁদ দেখা কমিটির কার্যক্রম, প্রক্রিয়া, তাতে যে আলেম/মুফতী সদস্যগণও আছেন এবং কেবল বায়তুল মুকাররমে বসেই নয় বরং ৬৪টি জেলার সংবাদ সংগ্রহ (যদিও তা যথেষ্ট নয়) করে, তারপর বিধি মোতাবেক ঘোষণা প্রদান করা হয়- তা প্রচারের ব্যবস্থা করা চাই।

উপসংহার:
মোটকথা, চাঁদ দেখার কেন্দ্রিয় কমিটি বা ধর্ম মন্ত্রণালয় তথা সরকার সার্বিক বিবেচনায় যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এবং আমরা সর্বস্তরের জনগণ, ইমাম ও মুয়াযযেন এবং আলেমগণ নিজ নিজ পর্যায়ে আরেকটু সজাগ ও সচেতন হয়ে, নিজেদের দায়িত্ব মনে করে চাঁদ দেখা কমিটিগুলোকে সহযোগিতা করলে অবশ্যই আলোচ্য সমস্যা ও বিড়ম্বনা হতে নিজেরাও মুক্ত হতে পারবো এবং দেশের মানুষকেও মুক্তি দেয়া সম্ভব হতে পারে। মহান আল্লাহ্ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন, আমীন!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন