আমাদের দেশে কিছু সংখ্যক আলেম বলে থাকেন ১২-ই রবিউল আউয়ালকে ঈদের দিন বলা যাবে না। তারা, কয়েকজন ঐতিহাসিক ও জীবনীকারের উদাহরণ দিয়ে বলেন, তাঁর জন্ম তারিখ ৮ বা ৯ই রবিউল আউয়াল। তারা বলেছেন, ১২-রবিউল আউয়াল তারিখ তাঁর জন্ম দিন ধরে নিলেও এ তারিখে তিনি যে দুনিয়া হতে বিদায় নিয়েছিলেন এ বিষয়ে সব ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণ একমত। তাই, এ দিনে কি করে “ঈদ” হতে পারে। আমরা বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে আমাদের জ্ঞানের আলোকে বক্তব্য তুলে ধরবো।
রাসূল (সাঃ) যে সময়ে আরবে জন্ম গ্রহণ করেন সে সময়ে মাস গণনা পদ্ধতি নিয়ে চলছিল এক গোজামিল অবস্থা। তারা নিজেদের সুবিধানুযায়ী মাস অগ্র-পশ্চাৎ করে নিত। প্রত্যেক বৎসরের মাস ও দিন সংখ্যাও একরূপ থাকত না। সৌর গণনা ও চান্দ্র গণনা পদ্ধতিতে সামঞ্জস্য প্রথম হতেই নাই। সৌর গণনা ও চান্দ্র গণনা পদ্ধতিতে একটির দিন আরম্ব হয় রাত্রি ১২ টার পর অন্যটি সূর্য ডুবার পর। সৌর মাসের নির্দিষ্ট স্থিরতা আছে; কিন্তু চান্দ্র মাসের তা নেই। কারণ, চাঁদ না দেখা পর্যন্ত কোন চান্দ্র মাসের পহেলা তারিখ নিরূপণ করা সহজ নয়। বর্তমান বৈজ্ঞানিক সভ্যতার যুগেও চাঁদ দেখা কমিটি চাঁদ দেখা নিয়ে বিভ্রাটের সৃষ্টি করে থাকেন, তার আলোকে সে সময়ের কথা চিন্তা করলে এ বিষয়টি অনুমান করা যায়।
রাসূল (সাঃ) এর জন্ম তারিখ নিয়ে যে মতভেদ তা ইংরেজী ও আরবী বর্ষ গণনা পদ্ধতির জন্যই। যারা ৯ তারিখ কে সমর্থন করেন তারা মিশরের বিখ্যাত জ্যোতিবিদ মাহ্মুদ পাশার অনুসারী। তিনি গণনা করে বলেছেন, রাসূল (সাঃ) এর জন্ম ৯ তারিখে, কারণ ৯ তারিখেই, সোমবার পড়ে, ১২ তারিখে পড়ে না। মাওলানা শিবলী নোমানী ও আকরাম খাঁ ৯ এর সমর্থক। আবার ডক্টর মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ ৮ তারিখের। এভাবে গবেষক ও আলেমদের মধ্যেও মতভেদ আছে। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। রাসূল (সাঃ) এর জন্মের পূর্বেই তাঁর আব্বা এবং তাঁর ছয় বছর বয়সে মা ইন্তেকাল করেন। যার ফলে তাঁর জন্ম তারিখ যারা স্মরণে ও লিখে রাখবেন, তাঁরাই দুনিয়া হতে বিদায় নেন। এ ধরণের একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক আলেম ওফাত তারিখের সমর্থনে যেভাবে কলম চালিয়েছেন এবং দৈনিক ও মাসিক পত্রিকাতে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে অশান্তি, যা ভাতৃত্ববোধ নষ্ট করছে পবিত্র দিনটির সম্মান নষ্ট করছে। অথচ তারা জানেন এ সব তারিখ গ্রহণ করলে রাসূল (সাঃ) এর জন্ম সন পরিবর্তন হয়ে ৫৭১ খৃঃ হয়। এতে মক্কা ও মদীনা শরীফসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে যে তারিখ ও বছর বহুল প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ৫৭০ খৃষ্টাব্দের ১২-ই রবিউল আউয়াল তারিখ তা বাদ পড়ে যায়।
রাসূল (সাঃ) হলেন, আল্লাহর সৃষ্টির মূল রহস্য। রুহানী জগতে তাঁর জন্ম যেমন এক চির রহস্যপূর্ণ বিষয়, দুনিয়াতেও যে তা হবে না এটা মনে করা ঠিক নয়। আল্লাহ ১২ ই রবিউল আউয়াল তারিখকে তাঁর হাবীবের জন্ম তারিখ ও ওফাত তারিখ নির্দ্ধারণ করে এর মাঝে তাঁর মহা-কুদরত, হেকমত; রহমত ও প্রেমের এক গোপন বিষয় অন্তর্নিহিত রেখেছেন। আল্লাহর কাছে এ তারিখ ছিল প্রথম হতে প্রতিক্ষিত। এ সুন্দর ও রহস্যপূর্ণ তারিখে তাঁকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি হতো না। তাই, ১২ শরীফের সূফী সাধক ও ইমাম হযরত শাহ্ সূফী মীর মাস্উদ হেলাল (রঃ) বলেতেন; “১২ ই রবিউল আউয়াল “সৃষ্টির অভিষেক” এর দিন। রাসূল (সাঃ) ছিলেন নবুয়তের সূচনা ও সমাপ্তি। যা তাঁর পবিত্র জন্মদিন ১২ তারিখে সূচনা হয়ে, পবিত্র ওফাত দিবস ১২ তারিখে সমাপ্ত হয়। তিনি তখনও নবী ছিলেন যখন আদম (আঃ) কাদা ও পানি মিশ্রিত ছিলেন।
বিজ্ঞান বলে, “সকল বস্তু তার মূল বা কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।” আরবীতে একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে; “প্রত্যেক বস্তুই তার মূলের দিকে ধাবমান।” রাসূল (সাঃ হতে, এ ধরণের একটা হাদীস ও আছে। রাসূল (সাঃ) হলেন, সৃষ্টির মূল আর “নূরুল্লাহ”। তাই তাঁর আলোকিত দেহে এ নিয়ম তো কার্যকরী হবেই। তাঁর জীবনের শুরু ও সমাপ্তি একটা বিশেষ আবর্তে (ঈরৎপষব) হবে এটাই বিজ্ঞান ও যুক্তি সম্মত। এ যুক্তিতে ও দর্শনে জন্ম এক তারিখে, ওফাত আর এক তারিখে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
কোরান শরীফকে বলা হয়েছে, “বিজ্ঞানময় কোরান।” আর এ কোরান ও তার প্রথম ব্যাখ্যা যাঁর মাধ্যমে আমরা পেলাম তিনি কি বৈজ্ঞানিক নন? শুধু কি সাধারণ বৈজ্ঞানিক? সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক। তাই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী অধ্যাপক আব্দুস সালাম যথার্থই বলেছেন, “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ব্যুৎপত্তি লাভের জন্য আমাদেরকে আগে আধ্যাত্মিক ভাবে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।” পবিত্র কোরানে ২৫০টি আয়াতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে আমার বলতে পারি বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকর্ম ও গবেষণা মুসলমানদের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন