শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ একটি বিশ্লেষণ

প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বশির উল্লাহ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অতএব বোঝা গেল, দুজন মুসলিমের সাক্ষ্য ঐ অঞ্চলের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ যে অঞ্চলে একই দিনে চাঁদ দেখা সম্ভব। যারা উক্ত সহিহ আছারকে উপেক্ষা করে দু’জন মুসলিমের সাক্ষীকে দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য মনে করেন, তাদের উদ্দেশে বলব, সউদি আরবের পশ্চিমেও তো অনেক দেশ রয়েছে, যে দেশগুলোতে সউদি আরবের পূর্বে চাঁদ দেখা যায়। যেমন ২০১৩ সালে উত্তর আমেরিকাতে ৮ জুলাই দিবাগত রাতে চাঁদ দেখা গেছে এবং ৯ জুলাই প্রথম রোজা পালিত হয়েছে। আর সউদি আরবে ৯ জুলাই দিবাগত রাতে চাঁদ দেখা গেছে এবং ১০ জুলাই প্রথম রোজা পালিত হয়েছে। তাহলে সউদি আরবকে কেন আপনারা মানদ- হিসেবে গণ্য করেছেন? চাঁদ তো সর্বপ্রথম উদিত হয় পশ্চিমে তথা আমেরিকা মহাদেশে। আপনাদের এই দ্বিমুখী নীতিই কি আপনাদের দাবির অসারতা প্রমাণে যথেষ্ট নয়?
২. ‘প্রিয়নবী (সা.)-এর আমল।’ শিরোনাম দিয়ে কয়েকটি হাদিস উপস্থাপনা করা হয়ে থাকে। সেগুলো হলোÑ “প্রিয়নবী (সা.) মধ্যাহ্নের পর কয়েকজন মরুবাসী বেদুঈনের কাছে শাওয়ালের চাঁদ দেখার সংবাদ পেলেন এবং তৎক্ষণাৎ সাহাবিদেরকে রোজা ভঙ্গ করতে বললেন এবং পরদিন ঈদের সালাত আদায়ের নির্দেশ দিলেন। (আবু দাউদ হাদিস নং ১১৫৭, ২৩৩৯; মিশকাত হাদিস নং ১৩৫০)
কিন্তু এই হাদিসগুলোতে সারা বিশ্বে একদিনে সিয়াম ও ঈদ পালনের পক্ষে দলিল গ্রহণের সুযোগ কোথায়। কেননা, প্রিয়নবী (সা.) যাদের কাছে সংবাদ পেয়েছেন তারা দূরবর্তী কোনো স্থান থেকে আগমন করেননি। বরং মদিনা বা মদিনার পার্শ্ববর্তী কোনো স্থান থেকে এসেছিল। মাত্র একদিনের ব্যবধানে কোনো ব্যক্তি বা কাফেলার জন্য খুব বেশি দূরত্ব থেকে আগমন করা সম্ভব ছিল। অতএব এই হাদিসটির বাস্তবতা এটাই, মদিনার লোকালয়ে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে প্রিয়নবী (সা.) ও সাহাবিরা চাঁদ দেখতে পাননি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী মরুভূমির মানুষ আকাশ পরিষ্কার থাকায় তা দেখতে পেয়েছিল। তাই তাদের সংবাদ প্রিয়নবী (সা.) আমলে নিয়েছিলেন এবং রোজা ভঙ্গ করেছিলেন। এ বিষয়টি ইবনে মাজাহর হাদিসেও স্পষ্টভাবে এসেছে। যেমন আনাস বিন মালেক (রা.) তার অনুসারী সাহাবি চাচাদের উদ্ধৃত করে বর্ণনা করেন, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় চাঁদ আমাদের কাছে অস্পষ্ট ছিল। তাই আমরা সিয়াম রেখেছিলাম। অতঃপর একটি কাফেলা আগমন করল... । (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৬৫৩) সুতরাং প্রিয়নবী (সা.)-এর এই আমল একই দিনে সিয়াম ও ঈদ পালনের পক্ষে কোনো প্রমাণ বহন করে না।
৩. রোজা ফরজ হওয়ার আয়াতটি বর্ণনার পর মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন রোজা রাখে।” (সূরা আল বাকারা : ১৮৫) তেমনিভাবে দুটি আয়াত পরে বলেছেন, “তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণরেখা থেকে ঊষার শুভ্র রেখা প্রতিভাত না হয়। অতঃপর তোমরা রাত্রি পর্যন্ত রোজা পূর্ণ কর।” (সূরা আল বাকারা : ১৮৭)
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের প্রথম আয়াতটি চন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত আর পরের আয়াতটি সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত। এখানে প্রথমটি অনুসরণ করা হবে আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী, আর পরেরটি অনুসরণ করা হবে স্থানীয় সময় মোতাবেক, এটা কি স্পষ্টতই দ্বিমুখিতা নয়?
৪. এ বিষয়ে আরো যুক্তি দাঁড় করানো হয়, প্রিয়নবী (সা.) রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে বলেছেন। অতএব একই দিনে সিয়াম আরম্ভ না করলে দেখা যাবে, যেদিন সউদি আরবে বেজোড় রাত, সে দিন বাংলাদেশে জোড় রাত। এখানে লাইলাতুল কদর কোন দেশের বেজোড় রাত অনুযায়ী হবে? উত্তরে বলব, যদি আপনার যুক্তি মেনে নেয়া হয়, তাহলে আমরা যখন সউদি আরবের অনুসরণে লাইলাতুল কদর পালন করব, তখন কিছু দেশে যেমন রাত থাকবে, তেমন কিছু দেশে দিনও থাকবে। তাহলে কি তারা সে সময় লাইলাতুল কদর (কদরের রাত) পালন না করে নাহারুল কদর (কদরের দিন) পালন করবে? বেজোড় রাত্রিতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান সম্পর্কিত হাদিসটির ব্যাখ্যা যদি এভাবেই করা হয়, তাহলে নিচের হাদিসের ব্যাখ্যা কী হবে? যেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ প্রতি রাতে তৃতীয় প্রহরে নি¤œ আকাশে অবতরণ করেন এবং ফজর পর্যন্ত বান্দাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আজ কি কোন আহ্বানকারী আছো, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেব। আছ কি কেউ সাহায্য প্রার্থনাকারী, আমি তাকে তা দিব। আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করব (বুখারি, মুসলিম) বিশ্বপরিম-লের ভৌগোলিক অবস্থান লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ২৪ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্তেই কোনো না কোনো দেশে শেষ রাত্রি উপস্থিত হচ্ছে। তার অর্থ কি এই, আল্লাহ সর্বদাই দুনিয়ার আসমানে অবস্থান করছেন? বর্তমানে লাইলাতুল কদরের ব্যাখ্যা যেভাবে করা হয়, অত্র হাদিসের অনুরূপ ব্যাখ্যা দাঁড় করালে আল্লাহতায়ালার জন্য সর্বদা দুনিয়াবি আসমানে অবস্থান করাই কি অপরিহার্য হয়ে যায় না? (নাউজুবিল্লাহ)
মূলত আল্লাহতায়ালা দিন-রাত্রির দুনিয়াবী হিসেবের ঊর্ধ্বে। তাই হাদিসটির বাস্তবতা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহই জানেন। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা চরম মূর্খতা। আমরা কেবল শরিয়াতের নির্দেশ পালন করতে চেষ্টা করব।
৫. তারা আরও একটি যুক্তি পেশ করে থাকেন, সউদি আরবের সাথে বাংলাদেশের মাত্র ৩ ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য থাকার কারণে পূর্ণ এক দিন পার্থক্য হবে কেন? উত্তরে বলব, ৩ সেকেন্ডের আগ-পিছের কারণেও একটি দিনের ব্যবধান হতে পারে। যেমন একই সময়ে দুটি শিশু জন্মগ্রহণ করল। একটি বাংলাদেশে এবং অপরটি সউদি আরবে। বাংলাদেশে সময় তখন সন্ধ্যা ৭টা আর সউদি আরবে বিকাল ৪টা। এখন প্রমাণ হলো, একই সময়ে জন্মগ্রহণ করা শিশু দুটির আকীকা কি একই দিনে হবে, না দুই দিনে হবে? এর উত্তর হলো, অবশ্যই দুই দিনে। কারণ সউদি আরবে বিকাল ৪টায় জন্মগ্রহণ করা শিশুর ৭ম দিন আর বাংলাদেশে সন্ধ্যা ৭টায় জন্মগ্রহণ করা শিশুর সপ্তম দিন একই দিনে হবে না। বরং সউদি শিশুর সপ্তম দিন হবে বাংলাদেশি শিশুর ৬ষ্ঠ দিন। এক্ষণে একই সময়ে জন্মগ্রহণ করা দুই শিশুর আকীকা যদি দুই দিনে হতে পারে তাহলে ৩ ঘণ্টা সময়ের পার্থক্যের কারণে ১ দিন কি পার্থক্য হতে পারে না? এই সমাধান বের করার জন্য কেবল সুস্থ বিবেকই যথেষ্ট।
৬. বর্তমানে বেশ কিছু দেশ সিয়াম পালন করে সউদি আরবে উদিত চাঁদের অনুসরণে। আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও অনেক আগ থেকে কিছু কিছু গ্রামে সউদি আরবকে অনুসরণ করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, শরিয়তে এমন কোনো ইঙ্গিত কি রয়েছে, সউদি আরবের চাঁদই সারা বিশ্বের জন্য মানদ- হবে? তাহলে কিসের ভিত্তিতে সউদি আরবকে মানদ- হিসেবে গ্রহণ করা হলো? “চাঁদ দেখে সিয়াম রাখ, চাঁদ দেখে সিয়াম ছাড়” হাদিসটির দূরবর্তী ব্যাখ্যা দাঁড় করালেও তো সউদি আরব নয়, বরং সর্বপশ্চিমের ভূখ- আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশকে অনুসরণ করতে হয়। সর্বোপরি, ইসলাম একটি সহজ-সরল প্রাকৃতিক ধর্ম। সর্বযুগে সর্বাবস্থায় এর বিধান সমানভাবে কার্যকর। বর্তমানে স্যাটেলাইটের যুগ আসার কারণে একই দিনে একই সময়ে সিয়াম ও ঈদ পালনের কথাটি জোরেশোরে উঠেছে কিন্তু একশত বছর পূর্বেও যখন স্যাটেলাইটর ছিল না, তখনকার অনারব মুসলিম সমাজ কি তাহলে লাইলাতুল কদরের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত হয়েছিল? তারা কি বিগত তেরশ বছর ধরে সিয়াম নিষিদ্ধের দিন তথা ঈদের দিনে সিয়াম রাখতে বাধ্য হয়েছিল কেবলমাত্র প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবে? স্বাভাবিক যুক্তিবোধ কি এটা কোনোক্রমে সায় দেয়? এমনকি আধুনিক স্যাটেলাইটের যুগেও কি সর্বত্র সঠিক সময়ে সংবাদ পাওয়া সম্ভব? এর সাথে জড়িত সমস্যাগুলো চিন্তা করলে আদৌ সম্ভব নয়। যেমন- এক. আমেরিকায় (জিএমটি-৬) চাঁদ উঠেছে কিনা তা জানতে কোরিয়ার (জিএমটি+৯) মুসলমানদের অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ১৫ ঘণ্টা। অর্থাৎ আমেরিকায় সন্ধ্যা ৬টায় উদিত হওয়া চাঁদের সংবাদ কোরিয়ার মুসলমানরা পাবে স্থানীয় সময় পরদিন দুপুর ১১টায়। এমতাবস্থায় তারা একই দিনে সিয়াম ও ঈদ উদযাপনের মূলনীতি অনুসারে উক্ত সিয়ামটি আদায় করবে কীভাবে, আর কীভাবে বা সেদিনের তারাবিহ পড়বে? আরও পূর্বের দেশ নিউজিল্যান্ডের সাথে আমেরিকার সর্ব পশ্চিমে তথা আলাস্কার সময়ের পার্থক্য প্রায় ২৪ ঘণ্টা। তাহলে আমেরিকার চাঁদ ওঠার খবর নিউজিল্যান্ডবাসী পাবে পরদিন রাতে। তাহলে তাদের উপায় কী হবে? এমনকি বাংলাদেশেও আমেরিকার চাঁদ ওঠার সংবাদ জানতে অপেক্ষা করতে হবে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত। সেই একই ঘটনা। তারা সেদিনের সিয়ামও পাবে না, তারাবিহও পাবে না।
দুই. ধরা যাক বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সেহরির ৫ মিনিট পূর্বে খবর এলো, আমেরিকায় চাঁদ উঠেছে। এমতাবস্থায় চট্টগ্রামবাসী কোনোক্রমে হয়তো সেহরি সম্পন্ন করল, কিন্তু রাজশাহীবাসী যাদের ব্যবধান চট্টগ্রাম থেকে ১৩ মিনিট তারা কী করবে? একই দেশে অবস্থান করেও তারা সিয়াম রাখতে পারবে না। তাহলে একই দেশে কিছু লোক সিয়াম রাখবে, কিছু লোক রাখবে নাÑ ভাবুন তো একবার অবস্থাটা কী হবে। তিন. কেবল চাঁদ দেখাই তো শেষ কথা নয়, প্রকৃতই চাঁদ দেখা গেছে কিনা তা সাব্যস্ত হতে হবে একটি দায়িত্বশীল কমিটির মাধ্যমে। এটাও যথেষ্ট জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। যেমন বাংলাদেশে কয়েক বছর পূর্বে হাতিয়ার একটি চরে কেউ একজন চাঁদ দেখতে পেলে সারা দেশে প্রচার হলো, অথচ চাঁদ দেখা কমিটি তা গ্রহণযোগ্য মনে না করায় চাঁদ দেখা যায়নি বলে রেডিও-টিভিতে ঘোষণা করা হয়েছিল। এ নিয়ে যথেষ্ট সমস্যা তৈরি হয়েছিল সে বছর। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে যদি চাঁদ দেখা নিয়ে সমন্বয়ের এমন অভাব হয়, তবে সারা বিশ্ব পরিসরে কত জটিল হতে পারে চিন্তা করা যায়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ইসলামী শরিয়ায় কি এরূপ জটিলতার কোনো অবকাশ আছে? ইসলাম কি এমন বাস্তবতাবিবর্জিত ধর্ম? কখনই নয়; বরং এই অযৌক্তিক বিতর্ক একশ্রেণীর কল্পনাবিলাসী মস্তিষ্কের অপরিপক্ব চিন্তাধারা বৈ কিছুই নয়। এটুকু বোঝার জন্য বড়মাপের বিশেষজ্ঞ হওয়ারও প্রয়োজন নেই। তাই অর্থহীন যুক্তি পরিত্যাগ করে কোরআন ও সুন্নাহর সহজ-সরল জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করাই কাম্য। সূর্য, চন্দ্র উভয়কেই সৃষ্টি করা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে, যার অন্যতম হলো সময় ও দিনের হিসাব গণনা। প্রত্যেক এলাকার মানুষ স্ব স্ব স্থানীয় সময় মোতাবেক চন্দ্র মাস গণনা শুরু করবে।
এটাই অনাদিকাল থেকে সুপরিচিত, যেমনভাবে সৌরদিন সূর্যের স্থানীয় অবস্থান মোতাবেক নির্ধারিত হয়। এর বাইরে মানুষকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছুই চাপিয়ে দেয়া হয়নি। আল্লাহ বলেন, তিনিই সূর্যকে করেছেন দীপ্তময় এবং চন্দ্রকে আলোকময় ও তার জন্য নির্ধারণ করেছেন বিভিন্ন মনজিল। যাতে তোমরা জানতে পার বছরের গণনা এবং (সময়ের) হিসাব। আল্লাহ এগুলো অবশ্যই যথার্থভাবে সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। (সূরা ইউনুস : ৫) সুতরাং এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। পরিশেষে, সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ একটি বিশ্লেষণ সম্পর্কে আরেকটু আলোচনা করে বক্ষ্যমান নিবন্ধের ইতি টানতে যাচ্ছি। পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ের বাহাস ও মনীষীদের উদ্ধৃতি পেষ করা হলো।
সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ সম্পর্কে শাইখ উছায়মীন (রহ.)-এর বক্তব্য হলো, ভৌগোলিক হিসেবে এটা অসম্ভব। কেননা ভূগোলবিদদের কাছে চাঁদের উদয়স্থল বিভিন্ন হয়। যেমনটি ইবনে তায়মিয়া উল্লেখ করেছেন। যুক্তির নিরিখে এই ভিন্নতা থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, প্রতিটি শহরের জন্য হুকুম ভিন্ন ভিন্ন। আর এ ব্যাপারে শারঈ দলিল হলো, আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন সিয়াম রাখে।” (সুরা আল বাকারা : ১৮৫) এখন প্রশ্ন হলো, যদি দেখা যায় পৃথিবীর প্রান্ত সীমানার দেশগুলো এ মাস পায়নি অথচ মক্কাবাসী পেয়ে গেছে, এমতাবস্থায় আয়াতের হুকুমটি কীভাবে অন্যদের ওপর আরোপ করা যেতে পারে, যারা এ মাসটি পায়নি?
আর যুক্তিভিত্তিক দলিল হলো, আমরা জানি ভূপৃষ্ঠের পশ্চিম প্রান্তের আগে পূর্ব প্রান্তে প্রভাতরেখা উদিত হয়। প্রাচ্যের আকাশে প্রভাতরেখা উদিত হলেই কি আমরা পশ্চিম প্রান্তের মানুষ সেহরি ছেড়ে দেব, অথচ পশ্চিমে এখন রাত অবশিষ্ট রয়েছে? এর উত্তর হলো না। তেমনিভাবে প্রাচ্যের আকাশে যখন সূর্য অস্তগামী হয়, তখন কি আমরা ইফতার করা শুরু করব, অথচ আমরা তখনও দিবাভাগে রয়েছি? এর উত্তরও হলো না। সুতরাং হুকুমের ক্ষেত্রে চাঁদ ও সূর্য সম্পূর্ণ একই। চন্দ্রের হিসাব হয় মাসিক, আর সূর্যের হিসাব হয় দৈনিক। অতএব যুক্তি ও দলিলের নিরিখে সিয়াম ও ইফতারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্থানের জন্য আলাদা বিধান হবে। যার সম্পর্ক হবে বাহ্যিক আলামত বা চিহ্ন দ্বারা, যা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এবং হাদিসে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে, চাঁদ প্রত্যক্ষ করা এবং সূর্য বা ফজর প্রত্যক্ষ করা। মানুষ যে এলাকায় থাকবে সে এলাকায় চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে সিয়াম রাখবে বা ভঙ্গ করবে। (ফাতওয়া আরকানুল ইসলাম পৃষ্ঠা ৪৫১)
রাবেতা আলমে ইসলামীর ‘ইসলামী ফিকহ একাডেমি’ ১৯৮১ সালে তাদের প্রকাশিত এক ফতোয়ায় উল্লেখ করেছে, “হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, তোমরা চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সিয়াম রেখ না এবং চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সিয়াম ভঙ্গ কর না। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে গণনা করে (ত্রিশ দিন) পূর্ণ কর।” (মুত্তাফাকু আলাইহি, মিশকাত) এই হাদিসটির সাথে একটি কারণ সংযুক্ত করা হয়েছে অর্থাৎ চন্দ্র দেখা। সুতরাং হতে পারে যে মক্কা-মদিনায় চাঁদ দেখা গেলেও অন্য দেশে তা দেখা যায়নি। সে ক্ষেত্রে অন্য দেশের অধিবাসীদেরকে দিনের আলো অবশিষ্ট থাকা অবস্থায় তৎক্ষণাৎ কীভাবে সিয়াম পালন বা সিয়াম ভঙ্গের নির্দেশ দেয়া যেতে পারে? প্রত্যেক মাযহাবের আলেমরাই বলেছেন, উদয়স্থলের বিভিন্নতা অনেক আলেমের কাছে গ্রহণযোগ্য। ১৪৬১ সালে সৌদি আরবে সারা বিশ্বের মাজহাবের ওলামায়ে কেরাম বসেছিলেন। ওই বৈঠকে একই দিনে সারা বিশ্বে রোজা করা বা ঈদ করা সম্ভব না বলে ফতোয়া দিয়েছেন। গত ১১ অক্টোবর ২০১৪ ময়মনসিংহে এ বিষয়ে একটি বাহাস (বিতর্ক) অনুষ্ঠান হয়। এখানেও চাঁদ দেখে রোজা ও ঈদ রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়Ñ এই একই দিনে সারা বিশ্বে রোজা করা বা ঈদ করা সম্ভব নয় বলে ঘোষণা করা হয়। (ইনকিলাব, ১২ অক্টোবর ২০১৪) ইবনে আবদুল বারী এ ব্যাপারে ইজমায় উল্লেখ করেছেন, দূরবর্তী শহরসমূহ থেকে একই সময়ে চাঁদ দেখা যায় না। যেমন খোরাসান ও স্পেনের মধ্যকার দূরত্ব। তাই প্রতিটি দেশ বা শহরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হুকুম। তা ছাড়াও চার মাযহাবের অনেক কিতাবে শারঈ দলিলের ভিত্তিতে উদস্থলের ভিন্নতাকে গ্রহণযেগ্য বলা হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা স্পষ্ট হলাম, উদয়স্থলের বিভিন্নতার ব্যাপারে কোনো আলেমের মধ্যেই মতানৈক্য নেই। কেননা এটা একটা দৃশ্যমান ব্যাপার। সালাতের নির্ধারিত সময়সহ শরিয়তের অনেক হুকুমের আলোকেই নির্ধারিত হয়েছে। তাই সার্বিক পর্যবেক্ষণে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, উদয়স্থলের বিভিন্নতা একটি বাস্তব বিষয়। সুতরাং এর আলোকে ‘ইসলামী ফিকহ কমিটি’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে সিয়াম ও ঈদ পালনের আহ্বান জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, এই ঐক্যের ওপর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য নির্ভর করে না, যেমনটি কোনো কোনো প্রস্তাবক দাবি করে থাকেন। বরং মুসলিম দেশসমূহের দারুল ইফতা ও বিচার বিভাগের ওপরই চাঁদ দেখার বিষয়টি ছেড়ে দেয়া উত্তম। এতেই মুসলিম উম্মাহর জন্য অধিকতর কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য আসতে পারে কেবলমাত্র জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাহর ওপর আমল করার ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়ার মাধ্যমে।
মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সঠিক বিষয়টি অনুধাবন করার তাওফিক এনায়েত করুন। আমিন। ছুম্মা আমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
নুর আলম ২১ মে, ২০২০, ১০:৪৩ এএম says : 0
এখানে ইমামদের ফতওয়া নিয়ে তো কোনো কথা বলা হলো না
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন