রাসূলূল্লাহ সালল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার অন্ত নেই। এ ক্ষেত্রে শুধু মুসলিম মনীষীগণই নন, অমুসলিম পন্ডিতরাও তার উচ্চসিত প্রশংসায় কলম ধরেছেন। মাইকেল এইচ হার্টে রচিত “দি হান্ড্রেডস্্”, ড. স্প্রেঙ্গার রচিত “মুহাম্মাদ”, ওয়াশিয়টন আয়ারভিং রচিত “দি লাইভ অব মুহাম্মাদ”, স্যার উইলিয়াম মূর রচির “দি লাইভ অব মুহাম্মাদ”, মারগোলিউথ রচিত “মুহাম্মাদ”, মন্টোগোমারী রচিত “মুহাম্মাদ অ্যাট মক্কা এ্যান্ড মদিনা”, কৃষ্ণকুমার রচিত “মুহাম্মাদ চরিত”, গিরিশচন্দ্র সেন রচিত “হযরত মুহাম্মাদের জীবন চরিত”, রামপ্রাণ গুপ্ত রচিত “হযরত মুহাম্মাদ ও হযরত আবু বকর” প্রভৃতি বইগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
রাসূলুল্লাহ সা. এর সামগ্রিক জীবন কিংবা তাঁর বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য জীবনের আদর্শ ও চেতনাগত কোন দিক নিয়ে যে চিন্তা ও গবেষণা করা হয় তা-ই সীরাত। এ জন্য হাদীস, মাগাযি, শামায়েল, রাসূল প্রশান্তিমূলক কাব্য সীরাতের অন্তভর্‚ক্ত।
তারিখে ইসলামে মুয়াররিখে আওয়াল হলেন ওরওয়া বিন যুবায়ের। এ তাবেয়ী সীরাত বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ প্রণেতা। তবে তাঁর গ্রন্থের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আরেক তাবেয়ীর নাম ওহাব বিন মুনাব্বিহ। সীরাত বিষয়ক তার রচনাটি জার্মানীর হাইডেলবার্গ শহরে সংরক্ষিত রয়েছে। উভয়টি ১০০ হিজরীর আগের কথা।
১০০ হিজরীর পর যারা সীরাত নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্যরা হলেন, ইবনে শিহাব যুহরী, মূসা বিন উকবা, ওয়াকেদী, মুহাম্মাদ বিন সাদ প্রমূখ। মূসা বিন উকবা রচিত “মাগাযি” গ্রন্থটি জার্মানীর বার্নিল শহরে সংরক্ষিত রয়েছে।
ইবনে শিহাব যুহরীর ছাত্র ইবনে ইসহাককৃত “সীরাতে ইবনে ইসহাক” গ্রন্থটি অদ্যবদি বিদ্যমান। এ প্রচীন বইটি বাংলায় অনুদিত হয়েছে। পরবর্তীতে ইবনে ইসহাকের ছাত্র ইবনে হিশাম বইটির কলেবর বর্ধিত ও পরিমার্জন করত: নতুন আঙ্গিকে প্রনয়ণ করেন, যা “সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে প্রসিদ্ধ। সীরাতের উপর এটিই সবচেয়ে পুরাতন কিতাব বলে মনে করা হয়। এটিও বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
বাংলা ভাষায় সীরাত চর্চা ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল। হযরত ওমর রা. এর যুগে আরব মুসলিম বণিকগণ এ দেশে আসেন। ১২০০ খৃষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক রাজা লক্ষন সেনকে পরাজিত করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকারের পর মুসলমানদের পৃষ্টপোষকাতায় বাংলা ভাষা স্ফিত হয়ে উঠে।
বাংলা ভাষাকে তিন যুগে ভাগ করা হয়। প্রচীন যুগ: ১০-১৩ শতাব্দী, মধ্যযুগ: ১৩-১৮ শতাব্দী, আধুনিক যুগ: ১৮- বর্তমান কাল।
প্রাচীন যুগে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরাতন বই রামাই পন্ডিতের “শূণ্য পুরাণ”। তিনি “নিরঞ্জন উস্মা” কবিতায় সর্বপ্রথম “মুহাম্মাদ” শব্দ উল্লেখ করেন।
মধ্যযুগে মুসলিম কবিগণ রাসূল প্রশান্তি মূলক কাব্য ও পূঁথি সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি করেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মাদ সগীরের “ইউসুফ জুলেখা” কাব্যে নবী বন্দনার অস্তিত্ব গৌরব দীপ্ত হয়ে উঠে। এরপর কবি সাইয়েদ সুলতান “নবী বংশ” নামে একখানা মহাকাব্য রচনা করেন। তখন ছিল কাব্য সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। কাব্যকেই সাহিত্যের মূল ধারা হিসেবে বিবেচিত করা হতো। তখনও গদ্য সাহিত্যের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠা পায়নি।
আধুনিক যুগে বাংলা গদ্য সাহিত্য সমৃদ্ধশীল হয়। তখন রচিত হয় সীরাত বিষয়ক অসংখ্য গ্রন্থ। তন্মধ্যে কয়েকটি হলো, শেখ আব্দুর রহিম রচিত “হযরত মুহাম্মাদ”, রিয়াজুদ্দিন রচিত “হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সা.”, তসলিমুদ্দিন রচিত “স¤্রাট পয়গাম”, মুন্সি বুরহানুল্লাহ ওরফে চেরাগ আলী রচিত “হায়াতুন্নবী”, শেখ ফজলুল করিম রচিত “নবীজীর যুদ্ধাবলী”, ড. মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ রচিত “শেষ নবীর সন্ধানে”, কবি গোলাম মোস্তফা রচিত “বিশ^নবী”, মাও: আকরাম খাঁ রচিত “মুস্তফা চরিত” ইত্যাদি। ১৯৬৮ সালে বড় কাটরা মাদরাসার সাবেক শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা তফাজ্জল হোসাইন রচিত ও ড. মুজতবা হোসাইন সম্পাদিত “মুহাম্মাদ সা. : সমকালিন পরিবেশ ও জীবন” বইটি সীরাতের উপর এক অনবদ্য গ্রন্থ। বইটি জাতীয় সীরাত কমিটি কর্তৃক পুরুস্কৃত হয়।
বর্তমানে (বিভিন্ন ভাষা থেকে) অনুবাদ কর্ম সীরাত চর্চাকে আরো অনেক উর্ধে তুলে ধরেছে। বাংলায় প্রথম অনুদিত সীরাত গ্রন্থের নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা কঠিন। তবে সীরাত অনুবাদ কর্মের জগতে মাওলানা মহিউদ্দিন খান রহ. ছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক চরিত্র। এক জরিপে জানা যায়, উর্দূ ভাষায় রচিত “সীরাতে মুস্তফা” গ্রন্থটি বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি কিতাব। ৩ খন্ডে সমাপ্ত এ সুবিশাল বইটি সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন খতীব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ.। বর্তমানে তার অনুদিত বইটি বাজারে পাওয়া না গেলেও “মদীনা পাবলিকেন্স” থেকে প্রকাশিত সীরাতে মুস্তফা বাজারে বিদ্যমান রয়েছে।
নাসির হেলাল রচিত “বাংলা ভাষায় সীরাত বিষয়ক প্রন্থপুঞ্জি” নামে একটি ১২০ পৃষ্ঠার বই রচনা করেছেন। এতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রচিত ১০২৮টি সীরাত বিষয়ক বইয়ের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন