রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

হোসেন মাহমুদ : এক আলোকিত মানুষ

আবদুর রহমান মল্লিক | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

হোসেন মাহমুদ তার চোখের আলোয় জগৎটাকে খুব ভালো দেখতে পেতেন। দেশের পরিমন্ডল ছাড়িয়ে বাইরের বিশ্বকেও দেখতেন গভীরভাবে। তার সে চোখের আলো নিভে গেল। তিনি পরপারে চলে গেলেন। তার সেই দরদমাখা কণ্ঠ আর শুনতে পাবো না। তার ফেসবুকের চ্যাটিংয়ে সেই বুদ্ধিদীপ্ত আর প্রেরণাদায়ক কথাগুলো আর দেখতে পাবো না। ইনকিলাবের ডেস্কে সাতটি বছর কাজ করেছি। মাঝে মাঝে হোসেন মাহমুদ ভাইয়ের ফোনও রিসিভ করেছি। উনি আন্তর্জাতিক নিউজ করতেন সরাসরি বিদেশি সংবাদমাধ্যম থেকে অনুবাদ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে পোস্ট লিখতেন। নিউজটা মেইল করেই ফোনে জানিয়ে দিতেন। ফোনে তার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগতো । এতো সিনিয়র মানুষ আমাদের মতো জুনিয়রদের সাথে কথা বলতেন বিনীত স্বরে। একদিন ফোনে বললাম, ভাই এতোদিন কাজ করছি, আপনার সাথে কথা বলছি, সবাই আপনার নাম করে, একটা দিন দেখতে পেলাম না। আপনাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। অ্যাট লিস্ট অফিসে এসে আমাদের একটু দেখে যান, চা খেয়ে যান।

- মল্লিক ভাই, আমার যে যাবার জো নেই।
- কেন ভাই কী সমস্যা?
- আপনি আমার বাসায় চলে আসুন। সব কথা বলবো।
হোসেন মাহমুদ ভাই বাসার ঠিকানা দিলেন। একদিন সময় করে তার বাসাবোর বাসায় গেলাম। সাথে ‘সারেঙ’ এর কিছু কপি, লেক্সাস বিস্কুট, কিছু আপেল নিয়ে গেলাম। বাসার নিচ তলায় সিকিউরিটি উনাকে ইন্টারকমে আমার আসার খবর জানালেন। লিফটে উঠে গেলাম বাসায়। কাউকে দিয়ে দরজাটা খোলাই রেখে দিয়েছিলেন। সালাম জানিয়ে উনার রুমে প্রবেশ করলাম। করমর্দন করলাম। কিন্তু একি অবস্থা! নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছিলাম না, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। তার হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর চেহারা দেখে আমি কিছুটা আনন্দিত হলেও একটু অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলাম রুমের অবস্থা দেখে। বড় একটা খাটে শুয়ে আছেন। তার খাটের পাশে গিয়ে বসলাম। কুশলাদির পর তার অসুস্থতার কথা বললেন। তিনি জানালেন, ২০০৯ সাল থেকে এভাবে বিছানায় শুয়ে আছেন। প্যানক্রিয়াস ইনফিকসন ও ক্রনিক অ্যাজমায় আক্রান্ত। একা একা পাশ ফিরেও শুতে পারেন না। একজন সুদর্শন প্রাণবন্ত মানুষের এই অবস্থা মেনে নিতে পারছিলাম না।

ইনকিলাবসহ বহু পত্রিকায় তিনি কলাম লিখেছেন। পাঠকরা কি করে জানতেন এই খ্যাতিমান কলামিস্ট কেমন করে কলামগুলো লিখেছেন? ভেতরটা খুব মোচড় দিয়ে উঠলো। সুস্থ থাকার পরও সামান্য সমস্যায় আমরা খেই হারিয়ে ফেলি। আর হোসেন মাহমুদ ভাই কতটা মনের জোর নিয়ে এসব করে যাচ্ছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধাটা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল। খাটের চারপাশে অসংখ্য বই, পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন। যখন যেটা প্রয়োজন হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেন। রুমটা যেন বইয়ের স্তূপ। আলমিরা ভর্তি, র‌্যাকের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে অসংখ্য বই। ল্যাপটপটা বুকের ওপর নিয়ে লাখ লাখ শব্দ তিনি কম্পোজ করেন, ভেবে অবাক হলাম। ফোন সেটটা বালিশের পাশেই রাখা। ওটা দিয়েই তিনি সংযুক্ত হন মানুষের সাথে। গাদা গাদা বইয়ের মাঝে বিছানাটা পরিষ্কার রাখা অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার কিন্তু ওগুলো নিয়েই তিনি বেঁচে আছেন।

আমার সারেঙ এর কপিগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলেন, সাধুবাদ জানালেন অনেক। পরামর্শ দিতেও কার্পণ্য করলেন না। এর মাঝে ভাবী চা দিয়ে গেলেন। সেদিন আমার সাথে ছিলেন ছড়াকার মানসুর মুজাম্মিল। হোসেন মাহমুদ ভাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ছিলেন। সেখান থেকে প্রকাশিত সবুজপাতার সম্পাদক ছিলেন। তার একটা ইতিবৃত্ত তিনি তুলে ধরলেন। অনেক কথা হলো। সাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন সিরাজী তার নানা। তার মা ও একজন মহিয়সী নারী। সেসব বৃত্তান্ত শুনলাম। কীভাবে ঘণ্টা তিনেক সময় কেটে গেল টের পেলাম না।

সাহিত্যচর্চা আর সৃষ্টিশীল কাজের সাথে জড়িত থাকায় তার মনের জোর ছিল অসম্ভব। কখন সূর্য ওঠে কখন সন্ধ্যা নামে তা বোঝার একমাত্র উপায় তার ডান পাশের জানালা। কখন সকালের সোনালি রোদ তার ঘরটাকে একটু আলোকিত করবে তার অপেক্ষা করতেন। একটা লাঠি দিয়ে শুয়ে শুয়েই জানালারা গ্লাসটা সরিয়ে দিতেন সে আলোর জন্য। চুড়ুই শালিক তার জানালায় এসে লুটোপুটি করে সে দৃশ্য তার দেখতে ভালা লাগতো। আশে পাশের সবকিছু চলে আসতো তার গল্প কবিতায়। তার নিজস্ব ভুবনে তিনি মুক্তভাবেই বিচরণ করতেন। চলার শক্তি না থাকুক, তিনি মনের পঙ্খীরাজে পৃথিবী পরিভ্রমণ করতেন। হতাশা যে একেবারে ছিল না তা নয়। সন্তান স্ত্রীর ভবিষ্যৎ ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। কোনো কূল কিনারা না পেয়ে সবকিছু সৃষ্টিকর্তার হাতেই সপে দিয়েছিলেন। এতো কিছুর পরেও চেহারায় মলিন ভাবটা দেখা যেত না। তার সাথে তিনবারের সাক্ষাতে আমার কাছে তাই মনে হয়েছিল।

হোসেন মাহমুদ ভাই আমাকে জানিয়েছিলেন তার প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা ১৫টি বইয়ের কথা- সেগুলো হলো: ১. বিশ্বের যুগান্তকারী ঘটনা অজানা রহস্য, ২. এয়ার হোস্টেস (অনুবাদ গল্প), ৩. কবিতা সংগ্রহ-সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ৪. অন্য দেশ অন্য ভাষার কবিতা, ৫. ভাষা আন্দোলন, নজরুল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ(প্রবন্ধগ্রন্থ), ৬. পদ্মাচরের পরী (ছোটদের ছোটগল্প), ৭. প্রজাপতির পাখা (বিদেশী গল্প), ৮. নাইট ও রুবির গোলাপ, ৯. জীবনের গান (শিশু-কিশোর গল্পের অনুবাদ), ১০.যুদ্ধদিনের জীবন (গল্পের অনুবাদ), ১১. রুবাইয়াত (১৪৪টি রুবাই), ১২. মরুভূমির ঝড় (অনুবাদ উপন্যাস), ১৩. স্বপ্ন-আশার আলোছায়া (কিশোর উপন্যাস), ১৪. সব পাখি ঘরে ফেরে (উপন্যাস) এবং ১৫. আমার ছড়া আমার কবিতা ।

তাকে রাখা লেখার পান্ডুলিপি আমাকে দেখিয়েছিলেন। তার লেখাগুলো প্রকাশিত হবে কিনা জানি না। তবে সেটা জানি, তার লেখাগুলো প্রকাশিত হলে তার আত্মা শান্তি পাবে। কারণ এগুলো তার স্বপ্ন, তার ভালোবাসা। কতটা নিবেদিত হলে এসব গ্রন্থ রচনা করা যায় তা লেখক মাত্রই জানেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৪।

এই হৃদয়বান মানুষটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্তেকালের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুসংবাদটা ছড়িয়ে পড়ে। সহকর্মীসহ সকল সাংবাদিক তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেছেন।

সর্বশেষ হোসেন মাহমুদ ভাইকে বলেছিলাম, ‘বড় ভাই খবর নিতে পারি না। নিজেকে খুব অপরাধী লাগে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘এই তো নিলেন! এটাও তো এখন কেউ নেয় না। মাঝে মাঝে খারাপ লাগে ঠিকই, কিন্তু নিজেকে দিয়ে ভাবি, যে আমি কজনের খবর নিতাম ভালো থাকতে। জীবনটা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। খুবই অর্থহীন মনে হয়। একেবারেই ভাগ্যের হাতের ক্রীড়নক হয়ে থাকতে ভালো লাগে না। কিন্তু কী আর করা! যাক কখনো সময় হলো আসবেন। আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন।’
বিছানায় অসুস্থ পড়ে থাকা মানুষটি আমার জন্য দোয়া করে গেছেন। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করুন। যে সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সদস্য হয়ে আমরা গৌরব বোধ করি। তিনি ছিলেন এটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি আমাদের অগ্রজ। ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ জানাবো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদন করে তার পরিবারের সদস্যদের জন্য একটা স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে। হোসেন মাহমুদ ভাই ওপারে ভালো থাকুন। তার যেন বেহেশত নসিব হয়।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন