শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

মারাকোপা গুহা

চে ম ন আ রা | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৩ এএম

লিফি ফল দেখে বাসায় ফিরে এলাম। তাসমানিয়ার আরো কিছু প্রসিদ্ধ জিনিস আমার এখনো দেখা হয়নি। তার মধ্যে তাসমানিয়ার গুহাগুলো প্রধান। ২৬/১০/০৩ তারিখ রুহী ঠিক করল আমাকে গুহা দেখাতে নিয়ে যাবে। পৃথিবীর সুন্দরতম গুহাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর অবস্থানই এই তাসমানিয়াতে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম গুহা। নাম-’ঊীরঃব পধাব. এটি তাসমানিয়াতেই অবস্থিত। এই গুহা প্রায় ২৩ কিলোমিটার লম্বা। কুবলা খান নামে আরো একটি গুহা আছে যার উচ্চতা ১৮ কিলোমিটার। মেঝের পরিধি ৪০ কিলোমিটার। 

খাজাদকুম [কযধলধফশঁস] নামে আর একটি গুহা আছে যার গভীরতা ৩২০ মিটার, অস্ট্রেলিয়ার গভীরতম গুহা। আমার গন্তব্যস্থল মারাকোপা গুহা দেখা যার দূরত্ব রুহীর বাসা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। অন্য গুহাগুলো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি যাতায়াতের অসুবিধার জন্য। মারাকোপা নামটি এবরিজিন নাম। ইংরেজি অর্থ ঐধহফংড়সব অর্থাৎ সুন্দর। প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯০৬ সালে এই গুহাটি আবিষ্কৃত হয়। খামারবাসী দুইজন কৃষকের ছেলে যোজন যোজন বিস্তৃত বন জঙ্গলের মধ্যে খেলতে গিয়ে হঠাৎ করে এই গুহার নিকট এসে পড়ে। তখন থেকে এই গুহা মানুষের নজর কাড়ে।
আমরা এখন এগোচ্ছি মারাকোপার পথে, দুই দিকে গহিন বন। মাঝখান দিয়ে সুন্দর গাড়ি চলার রাস্তা। পাখির কুজন, গাছগাছালির মর্মর ধ্বনি, বনের ভেতর থেকে ভেসে আসা পাথর থেকে পাথরে গড়িয়ে পড়ে পথ চলা নহরে পানির গুম গুম আওয়াজ। এ যেন এক অতিন্দ্রীয় জগত। এই জগতকে কোনভাবে ভাষায় প্রকাশ করার কোনো শব্দ, বাক্য আমার জানা নেই। আমার মনে আসছে শুধু রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতার দু’টি লাইন- ‘সীমার মধ্যে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর, তাই এত মধুর।’ আদিগন্ত সবুজের ছড়াছড়ি পথের যেন শেষ নেই পরম উৎসুক্য নিয়ে আমরা শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই।
আরো কিছুক্ষণ এগিয়ে চোখে পড়ল- মোটা কাঠের খুঁটির ওপর একটি সাঙ্কেতিক চিহ্ন দিয়ে লেখাÑ ই-১৭০. আগেই জেনেছিলাম এই সঙ্কেতটি মারাকোপার পথচিহ্ন। আমার গাড়ি ছুটল বন-বিটপীর মাঝখান দিয়ে। এই রাস্তাটি পার হতে সময় নিলো ৯০ মিনিট। অতি সাধারণ সীমানা বেষ্টিতÑ মারাকোপা গুহা এলাকা।
প্রবেশমুখে এক পাশে ছোট একটা কাঠের তৈরি অফিসঘর গ্রামের বাড়ির বড়সড় উঠানের মতো কিছু সমতল জায়গা। টয়লেট, পর্যটকদের বসার জায়গা এবং লাইট, পানিরও ব্যবস্থা আছে। কমোড ছাড়া গোটা টয়লেটের সবকিছু কাঠের তৈরি। অথচ খুব আধুনিক, বোঝার কোনো উপায় নেই আমরা কোথায় আছি। এই দেশের নাম অস্ট্রেলিয়া? অনেকক্ষণ গাড়িতে বসা। নেমেই প্রথমে গেলাম টয়লেটে।
তারপর আদিম প্রকৃতির শীতল ছায়ায়, শতাব্দীর পুরাতন বিশাল বিশাল গাছের মূলে বসে একটু বিশ্রাম নিলাম। অদূরে মারাকোপা গুহায় ঢোকার রাস্তা দেখা যাচ্ছে। আমাদের মতো অনেক পর্যটক এসেছেন গুহা দেখতে। তারা এসেছে অস্ট্রেলিয়ার মেইন ল্যান্ড থেকে বাস প্রণালী পার হয়ে। প্রতিদিন এক ধরনের কাফেলা দলে দলে আসে আল্লাহর কুদরতের অপার বিস্ময় দেখতে। একজন গাইড আমাদেরকে নিয়ে এগোলেন গুহার মুখের দিকে। ভয় পাচ্ছি! ভয়ঙ্কর কিছু দেখব না তো! দুই দিকে বনজঙ্গলে ঠাসা। মাঝখান দিয়ে মেঠো রাস্তা। গাইডের পিছু পিছু আমরা এগোচ্ছি কোনো কিছুতে হাত দিয়ে স্পর্শ না করার জন্য গাইড সাবধান করে দিলো। ঢুকেই মনে হলো আমরা বিরাট একটা অন্ধকার হল ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। ওপরে মাটির ছাদ প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় চুনাপাথরের মিশ্রণে তৈরি। নিচে দেখলাম স্বচ্ছ পানির দুইটা খরস্রোতা নহর বয়ে যাচ্ছে। নহরের পাশে খেজুরগাছের আদলে চুনাপাথর জমে জমে ছোট ছোট থাম হয়ে আছে। ছাদের মধ্যে নকল তারার মতো অসংখ্য গ্লোওয়ার্মের ঝিকিমিকি আলো জ্বলছে।
াইড ইলেকট্রিক বাতি জ্বালিয়ে দিতে আরেক রহস্যের জগতে এসে দাঁড়ালাম। মাটির গুহা যে শ্বেত শুভ্র এত বড় প্রাসাদতুল্য হতে পারে তা আমার কল্পনার অতীত। গাছের ওপর জমে থাকা স্ফটিক স্বচ্ছ চুনাপাথরে শিশির কণার মতো চুনাপাথর ফোঁটা ফোঁটা গলে গলে একেক জায়গায় পড়ছে আর পড়ছে। ঐ সব জায়গা কাচ দিয়ে বেষ্টিত করে রাখা হয়েছে। ভেতরে সাদা মার্বেল পাথরে লেখাÑ এসব লাইমস্টো ৪০ হাজার বছর ধরে ঝরছে। উচ্চতা এখনও মাথার সমান হয়নি। সম্পূর্ণ গুহাটি দেখার জন্য চারদিকে চারটি কাঠের সিঁড়ি খুব সাবধানে তৈরি করা আছে। প্রত্যেক দিকে সিঁড়ির ধাপ ২৪৬টি। একটা সিঁড়ির শেষ ধাপে আমরা খুব সাবধানে উঠে একটি সমতল জায়গায় দাঁড়ালাম। গাইড আমাদের গুহার ছাদের দিকে তাকাতে বলল। চুনাপাথরের সৃষ্টি ছাদে সাদা গাত্রে কালো ধোঁয়ার ছোপ। গাইড বলল এই গুহা ট্যুরিজমের আওতায় আসার আগে খ্রিষ্টান পাদরীরা গির্জা হিসেবে ব্যবহার করতেন। লাইম স্টোনে সৃষ্টি জমে থাকা কিছু কঠিন অংশ উপাসনার জায়গা করে নিয়েছিলেন। অন্ধকার গুহায় তারা হাতে ল্যানটার্ন নিয়ে ঢুকতেন। ল্যানটার্ন এর ধোঁয়ায় ছাদের চুনাপাথর সৃষ্টি সিলিং কালো হয়ে গেছে। গাইড ওদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল ট্যুরিজমের আওতায় আসার আগে এই গুহা ব্যবহার করত খ্রিষ্টান পাদরীরা গির্জার কাজে। ঐ যে ছাদের সিলিং-এ কালো ধোঁয়ার শিষ দেখছেন। ওগুলো সব ল্যানটার্নের ধোঁয়া নির্গত হয়ে কালো আস্তরণের সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতির খেয়াল খুশিতে সম্পূর্ণ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় চূনাপাথর ও উড়ষধসরঃব সৃষ্টি অবাক করা অবিশ্বাস্য গুহার অভ্যন্তরে কারুকার্য দেখতে দেখতে এক সময় নেমে এলাম নিচের মেঝেতে।
আদিভৌতিক গুহার অভ্যন্তরে কিছু দূরে দূরে ছোট ছোট পিতলের লাঠির ওপর বসানো ইলেকট্রিক বাতি সুইস টিপলে বিয়েবাড়ির মতো চারদিক রোশনাইতে ভরে যায়। আমরা সবাই নেমে আসতেই গাইড বাতিগুলো নিভিয়ে দিলো। সবাইকে বললÑ উপরের দিকে তাকান দেখলাম বিয়ে-সাদীতে উৎসবে মাথার ওপর পাতা সামিয়ানার মধ্যে তারার মতো বসানো কাচের পুতির ছটার মতো অবিকল, গ্লু-ওয়ার্মের দ্যুতি শোভা পাচ্ছে ছাদের সিলিংয়ে। মারাকোপা গুহার এটাই নাকি অনন্য বৈশিষ্ট্য। নিচে খুব ধীরলয়ে পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে দু’টি নহর। স্বচ্ছ স্রোতের নিচে বালু দেখা যাচ্ছে। এই নহরের উৎপত্তি কোথা থেকে, শেষই বা কোথায় বুঝতে পারলাম না। আল্লাহর সৃষ্টি পরিকল্পনার অবাক করা বিস্ময় ও বোবা অনুভূতি নিয়ে এক সময় এসে দাঁড়ালাম চুনাপাথর সৃষ্ট দুটো থামের কাছে। গাইড বললÑ হাজার বছর ধরে প্রাকৃতিক, রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ছাদ থেকে ঝরে পড়া শিশির কণার মতো ফোঁটা ফোঁটা পানিতে সৃষ্টি এই থামগুলো। এখন শারীরিকভাবে আর বাড়ে না। ফোঁটা ফোঁটা পানির মতো প্রাকৃতিক উপাদান পড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহর সৃষ্টির এক অকল্পনীয় জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম আমাদের চির চেনা পৃথিবীতে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। হায়রে আমাদের চাঁদ সূর্য সবুজের পৃথিবী। তোমরা কি জান? তোমাদের নিচেও বিশ্ববিধাতার ভাঙচুরের খেলা চলছে? চুনাপাথর ও উড়ষধসরঃব-এর মিশ্রণে সৃষ্টি এই গুহাগুলোর বয়স কোটি বছর বলে বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন। তারা আরো মনে করেন যে, এই গুহা থেকে পৃথিবীর ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব। পৃথিবীর বিবর্তনের এবং বরফ যুগের আগের মানুষদের জীবন পদ্ধতির একটি অমূল্য রেকর্ড এই গুহাগুলো।
মারাকোপা দেখে এসে কয়েকদিন গেল আমার লন টেস্টন শহরের আশপাশে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে। একদিন দেখে এলাম রুহীর মেরিন কলেজ। আর একদিন গেলাম লন টেস্টনের প্রথম ট্রেন স্টেশনে। দেখলাম পুরনো ট্রেনটি এখনো সযতনে রক্ষিত আছে। আমরা গিয়ে কিছুক্ষণ ট্রেনে উঠে সিটে বসলাম। পুরাতন ট্রেন হলেও কোথাও কোনো ধুলা-বালু নেই। মনে হচ্ছে একেবারে নতুন। এখনই যেন ছেড়ে দেবে গন্তব্যের পথে। আরো বেশ কিছু নতুন নতুন জায়গা দেখে ঘরে ফিরে এলাম।
২৮-১১-০৩ তারিখ আমার বাংলাদেশে ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে। অথচ রুহীর বাড়ির পেছনে ঞৎধাবষরুহ ধৎবধ নামে পরিচিত জায়গার পরেই একটা সুন্দর জায়গা আছে নাম- ঈঃধৎধপঃ মড়ৎমব এই জায়গাটি চোখে না দেখলে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। লন-চেস্টন জায়গাটি প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে খুবই আকর্ষণীয়। কখনো হয়তো একবার এখানে ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের ফলে এই ঈঃধৎধপঃ মড়ৎমব-এর উৎপত্তি। রুহী বললÑ এই জায়গাটি আপনার একবার দেখা দরকার। আমার আসার আগে একদিন সন্ধ্যায় আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। সেখানে একটি পাহাড় দুই ভাগে ভাগ হয়ে খাড়ির সৃষ্টি করেছে। এই খাড়ি দিয়ে শহরের মধ্যবর্তী ইসক নদীর পানি ট্রাভেলিং ড্যামে এসে জমে এবং ওখান থেকে উপচে পড়া পানি পাহাড় গড়িয়ে গড়িয়ে এসে তামা নদীতে পৌঁছে। ট্রাভেলিং ড্যামসহ ঈঃধৎধপঃ মড়ৎমব যে জায়গাটির নাম সেখানে পাহাড়ের এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য চেয়ার লিফ রাখা হয়েছে। খাড়ির তলদেশ বরাবর উভয় পাশে পাহাড়ের নিচু অংশ কেটে সমান করে সেখানে বিনোদনের জন্য এক অনিন্দসুন্দর জগৎ সৃষ্টি করে রেখেছে। আছে এক সুন্দর রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুল, জিকজাক প্যাটার্নের পাথর বিছানো রাস্তা তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। ময়ূর, ক্যাঙ্গারু ও নারী মনের খুশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে। দূর থেকে আসা ভ্রমণচারীরা দলে দলে এ দৃশ্য দেখছে। অথচ চারদিকে গভীর বন। যারা এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য চেয়ার ব্যবহার করতে চায় না তাদের জন্য রয়েছে সাসপেনশন ব্রিজ। অর্থাৎ ঝুলন্ত ব্রিজ। এই ব্রিজের পাশেই একটা বৃহৎ বৃক্ষ। এই বৃক্ষে খুদিত রয়েছে- ১৮৮৫ খ্রি: এডওয়ার্ড ও সারাহ নামের এক দম্পতি গাছটি লাগিয়েছিল। নাম ঊখগ। তারাই নাকি এই জায়গার আদি বাসিন্দা। ১৯০৫ সালে তাদের তিনটি জমজ বাচ্চা হয়েছিল। তাদের জন্মতারিখও লেখা রয়েছে গাছটিতে। ঈঃধৎধপঃ মড়ৎমব-কে কেন্দ্র করে আশপাশে কয়েকটা সুন্দর সুন্দর খাড়ি দেখলাম। আমার ছেলে বললÑ এগুলো নাকি লন-চেস্টনের প্রথম তৈরি বাড়ি। এত সুন্দর জায়গা ঘরের কাছে রেখে দেখিনি বলে অবাক হয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন