৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টা পেরিয়ে যাবার সাথে সাথে ২০১৯ তার সমাপ্তি টানবে একই সাথে শুরু হবে ইংরেজি নববর্ষ, ২০২০। নতুন বছর মানেই নতুন হিসাব, পুরানোকে স্মৃতি করে বুকে আঁকা স্বপ্ন নিয়ে সামনে চলা। আমাদের দেশে তিনটি নববর্ষ পালিত হয়। বাংলা, ইংরেজি ও আরবি। বাংলা ও আরবি সালের হিসাব, নববর্ষ পালন বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ইংরেজি নববর্ষ এসেছে একটু পরেই। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজ আমলের শুরু হয়। সে সময় থেকেই মুলত এ উপমহাদেশে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের পরিচিতি, বিস্তার ও গননা। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ইংরেজি সালের প্রচলন বা ব্যবহার থাকায় এ অঞ্চলেও তা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রচলিত ক্যালেন্ডারে নতুন বছর বোঝাতে সাধারণত অব্দ, সন, সাল ও ইয়ার শব্দগুলো ব্যাবহৃত হয়। সবগুলো শব্দ বলতেই আমরা বছর কে বুঝি। ভাষা ভিন্ন হলেও মুলত প্রতিটি শব্দের অর্থই বছর। অব্দ শব্দটি সংস্কৃত, বাংলায় বঙ্গাব্দ। সন শব্দটি আরবী। সাল শব্দটি ফারসী। ইয়ার - ইংরেজি। আমরা সাধারণত বাংলা বছর বোঝাতে বঙ্গাব্দ, আরবি বছর বোঝাতে সন বা হিজরি ব্যবহার করি। আর ইংরেজি বছর বোঝাতে খ্রিস্টাব্দ বা সাল ব্যবহার করি। যদিও বর্ষ পরিবর্তন বা বছরের হিসাব করতে এগুলোই লিখতে হবে, বলতে হবে এমন ধরাবাঁধা কোন নিয়ম আছে বলে মনে হয় না। তবে ইংরেজি বছর কে বঙ্গাব্দ লেখা হলে মারাত্মক ভুল হবে। একইভাবে বাংলা বছর কে বঙ্গাব্দ, আরবি বছর কে হিজরি উল্লেখ করতেই হবে। বড়জোর সাল, সন নিয়ে আমরা বিভিন্ন রকম লেখা দেখলেও খ্রিস্টাব্দ, হিজরি, বঙ্গাব্দ নিয়ে কারও কোন মতভেদ নেই।বাংলা, ইংরেজি, আরবি প্রতিটি বর্ষপঞ্জির রয়েছে আলাদা আলাদা ইতিহাস। যীশুখ্রীস্টের জন্ম তারিখ ধরে যে সাল গণনা হয়ে আসছে, তাকে খ্রিস্টাব্দ বা ইংরেজি সাল বলে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের তারিখ ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। ১৫৫৬ ইংরেজি সাল থেকে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরি ছিল বাংলা সনের প্রথম বছর। এর আগে কোনো বাংলা সন ছিল না। আররি বছরের হিসাব চন্দ্রমাসের সাথে সম্পর্কিত, আর বাংলা সনের শুরু হয় আরবি ৯৬৩ ধরে তারপর থেকে সৌরবছর হিসাবে। ইংরেজি বছরের পেছনের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায় মিসরীয়রা প্রথম ক্যালেন্ডার ব্যবহারের সূত্রপাত ঘটায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মিসরীয় প্রাচীন সভ্যতা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সৌর সনের উদ্ভব ঘটায়। মিসরীয় ক্যালেন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৩৬ অব্দ থেকে। মিসরীয়দের থেকে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা সভ্যতা পৌছায় গ্রিকদের কাছে। তারপর রোমানরা। রোমে নতুন বছরের হিসাব, নববর্ষ পালনের প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ অব্দে। পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার জোরেশোরে ক্যালেন্ডার পদ্ধতি চালু করেন। সম্ভবত এজন্যই সম্রাটের নামানুসারে এ ক্যালেন্ডার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিতি লাভ করে। এর বহুকাল পর ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে রোমের পোপ গ্রেগরি ততকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরামর্শে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। মিসরীয় ক্যালেন্ডারে সৌরবর্ষ ছিল ৩৬৫ দিনে। ১ মার্চ থেকে শুরু হতো নতুন বছর। মাস গুলোর নামের অর্থ দেখলেই এটা স্পষ্ট হয়। ল্যাটিন ভাষায় সেপ্টেম্বরের অর্থ হচ্ছে সাত, অক্টোবর আট, নভেম্বর নয় এবং ডিসেম্বর দশ। মার্চ যদি বছরের প্রথম মাস হয় তো সেপ্টেম্বর হবে সপ্তম মাস একই ভাবে অক্টোবর আট, নভেম্বর নয় এবং ডিসেম্বর দশ। সেসময় রোমান সরকারের নতুন অধিবেশন শুরু হতো জানুয়ারি মাস থেকে। সে অনুযায়ী পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় জানুয়ারি মাসের শুরুতে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি। ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগোরি মার্চ থেকে সরিয়ে নতুন বছরের শুরু করেন জানুয়ারি দিয়ে। প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়।
পহেলা বৈশাখ বাংলা যেমন বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন বা নববর্ষের উৎসব হিসাবে পালিত হয়। একই ভাবে ১ জানুয়ারি ইংরেজি বছরের প্রথম দিন হিসাবে নতুন বছর কে স্বাগত জানানো হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সাড়ম্বরে এ উৎসব পালিত হয়। আগে রোমানদের ভেতর ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ষপঞ্জির অনুষ্ঠান হত। আগত বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি নববর্ষ। জানুস দেবতার নামানুসারে রোমানরা জানুয়ারি মাসের নামকরণ করে। রোমানরা বহু দেব দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। ‹ জানুস› তাদের দুই মুখবিশিষ্ট এক দেবতার নাম। জানুসকে তারা বলত আরম্ভের দেবতা। রোমানরা বছরের প্রথম দিনটি জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। এটা বৈশ্বিক ভাবে উৎসবের মাত্রা পায় উনিশ শতক থেকে। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে গোটা পৃথিবীতে নিউ ইয়ার পালন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। নতুন বছরের আগের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর হচ্ছে নিউ ইয়ার ইভ। ১ জানুয়ারি নিউ ইয়ার।
অপরপ্রান্তে ইংরেজি নিউ ইয়ার পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। ইসরায়েল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। কারণ হিসাবে তারা ভিন্ন ধর্ম হতে আগত, উৎপন্ন এই রীতি পালনের বিরোধিতা করে থাকে। বিভিন্ন ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠী নিউ ইয়ার পালনের তীব্র বিরোধিতা করে থাকে। আবার কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণই করেনি। যেমন নেপাল, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, ইরান ও ইথিওপিয়া। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না।
আমি প্রথমেই বলেছি, আমাদের দেশে তিনটি নববর্ষ পালিত হয়। সে হিসাবে ইংরেজি নতুন বছরকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষ উৎসব মুখর পরিবেশে নিউ ইয়ার পালন করবে। ৩১ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকেই রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে, গ্রাম- গঞ্জে ব্যাপকভাবে উল্লাসিত মানুষ থার্টি-ফাস্ট নাইটের মাধ্যমে স্বাগত জানাবে নতুন বছর কে। এও আমাদের উৎসব। বাংলা নববর্ষে ভাতা, ছুটি থাকলেও ইংরেজি নববর্ষে সেটা নেই। তবু নিউ ইয়ার আপন রঙে রঙ্গিন। ক্যালেন্ডারের পেছনে চলে যাবে আরেক ক্যালেন্ডার। ২০১৯ হারিয়ে যাবে ২০২০ এর আড়ালে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন