শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলামী দর্শন

মোহাম্মাদ মোস্তাকিম হোসাইন | প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

ইসলাম একমাত্র ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা, যার মধ্যে রয়েছে মানব জাতির যাবতীয় সমস্যার সমাধান। মহান আল্লাহ্ তায়ালা মানব এবং জীন জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য তৈরী করেছেন। বনি আদমের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে যাবতীয় কার্যক্রমই ইবাদতের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হবে, যদি কার্যক্রমগুলো কোরআন ও সুন্নাহ এর আলোকে পরিচালিত হয় । ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ের কার্যক্রম সুষ্ঠ ভাবে পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন অর্থের। অর্থ মানব জীবনের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। আর অর্থ উপার্যনের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ন মাধ্যাম হচ্ছে ব্যবসা-বানিজ্য। পৃথিবীতে নানা ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মনে রাখতে হবে একটি দেশের অর্থ ব্যবস্থার আলোকে সেদেশের ব্যবসা বানিজ্যের মূলনীতি নির্ধারিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি আর পুজিবাদি অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি এক রকম নয়। উক্ত দুই মূলনীতি থেকে সম্পূর্ন ভিন্নতর ও ব্যতিক্রম যা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে জনগন ও রাষ্ট্রকে কল্যান ও অগ্রগতির দিকে ধাবমান করে ইসলাম। ইসলামী ব্যবসা নীতিতে সকল অবৈধ কারবার ও লেনদেন নিষিদ্ধ। তেমনি জবরদস্তি মূলক কারবার, নিষিদ্ধ জিনিষের কারবার ধোকা ও প্রতারনা মূলক কারবার ইত্যাদি নিষিদ্ধ। ইসলামের ব্যবসানীতি ও ইসলামের মৌলনীতিমালার আলোকে স্থিরিকৃত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মো: মাসুদ আলম তাঁর একটি প্রবন্ধে ইল্লেখ করেছেন যে, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যবসা-বানিজ্য ও পারস্পরিক কার্যকারবারের বৈধতা ও সুষ্ঠতা ৪টি প্রধান নীতির উপর নির্ভর করে। ১. পারস্পারিক সহযোগিতা ২. পারস্পারিক সম্মতি ৩. চুক্তিবদ্ধ হওয়ার যোগ্যতা ও ৪. ন্যায়সঙ্গত কারবার।

পারস্পারিক সহযোগিতা ব্যতীত ব্যবসা-বানিজ্য সম্ভব নয়। শুধু একক ব্যক্তির পক্ষে ব্যবসা অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ তালা বলেন, সৎকর্ম ও খোদা ভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করোনা। (আল-র্কোআন ৫-২) আল্লাহ্তালা স্বীয় অসীম জ্ঞান ও পরিপূর্ন ক্ষমতায় বিশ্বচরাচরের জন্য এমন অটুট ব্যবস্থা রচনা করেছেন যাতে একজন অন্যজনের মুখাপেক্ষি। দরিদ্র ব্যক্তি পয়সার জন্য যেমন বিওবানের মুখাপিক্ষি তেমনি একজন শ্রেষ্ঠ ধনী লোক পরিশ্রম ও মেহনতের জন্য দিনমজুরের মুখাপেক্ষি। তাই বলা যায় সমগ্র বিশ্বের ব্যবস্তাপনাও পারস্পারিক সর্ম্পকের উপরই প্রতিষ্ঠিত।

মনে রাখতে হবে অবৈধ পন্থায় অর্থসম্পদ বৃদ্ধি করা ও মুনাফা অর্জন করা ইসলামী শারিয়তের বিরোধী। এজন্য সকল প্রকার জুয়া ও লটারীর ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছে ইসলাম। কারন এর মাধ্যমে নির্ঘাত লোকশানের মাধ্যমে পথে বসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন “তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বলেদিন এত দুভায়ের মধ্যে মহাপাপ। (সুরা বাকারা -২১৯) আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন নিশ্চয় মদ ও জুয়া প্রতিমা এবং ভাগ্য র্নিধারক (গণক) এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতত্রব এগুলো থেবে বেঁচে থাক যাতে তোমরা কল্যান প্রাপ্ত হও। (আল কোরআন-মাযদা-৯০)। ইহাতে অনুধাবন করা যায় যে, হারাম জিনিষের ব্যবসাও হারাম। অথৎ ব্যবসার জন্য দরকার শরিয়ত সম্মত তথা কৈধ কস্তু। পারস্পারিক সহযোগিতা ছাড়া ব্যবসা সম্ববনয়। শুধু বিক্রেতার মাধ্যমে পূর্ন ক্রয় বিক্রয় সম্ভব। তেমনি দরকার পারস্পারিক সম্মতি, মনে রাখতে হবে সকল প্রকার কারবারে উভয় পক্ষের (ক্রেতা বিক্রেতা) স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি অবশ্যই প্রয়োজন। এখানে জবারদস্তির কোন সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা সুরা নিসার ২৯নং আয়াতে ঘোষনা করেছেন হে বিশ্ববাসীগণ তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায় ভাবে গ্রাস করিওনা। কিন্তু তোমাদের পরস্পরে সম্মতি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ এবং একে অপরকে হত্যা করিওনা, নিশ্চয় আল্লাহ্ পরম দয়ালূ।

যে সব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ জুয়া, ধোকা, প্রতারনা ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সে সব পস্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ ব্যবসার অন্তর্ভূক্ত নয়, বরং হারাম ও বাতির পন্থা। তেমনি ভাবে উভয় পক্ষের আন্তরিক সন্তুষ্টি না থাতলে সেইরুপ ক্রয়বিত্রয়ও হারাম ও বাতিল বলে গণ্য হবে। অনেকে জবর দখল বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ব্যবসার নামে অন্যের সম্পদ, দোকান, পজেশন, জায়গা দখল করে নেয় নামমাত্র অর্থ দিয়ে অথবা সমুদয় গ্রাস করে যা ইসলাম বিরোধী এবং হারাম। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। তাই সুদের কারবার কিংবা শ্রমিকের শ্রমের তুলনায় পমিশ্রমিক কম দেয়া উচিৎ নয় বরং তা ত্যাগ করা ও তৌবা করা জরুরী। যার প্রাপ্য যতোটুকু তা ঠিক মত বুঝে দেয়া মালিকের কর্তব্য। সুদের কারবারে রয়েছে জবরদস্তি ও অসহায় মানুষকে নি:স্ব করার ফাঁদ। এপ্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা সুরা বাকারা ২৭৫ নং আয়াতে বলেন আল্লাহ্ ক্রয় বিক্রয় (ব্যবসা) কে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন, সুতরাং বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট যে চাপ সৃষ্টি করে বা জবরদস্তি করে লেনদেন করতে বাধ্য করা তা থেকে মুনাফা অর্জন করা যাবেনা। সুদ সম্পর্কে জাবির (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা:) আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহীতা, সুদ দাতা, সুদের লেখক (চুক্তি সম্পাদনকারী) ও সুদের স্বাক্ষী-সকলের উপর অভিশাপ প্রদান করেছেন এবং বলেছেন, তারা সকলেই সমান অপরাধী। (সহীহ মুসলিম-৫ম খন্ড, হাদীস নং-৩৯৪৭)ব্যবসার ক্ষেত্রে ন্যায় সঙ্গত চুক্তি বদ্ধ হওয়া জরুরী। পূবেই বরেছি জোর করে চুক্তি করা যাবে না। ব্যবসার ক্ষেত্রে চুক্তি নামা বাস্তবায়ন করুরী। লিখিত চুক্তি নামা থাকলে প্রতারনার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে ইসলামে ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে চুক্তি সম্পাদনকারী অবুঝ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, পাগল, অসহায় ও দাস হতে পারবে না। নবী (সা:) বলেন তিন ব্যক্তির উপর শরীয়ত নির্দেশ আরোপিত হবে না। পাগল ঘুমন্ত ব্যক্তি ও অপ্রাপ্ত বালক (আবুদাউদ হাদিস নং ৪৪০২)।

আমরা জানি যে, ব্যবসা-বানিজ্যর অপর নাম কারবার। কারবার হচ্ছে মুনাফার উদ্দেশ্যে পন্যদ্রব্য ও সেবা কর্যাদি সংগ্রহকরন, উৎপাদন মজুদকরন, বীমাকরন ও ক্রেতা বা ভোক্তাদের ভিতর বন্টন এবং এ প্রকার সংগ্রহকরন,উৎপাদন ও বন্টনে সহায়তাকারী কার্যকলাপ।(তথ্য কারবার সংগঠন পৃ: ৫) এখানে বলা দরকার যে অতিরিক্ত মুনাফার (লাভ) জন্য খাদ্য সামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু মজুদ করা বা কৃত্রিম সংকট তৈরি করা ইসলামে নিষিদ্ধ।

সাধারণ পুজিবাদী কারবার ও ইসলামী কারবারের মধ্যে যথেষ্ঠ পার্থক্য রয়েছে । ইসলামী কারবারে কোন প্রকার প্রতারনা, ওজনে কম দেয়া ,আতœসাৎ,মিথ্যা তথ্য পরিবেশন ,ক্ষতিও পাপাচার থাকতে পারেনা । অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন কোন লেনদেন করা যাবেনা যার মাধ্যমে বিন্দু মাত্র ভেজাল বা ধোকা রয়েছ্ ে। রাসুল (সাঃ) বলেন যে ধোকা দেয় ও প্রতারন্ াকরে সে আমার দল ভুক্ত নয় । হাদিসে আরো বর্নিত হয়েছে গাইট বেধে কারবার করা কোন বস্তু শুধু ছায়াদেয় অথবা ক্রেতা কিংবা বিক্রেতার উপর ছেড়ে দিয়ে বেচাকেনা করাকে ও রাসুল(সাঃ) নিষেধ করেছেন (বোখারী খ ৪পৃ:২৮৭) ।ক্রয় বিক্রয়ের সময় ক্রেতাকে কম ওজন দেয়া কিংবাওজন করে নেওয়ার সময় বেশি নেয়া ইসলামই একমাত্র অর্থনৈতিক প্রতারনাকে নিষিদ্ধ করেছে ।ব্যবসার ক্ষেত্রে আমানতকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূন বিষয় । আমানতের খিয়ানতকারী হচ্ছে মুনাফিক আর মুনাফিকেরা জাহান্নামের তলদেশে অবস্থান করবে । তাদের শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ । হজরত আনাস (রা:) বলেন নবী সা: আমাদের প্রায় খুতবাতে বলতেন যার আমানতধারীতা নেই তার ঈমান নেই । যার অঙ্গীকার নেই তার দ্বীন নেই “(মুসনাদে আহম্মেদ ) । ইসলামই দিয়েছে বিশ্ববাসীকে ভারসাম্য পূণর্ অর্থ ব্যবস্থ্া । মহানবী (সা:) প্রথম জীবনে আবু তালেবের সাথে ব্যবসা করতেন । তিনি ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ওবিশ্বস্ত ব্যবসায়ী ,যার কারনে মক্কার শ্রেষ্ঠ ধণী রমনী খাদিজাতুল কোবরা (রা: ) ইয়াতিম নবী মুহাম্মদ (সা:) কে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে তার সমস্ত সম্পত্তি রাসুলের পদতলে প্রদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বইতিহাসে । ব্যবসা –বানিজ্য হচেছ শ্রেষ্ঠ উপার্জন রাসুল (সা)বলেন উত্তম উপার্জন হচ্ছে বায়ামাবরুও কল্যানকর বেচাকেনা এবং হস্থ শিল্পের জীবনোপকরনের সংস্থান করা আর মাবরুর বেচাকেনা হলো যাতে ক্রেতা বিক্রেতার পারস্পরিক সহযোগিতাও কল্যান নিহিত থাকবে ।অর্থাৎ তাতে প্রতারনা ,আতœসাৎ ওআল্লাহ তায়ালার নাফরমানি থাকবেনা (প্রাগুপ্তা)

সত্য কথা বলতে এই অল্প পরিসরে ইসলামী অর্থনীতির ব্যবসা-বানিজ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তথাপি অতিসংক্ষিপ্ত তথ্য নির্ভর আলোচনা জ্ঞানী পাঠকের নিকট উপস্থাপন করেছি। হারাম জিনিষের ব্যবসা করা হারাম । আবার হারাম পথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে হালাল খাদ্যও হারাম। তেমনি মদের টাকা দিয়ে দুধ কিনে খাওয়াও হারাম।

পরিশেষে বলা যায় ইসলাম মানবতার সামগ্রিক কল্যান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবসা-বানিজ্যের মত একটি গুরুত্ব পূর্ন বিূষয়ের সুস্পষ্ট মূলনীতি নির্ধারন করে দিয়েছে। ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে যদি মূলনীতিগুলো অনুসরন করা হয় তাহলে ওজনে কমবেশী, মিথ্যা তথ্য, ধোকা-প্রতারনা, ভেজাল, কালোবাজারী, মজুদাদারী, নিষিদ্ধ লেনদেন ইত্যাদি থেকে মানুষ মুক্ত হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে সুন্দর, সাবলীল ও কল্যানকর বিপনন ব্যবস্থা, ইপকৃত হবে জনগন। এগিয়ে যাবে দেশ, উন্নত হবে জাতি, সুন্দর হবে পরিবেশ।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
MMI MOMIN ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৭:৩০ পিএম says : 0
চমৎকার ও তাত্বিক এবং তথ্যনির্ভর আলোচনা। যা ইসলামি ব্যাংকিক ও ব্যবসা ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। আমি লেখক ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানায়। মাঝে মধ্যে মোস্তাকিম সাহেবের লেখা দেখতে চাই। সকলের জন্য শুভ কামনা।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন