সাহিত্য যদি সমাজের শরীর হয় তবে কাব্য সাহিত্য হবে তার আত্মা। মানুষের ভেতর, কবে, কখন, কিভাবে কবিতা প্রথম সঞ্চারিত হয়েছিলো তা আজ গবেষণার অথবা গবেষণার অতীত বিষয়। দশ হাজার বছর আগে স্পেনের গুহা মানুষ যে ধাবমান হরিণ এঁকেছিলো তার পা ছিলো অনেক গুলো। মানুষের চলার সাথে হাজার হাজার বছর ধরে লেগে আছে গতি, ঠিক ওই বহুপা বিশিষ্ট্য হরিণের মতো। এক কথায় বলা যায় গতি আছে বলেই মানুষ পাথরে পাথর ঘষে আগুন আবিস্কারের পর চমৎকৃত হয়েছিলো। মানুষের উদ্ভাবনেচ্ছা ওই আলতামারিয়া গুহার বহুপা বিশিষ্ট্য হরিণের মতো।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটা অদৃশ্য গতি কাজ করে। আর ছন্দ হচ্ছে এই গতিময়তার উৎস। কবি প্রকৃতি থেকে ছন্দের দ্যোতনা সংগ্রহ করে। নদীর ঢেউ, গাছের পাতার কম্পন, পাখির কলরব তার দৃষ্টান্ত। বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন যা বাঙালী ঐতিহ্যের সহজিয়া ধর্মসাধনার ফল তা আজ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উৎস হিসাবে স্বীকৃত। উক্ত পদের প্রতিটি স্তবকে ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। চর্চাপদ,শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণবপদ, মঙ্গল কাব্য তার দৃষ্টান্ত। ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ নৎরঃধহহরপধ তে ছন্দ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ জযুঃযস রং বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ঃযব রহংঃরপঃ ভড়ৎ ড়ৎফবৎ রহ ংড়ঁহফ যিরপয হধঃঁৎধষষু মড়াবৎহ যঁসধহ বধৎ. কবিতায় যতবেশী ছন্দের ব্যবহার করা হবে ততই তা শ্রবণ ইদ্রিয়কে স্পর্শ করবে। গোত্র রাষ্ট্র থেকে নগর রাষ্ট্র যেমন করে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে তেমনি বাংলা কাব্য সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাস সুপ্রাচীন।
আমরা যদি চর্যাপদকে গোত্র রাষ্ট(কবিতার ক্ষেত্রে) ধরি তবে কাহ্নপার ভাষায়ঃ
কাহ্নপাদানাম
রাগ-পটমঞ্জরী
“আলি এঁ কালি ঐঁ বাট রুন্ধেলা।
তা দেখি কাহ্ন বিমণা ভইলা ধ্রæ
কাহ্ন কহি গই করিম নিবাস।
জো মণ গোঅর সো উআস ধ্রæ
যার সরল অর্থ: জগতে যা কিছুই উৎপত্তি হয়, তা বিনাশ লাভ করে এ দেখে কাঁনুপা দুঃখিত হয়ে মুক্তির পথ সন্ধান করছেন।
এ কথা ঠিক যে, কোন কোন চর্যায় এমন কিছু শব্দ ও পদ পাওয়া যায় যা আসামী, উড়িয়া বা হিন্দী ভাষার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। কিন্তু সেই ধরণের দু’একটি বৈশিষ্ঠ্য দ্বারা সমগ্র রচনার জাতি-বিচার সঙ্গত নয়। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ পন্ডিতগণ দেখিয়েছেন, চর্যাপদের ভাষা মূলতই বাংলা।
এরপর (বাঙলা ১২২৩,ইংরেজী ১৯১৬) আর একখানা প্রাচীন পুঁথি স্বর্গীয় বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়; তিনিই এই পুঁথিখানার নামকরণ করেন “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। কারণ, এই পুঁথির নাম ও লিপিকারের নাম পাওয়া যায়নি, প্রথম ও শেষ পৃষ্টা খন্ডিত, মাঝেও দু এক পৃষ্টা নেই। পুঁথিখানা পাওয়া গিয়েছিল বাঁকুড়ার এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে। পুঁথিতে ভণিতা পাওয়া যায় প্রধানত বাশুলীভক্ত বড়– চন্ডিদাসের। সেজন্য বড়–চন্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকেই তখন থেকে ধরা হয় বাঙলার দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসাবে। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কে যদি নগর রাষ্ট্র (কবিতার ক্ষেত্রে) ধরি তবে বড়ু চন্ডি দাসের ভাষায়ঃ
“এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবই অসার
ছিন্ডিআঁ পেলাবো গজ মুকুতার হার
মুছি আ পেলায়িবো মোরে সিঁথের সিঁদুর
বাহুর বলয়া মো করিবো শংখচুর।”
এখানে আমরা চর্যাপদের ভাষার আলোআধারী থেকে অনেকটাই মুক্ত। যেনবা আলতামারিয়া গুহার প্রকোষ্ট থেকে উঠে এসে আগুন আবিস্কারে চমৎকৃত হচ্ছি।
মানুষের সৃজন ক্ষমতা যেভাবে এগিয়ে গেছে ক্রমোন্নতির দিকে, ঠিক তেমনি সময়ের সাথে সাথে কবিতাও এগিয়ে গেছে সু² থেকে সূ²তার দিকে। কারণ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতা সাবজেকটিভ, তাই এতে দেশ-কাল ও সমসাময়িক জীবনের চিত্র গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। কবিতা কি? এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর কোনো একটি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। কবিতার অর্থটাই শেষ কথা নয়,ব্যঞ্জনা ও অনুরণন সৃষ্টি করে তোলাই বড় কথা। অভিধানে যে অর্থ দেওয়া আছে,সেই অর্থে বদ্ধ থেকেই মনের ভাব বোঝানো যায় না।এমন অনেক ভাব ও অনুভ‚তি আছে,যাকে সুরে ও ছন্দে এবং শব্দপ্রতিমা রচনা করে অনুভব করিয়ে দিতে হয়,অর্থ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না।
এরপর মহাকবি মধুসূদন দত্তের সনেট সম্পর্কে কিছু কথা না বল্লেই নয়। সনেট কি? একটি মাত্র অখন্ড আখ্যান ভাবকল্পনা বা অনুভ‚তি ১৪ অক্ষর সমন্বিত চতুর্দশ পঙক্তিতে প্রকাশিত কবিতা সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা নামে খ্যাত। সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় বিষয় সনেটে “অষ্টক” ও “ষষ্টক” নামে দুটি অংশ থাকে। মহাকাব্য কি? নানা সর্গে বা পরিচ্ছদে বিভক্ত যে কাব্যে সুমহান বিষয়বসন্তুকে অবলম্বন করে এক বা বহু বীরোচিত কবিতা অথবা অতিলৌকিক শক্তিসম্পদিত কোনো নিয়তি নির্ধারিত ঘটনা তেজস্বী শব্দ ও ছন্দ সহযোগে বর্ণিত হয় তাকে মহাকাব্য বলে।
কেনো আমরা মেঘনাদ বধ কে আধুনিক রাষ্ট্র(কবিতার ক্ষেত্রে) হিসাবে ধরব। মধুসূদনের ভাষায়ঃ
“দানব নন্দিনী আমি, রক্ষঃকুল বধু,
বারণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,
আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজবলে।”
মহাকবি মধুসূদনের (১৮২৪-১৮৭৪) অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব হলো তাঁর পূর্বে কবিতা সুর করে পড়া হতো। এখোন আর কবিতা সুরে পড়া হয়না বরঙ আবৃতি করা হয়। প্রাচীন “পদ” কিন্তু তালমান দিয়েই গীত হতো। আর মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি আখ্যানও পাঁচালীর মতো গান করা হতো, মাঝে মাঝে নৃত্যও থাকত। মধুসূদন দত্ত বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক হিসাবে আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। মধুসূদনের ভাষায়:
শ্যামা-পক্ষী
“আঁধার পিঞ্জরে তুই, রে কুঞ্জ-বিহারী
বিহঙ্গ, কি রঙ্গে গীত গাইস সুস্বরে?
ক মোরে, পূর্ব্বের সুখ কেমনে বিষ্মরে
মনঃ তোর? বুঝা রে, যা বুঝিতে না পারিস!”
কবিতা হচ্ছে শিল্পী মানুষের বেদনা বিদ্ধ হৃদয় উৎসারণ। সময় বিশেষে কোনো একটি বিশেষ সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ বেদনা যখন প্রকাশিত হবার পথ খুঁজে পায় তখনই কবিতার জন্ম। অর্থাৎ কবিতা হচ্ছে কবির মনোলোক থেকে জাত ছন্দিক ও গতিময় ভাবোচ্ছাস। কবিতার শিল্পরূপ কখনো আনন্দ মিশ্রিত কখনো বেদনা বিধুর কখনো পুষ্পিত বিষে কলঙ্কিত। এলিয়েট যখন বলেন, “কবিতা রচনা হল রক্তকে কালিতে রূপান্তরের যন্ত্রণা” তখন কবিতা সম্পর্কে আগের ¯িœগ্ধ সৌন্দর্যের ধারণাটি এলামেলো হয়ে যায়। মধুসূদন যেন রক্তকে কালিতে রূপান্তর করেই তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্য রচনা করেছেন। রাক্ষস রাবণকে মধুসূদন দত্ত চিত্রিত করেছেন দেশ প্রেমিক হিসাবে। পরস্পরবিরোধী অনেক মন্তব্য আছে, তবে মোদ্দা কথা হলো, ”গদ্যে এবং পদ্যে যা প্রকাশ করা অসম্ভব তাই কবিতায় প্রকাশিত হয়” এ-কথাটি সর্বজন স্বীকৃত মতবাদ। কবিতা যে কবিমনের একান্ত নিজস্ব ভাবনা তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আসল কথা এই যে, কবির পঞ্চেন্দ্রিয় কবির কবিতার গর্ভাশয়। মধুসূদনের কাব্য সম্ভারের পরতে পরতে একথায় যেন ছড়িয়ে আছে একান্ত সার্থকভাবে শিল্পিত আমেজে। নিঃসন্দেহে বলা যায় মহাকবি মধুসূদন আধুনিক বাংলা কবিতার জনক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন