সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) যখন একের পর এক বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলি ও নির্যাতন করে হত্যা করছে এবং এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবল প্রতিবাদ চলছে, তখন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে কেউ মারা গেলে তার দায় সরকার নেবে না।’ তার এ ধরনের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকে তীর্যক মন্তব্য করে বলেছেন, ‘মন্ত্রী ভারতের মুখপাত্র হয়ে কথা বলছেন।’ তার এ ধরনের বক্তব্যে বিশ্লেষকরাও বিস্মিত। তারা বলছেন, দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা অনুযায়ী সীমান্তে মানুষ হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা লঙ্ঘন করে বিএসএফ নির্বিচারে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করছে। এটা সুস্পষ্টভাবে দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা এবং সীমান্তে আন্তর্জাতিক আচার-আচরণেরও পরিপন্থী। বিএসএফ যে আচরণ করছে তা বর্বর ও নির্মম। যেখানে বিএসএফÑএর এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতিবাদ ও সোচ্চার হওয়ার কথা, সেখানে সরকারের একজন মন্ত্রী উল্টো বিএসএফ-এর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তার এমন বক্তব্য, বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন করার ক্ষেত্রে বিএসএফকে আরও উৎসাহী করে তুলবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বিএসএফ-এর ধারাবাহিক হত্যাকান্ড নিয়ে সরকারের তরফ থেকে জোরালো কোনো প্রতিবাদ করার পরিবর্তে অনেকটা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাঝে মাঝে, লিপ সার্ভিসের মতো দুয়েকটি মন্তব্য করেই দায় সারছেন। দেশের বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও এ নিয়ে প্রতিবাদ ও সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তাদের এই নীরব ভূমিকায় বিএসএফ বাংলাদেশীদের নির্বিচারে হত্যার ‘লাইসেন্স টু কিল’ পেয়ে গেছে।
বিগত কয়েক বছরে সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বিভিন্ন অজুহাতে অসংখ্য বাংলাদেশী হত্যা, নির্যাতন ও অপহরণের শিকার হলেও এর প্রতিকারে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এই পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে দিন দিন বিএসএফ বাংলাদেশী নাগরিকদের অনেকটা উল্লাসে হত্যা করে চলেছে। বিএসএফ-এর এমন বর্বর আচরণ পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশিত ও সমালোচনা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু মন্তব্য করে চুপ হয়ে যান। এমনকি কয়েক মাস আগে সীমান্তে হত্যা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা বিএসএফকে দোষ দেয়া যায় নাÑএমন মন্তব্য করে ভারতের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। তার এ মন্তব্য নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরবর্তীতে সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যাযজ্ঞ বেড়ে গেলে তিনি বলেছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি ভারত রক্ষা করছে না। বিষয়টি দিল্লীকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার কথা বলেই দায় সেরেছেন। এবার খাদ্যমন্ত্রী আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, বিএসএফের হাতে মৃত্যুর দায় সরকার নেবে না। তাহলে এ দায় কে নেবে? কেউ যদি দায় না নেয়, তবে কি বিএসএফ-এর এই হত্যাকান্ড চলতেই থাকবে? এর কি কোনো প্রতিকার হবে না? অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যদি সরকারের হয়ে থাকে, তাহলে সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যাকান্ড কোনো দিনই বন্ধ হবে না। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশের নাগরিকদের রক্ষায় সরকার দায়িত্ব পালন করছে না কিংবা দায়িত্ব পালনে অপারগ। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পাখির মতো গুলি করে মারবে আর তাদের রক্ষায় সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে না, এমন সরকার বিশ্বে আর কোনো দেশে আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। বিশ্বের বহুদেশের সাথে বহুদেশের সীমান্ত রয়েছে এবং স্ব স্ব দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও রয়েছে। সেসব দেশের সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তের মতো হত্যাকান্ড ঘটে না। এমনকি ভারতের সাথে তার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমান্তেও এমন হত্যা ও নির্যাতন হয় না। ভারত কেবল বাংলাদেশের সঙ্গেই পারছে। এর কারণ বাংলাদেশের সরকার এ নিয়ে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ করছে না। প্রতিবাদ করার সাহসও দেখাচ্ছে না। কেবল মুখে মুখে দুয়েকটি মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হয়। মুখের এসব মন্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও হয়তো মানা যেত। তবে যখন বিএসএফ-এর হত্যাকান্ডের অনুকূলে যায় এমন মন্তব্য করা হয় এবং যেসব অজুহাতে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করা হয় ও তার পক্ষে সাফাই গায়, তখন দেশের মানুষ এ দুঃখ কোথায় লুকাবে তা জানা থাকে না। অথচ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী, কেউ ভুলবশত বা অবৈধভাবে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে, তাকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করার কথা। এ চুক্তির কথাটিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চারণ করতে দেখা যায় না।
খাদ্যমন্ত্রী সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, সীমান্তে গরু পাচারের জন্য কোনো বিট খাটালের অনুমোদন সরকার দেয়নি। গরু আনতে গিয়ে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করে বিএসএফের গুলিতে মারা গেলে তার দায় সরকার নেবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সীমান্তে যদি এ ধরনের খাটাল থাকে, তবে তা উচ্ছেদে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে? আর বিএসএফ কি শুধু গরু পাচারকারিদেরই হত্যা করছে? তারা কি নিরীহ কৃষক, জেলে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে না? মন্ত্রীর চোখে কি শুধু গরু পাচারকারিরাই ধরা পড়েছে? এমন বক্তব্য দিয়ে কি তিনি বিএসএফ-এর হত্যাকে জায়েজ করতে চাইছেন? যদি তাই হয়, তাহলে বলে দিলেই হয়, সীমান্তে হত্যাকান্ড শূন্যে নামিয়ে আনার চুক্তি কার্যকর নয় এবং বিএসএফ তার ইচ্ছামতো বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন চালাতে পারবে। দেশের স্বার্থের পরিপন্থী এমন মন্তব্য সরকারের কোনো মন্ত্রীর কাছ থেকে কাম্য হতে পারে না। দেশের নাগরিকদের প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করবে এবং তা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে যদি তার পক্ষেই সাফাই বক্তব্য দেয়া হয়, তবে তা কোনোভাবেই বরদাশতযোগ্য নয়। আমরা আশা করব, বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে হত্যা বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ ও বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন