রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষাঙ্গন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চেতনার ৯৫ বছর

প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জুয়েল মাহমুদ

মধ্য আষাঢ়। মেঘ ও সূর্য মেতে উঠেছিল লুকোচুরি খেলায়। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এই বুঝি বৃষ্টি নামবে অঝোরধারায়। এরই মধ্যে ঢাবি ক্যাম্পাস সেজেছে বাহারি রঙের বাতি, বেলুন ও ব্যানারে। বিভাগ, অনুষদ আর ইনস্টিটিউটে আয়োজনের কমতি ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরগুলো সাজানো হয়েছে বেলুন, ফেস্টুন আর আলপনায়। আর টিএসসিসহ সকল প্রান্তর ছিল নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত। দিনটি ছিল পহেলা জুলাই, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বরাবরের মতো এবারও বসেছিল নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীর আড্ডা। নেচে গেয়ে তারা মাতিয়ে তুলেছিল পুরো ক্যাম্পাস। প্রবীণ শিক্ষার্থীরা যেন ফিরে গিয়েছিলেন সেই সোনালী অতীতে। কেউ কেউ ঘুরে দেখেছেন স্মৃতিবিজড়িত হলগুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১২টি বিভাগ থেকে এখন বিভাগ চালু রয়েছে ৭২টি। রয়েছে ১১টি ইনস্টিটিউট, ৪৪টি গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র। যাত্রাকালে আবাসিক হল তিনটি থাকলেও এখন এর সংখ্যা ১৯ ও হোস্টেল তিনটি।
শত বৎসর না পেরুলেও শতাব্দী পূরণের চৌকাঠ পার হতে আর মাত্র ছয় বছর বাকি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৮/৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের অন্যতম স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ ৯৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণাকে নস্যাৎ করে দেয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। পাকবাহিনীর চরম বর্বতার মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তলন করেন। যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম সোনালী ঘটনা। তাইতো পাক হানাদার বাহিনীর কালো তালিকায় নাম উঠে আসে শীর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯২১ সালের এই দিনে মাত্র ৩টি অনুষদের অধীনে ১২টি বিভাগে ১১০৫ জন শিক্ষার্থী এবং ৩টি আবাসিক হল নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পুরো জাতির যে কোনো সঙ্কটময় মুহূর্তে কা-ারীর ভূমিকা পালন করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের প্রতিটি গৌরবময় আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল দেশের সর্বোচ্চ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ভূমিকার কথা কে না জানে। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দিয়েছে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। আর স্বাধীনতার পর নেতৃত্ব দিয়েছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ আন্দেলনসহ নানা রাজনৈতিক সংগ্রামে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনার নির্মাতাই শুধু নয়, এই ক্যাম্পাসে এমন কিছু স্থান ও ঐতিহ্য রয়েছে যা একদিকে ঐতিহাসিক ঘটনার নিদর্শন ও আমাদের চেতনার প্রতীক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্পর্কে হাসানুজ্জামান তারেক বলেন, একটি জাতির উদ্ভব ও বিকাশ; স্বাধিকার ও স্বাধীনতায় অনন্য ভূমিকা পালনকারী পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ তার শুভ জন্মদিন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, উচ্চশিক্ষায় তোমার অবস্থান হোক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে। আমি গর্বিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হতে পেরে। স্যালুট তোমায় আজীবন হে- প্রাচ্যের অক্সফোর্ড!
সাবিহা সুলতানা বলেন, আমি গর্বিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য হতে পেরে।
ঢাবি শিক্ষার্থী জয়দেব নন্দি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্রকে জন্ম দিয়েছে পৃথিবীতে এমন নজির নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা এক হাজার ৮০৯, যা শুরুতে ছিল মাত্র ৬০। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭ হাজার ৮২৭। এ ছাড়া সান্ধ্য বিভিন্ন কোর্সে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩০৮। বিশ্ববিদ্যালয়টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন ১ হাজার ৯৯ জন।

ইতিহাস
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ঢাকার স্থানীয় মুসলিম নেতারা বিশেষ করে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ।
১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০। সৃষ্টির শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। কলকাতার তৎকালীন একটি শিক্ষিত মহল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। এ ছাড়া ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে পূর্ববাংলার মানুষ হতাশা প্রকাশ করে।
১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। এ আইনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এ আইনের বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমন্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ, আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন