কাশ্মীর প্রশ্নে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিবৃতি পড়ে ‘আস্তে কন ঘোড়ায় আসব’ বাংলা প্রবাদটির কথা মনে পড়ে গেল। তিনি জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বক্তব্যকে ‘সত্যের অপলাপ অবিহিত করে বলেছেন ‘এ ধরণের বক্তব্য উপমহাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যু অবশ্যই ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ভারতের ভেতরকার সমস্যা ভারতকেই সমাধান করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করছি জম্মু ও কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভারত সরকার অনেক অগ্রসর হয়েছেন’। বিবৃতিতে জি এম কাদের যা বোঝাতে চাইছেন তাতে পরিষ্কার তিনি এমনিতেই এই বিবৃতি দেননি। দিল্লির শাসক মোদিকে খুশি করতেই তার এই বিবৃতি। প্রশ্ন হলো- হঠাৎ করে জি এম কাদেরের এই চেতনা কেন?
তিনি কি মরহুম সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের আদর্শের দল জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন? নাকি দিল্লির আশীর্বাদ পেতে এই পথে হাঁটছেন? এ নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিতর্ক হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-টুইটার, ব্লগে এ নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক চলছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ডিঙ্গিয়ে জাতীয় পার্টিকে কি দিল্লি অনুগত দলে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে?
এখন গ্লোবালাইজেশনের যুগ। পৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন ঘটলে অন্যপ্রান্তের মানুষ খবর পেয়েই প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। মুসলিমানদের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের মানুষ তার ব্যতিক্রম নয়। তাছাড়া ভারতের মতো আগ্রাসী দেশের প্রতিবেশি হলে তো কথাই নেই। সে দেশের ক্ষমতায় এখন বিজেপির মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল এবং নরেন্দ্র মোদির মতো নেতা প্রধানমন্ত্রী; তখন শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশির ঘুম হারাম হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
২০১৯ সালে আগস্ট মাসে মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরে থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে বিশেষ রাজ্যের তকমা দিয়ে শুরু করেন মুসলিমদের ওপর জুলুম নির্যাতন। পৈচাসিক কায়দায় মুসলিন নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর স্টিম রোলার চালানো হয়। কাশ্মীরের সাবেক দু’জন সাবেক মুখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। কাশ্মীরিদের ওপর মোদির এই জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে সারাবিশ্বের প্রতিবাদের ঝড় উঠে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাশ্মীর ইস্যু সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। পাকিস্তান চায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন কাশ্মীর সমস্যার সম্মানজনক সমাধানে ভূমিকা রাখেন। কাশ্মীর সঙ্কট সমাধানে মুসলিমবিদ্বেষী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্পের হৃদয়ে পর্যন্ত আঘাত করেছে, তিনি সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একই ডাক দিয়েছেন।
মোদির বাহিনীর জুলুমের প্রতিবাদ করছেন ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানাজি, নোবেল জয়ী ড. অমর্ত্য সেন, অরুন্ধতি রায়সহ শত শত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। এমনকি কাশ্মীরিদের ওপর মোদির জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন মুম্বাই সিনেমার প্রখ্যাত নায়ক-নায়িকারা। তারা কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ফিরিয়ে দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
এমনকি তারা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ১৯৭১ সালে ভারত যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইতিহাস গড়তে পারে তাহলে এখন কাশ্মীরিদের অধিকার আদায়ে ভূমিকা রাখবে না কেন? বাংলাদেশের বাম ও ইসলামী ধারার দলগুলো কাশ্মীরিদের ওপর জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছে। বৃহৎ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি রাজনীতির পথ হারিয়ে ফেলে অনেকটাই বেখেয়াল অবস্থায়। দিল্লির পুঁটলি খাওয়া বুদ্ধিজীবীরা চক্ষুলজ্জায় দিল্লির পক্ষে অবস্থান না নিয়ে গর্তে মুখ লুকিয়েছেন। কিন্তু ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসের দাবিদার জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান কি কাশ্মীরি মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের পক্ষে? নাকি ভারতকে খুশি করে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতেই এমন বিবৃতি? ‘সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করেছেন এইচ এম এরশাদ।
রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময় শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি, মসজিদের বিদ্যুৎ বিল মওকুফ, মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নসহ অনেক ঐতিহাসিক আইন করেছেন এরশাদ। সে কারণে যখনই এরশাদ বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছেন, তখনই আলেম সমাজের বড় অংশ তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এরশাদের রাজনীতি নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক মুসলমাদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি এবং অধিকার প্রশ্নে তিনি কখনো ছাড় দেননি। এ জন্যই দেশের অভ্যন্তরে এরশাদের বিরুদ্ধে টানা ৯ বছর আন্দোলন হলেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সহায়তা করেছেন।
দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও সীমান্ত হত্যা হলেই তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তিস্তা চুক্তির দাবিতে ঢাকা থেকে রংপুর, টিপাইমুখে বাঁধের প্রতিবাদে ঢাকা থেকে সিলেট এবং ফেনী নদীর পানি রক্ষার দাবিতে ঢাকা থেকে ফেনী লংমার্চ করে দেশপ্রেমের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। সেই এরশাদের হাতে গড়া জাতীয় পার্টির নেতা এখন ভবিষ্যতে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির লোভে দিল্লি তোষণে মেতে উঠেছেন?
বিবৃতিতে জিএম কাদের বলেছেন, ‘জম্মু ও কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান যে বক্তব্য রেখেছে তাতে এই উপমহাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে’। জি এম কাদের কোথায় এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখলেন? আর নিরাপত্তা? সত্যিই কি জি এম কাদের উপমহাদেশের নিরাপত্তা কামনা করেন? তাহলে সীমান্তে বিএসএফ একের পর এক বাংলাদেশিকে হত্যা করছে সেটা নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটায় না?
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকাস্থ বিজিবির সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে ‘গত দেড় মাসে বিএসএফ সীমান্তে ১১ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে’।
গত ৯ ইনকিলাবে ‘সীমান্তে বিএসএফের বাড়াবাড়ি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে সীমান্তের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে বিএসএফের হাতে সীমান্ত হত্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। অতীতে বাংলাদেশের মন্ত্রীর সীমান্ত হত্যা নিয়ে নীরব থাকলেও এখন মুখ খরছেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ভারত সীমান্তে হত্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে; এটা কাম্য নয়’। ২ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘এ বছর সীমান্ত হত্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সীমান্তে একজনেরও প্রাণহানি ঘটবে না। তবু ঘটছে। দু’দেশের মধ্যে চুক্তি আছে, সীমান্তে যাতে কোনো ধরণের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা না হয়। তারপরও হচ্ছে।’ শুধু তাই নয়, ভারতের এনআরসি এবং পরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পার্লামেন্টে উত্থাপনের সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে।
অমিত শাহসহ বিজেপির সিনিয়র নেতাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উসকানিমূলক বক্তব্যে বাংলাদেশের জনগণ তীব্র প্রতিবাদ করেছে। এ জন্যই ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাদের ভারত সফর বাতিল করেন। এমনকি গত মাসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও ভারত সফর বাতিল করেন। প্রতিবেশি বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এই যখন অবস্থান তখন জি এম কাদের উপমহাদেশের নিরাপত্তা বিঘেœর আশঙ্কা দেখেন না? তা ছাড়া যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুকম্পায় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলে রয়েছে জাতীয় পার্টি; সেই দলের নেতাদের চেয়েও জি এম কাদের বেশি দিল্লি প্রেমী হয়ে গেছেন?
জিএম কাদেরের এই বিবৃতি পড়ে দেশের যে বুদ্ধিজীবীরা দিল্লি তোষণে সারাবছর মেতে থাকেন; দেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিতে অভ্যস্ত; তারাও হয়তো লজ্জা পেয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন