বিশ্ব ভালোবাসা দিবস যতই ঘনিয়ে আসছে ততই চাহিদা বাড়ছে ফুলের। ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের কাছে উপহার হিসেবে বিকল্প নেই ফুলের। তাইতো ভালোবাসা দিবসে দেশের বাজারে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আর দেশের অভ্যন্তরীণ এই ফুলের সিংহভাগের যোগান আসে সাভারের বিরুলিয়ার ‘গোলাপ গ্রাম’ থেকেই। এ জন্যই এই মৌসুম ঘিরে ফুলের ভালো ফলন পেতে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার ফুল চাষিরা।
অধিক লাভের আশায় পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসগুলোর মতো মৌসুমের অপেক্ষার প্রহর গোনেন তারা। যদিও এ বছর শীত বেশি থাকার কারণে ফুলের উৎপাদন কম হয়েছে বলে দাবি গোলাপ চাষিদের। তবে এসব মৌসুমে ফুলের চাহিদা থাকায় বর্তমান মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ দামে ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করছেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর, শ্যামপুর, আক্রান, মোস্তাপাড়া, সাদুল্লাপুর, বাগ্নিবাড়িসহ প্রায় বিশটি গ্রামে চাষ হয় বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে গোলাপ, রজনীগন্ধ্যা, গ্লাডিওলাস ও জারবেরা প্রজাতির ফুল। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২৫০ থেকে ২৬০ হেক্টর জমিতেই চাষ হচ্ছে গোলাপ।
এছাড়া বিরুলিয়া, আইঠর ও আকরানসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে প্রায় ৮ হেক্টর জমিতে জারবেরা ফুলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। তবে বিদেশি প্রজাতির এই ফুল চাষ ব্যয়বহুল হওয়ায় শুধুমাত্র বড় ব্যবসায়ীরাই এর চাষ করছেন। সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এই বিভিন্ন প্রজাতির ফুলচাষ পেশার সাথে পুরোপুরি জড়িত। প্রতি বছর দেশের অভ্যন্তরীণ ফুলের বাজারে প্রায় ২৫-৩০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয় এখান থেকেই। তবে এ বছর পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা এই তিন দিবস ঘিরে প্রায় চার কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
সরেজমিনে সাভারের ফুল বাগানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ফুল বিক্রির এই মৌসুমে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পাড় করছেন চাষিরা। তারা বাগান পরিচর্যা, সেচ, আগাছা পরিষ্কার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন নিয়মিত।
শ্যামপুর এলাকার ফুল চাষি মনির হোসেন বলেন, নিজের ৩ বিঘা জমিতে মেরিন্ডা জাতের গোলাপ চাষ করেছেন তিনি। তবে এ বছর শীতের প্রকোপ বেশি হওয়ায় ফুলের উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। এখন প্রতিটি ফুল ১৫-২০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। কিছু দিন আগেও প্রতিটি ফুল ছিল ৩ থেকে ৫ টাকার মধ্যে।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসসহ অন্য দিবসগুলোর দিন যত ঘনিয়ে আসছে বাজারে ফুলের চাহিদা ততই বাড়ছে। সাথে বাড়ছে ফুলের বাজার মূল্য। ভালোবাসা দিবসে প্রতিটি ফুল পাইকারী ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি করবেন বলেও আশাবাদী তিনি।
বিরুলিয়ার আইঠর গ্রামের ফুল চাষি আশরাফ মিয়া ও নাছির উদ্দিন জানান, ৭-৮ বছর পূর্বে যৌথ প্রচেষ্টায় ভারত থেকে বিদেশি জারবেরা ফুলের চারা এনে বাগান করেছেন তিনি। এর কয়েক বছর পর ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ায় তারা জারবেরা ফুল চাষে জমির পরিমাণ বাড়িয়েছেন। কিন্তু বিদেশ থেকে প্লাস্টিক জাতীয় ফুল আমদানীর কারণে বর্তমানে তারা নিজেদের তাজা ফুলের বাজারমূল্য তুলনামূলক কম পাচ্ছেন।
তারা আরো বলেন, জারবেরা ফুল ১০-১৫ দিন পর্যন্ত সতেজ থাকে বিধায় বাজারে এর চাহিদাও এখন বেশি। গত কয়েক দিন ধরেই তারা ২০-২৫ টাকা দরে প্রতিটি জারবেরা ফুল পাইকারি বিক্রি করছেন। তবে ভালবাসা দিবসের এই মৌসুমে বর্তমান মূল্যের দ্বিগুণ দামে ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন তারা।
বিরুলিয়ার মোস্তাপাড়া এলাকার ফুল চাষি শাহজাহান মিয়া ১০ বিঘা জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন। একসময় যে জমিতে তিনি সবজির চাষ করতেন, লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় সেই জমিতে তিনি ফুল চাষ শুরু করেছেন।
শ্যামপুর এলাকার দিপু তিন বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছেন। আগে পাইকারি ৬/৭শ’ টাকা শ’ গোলাপ বিক্রি করতেন। বর্তমানে বেড়ে হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। ভালবাসা দিবসে আরও বাড়বে বলে তিনি জানান। তবে ফুল চাষ করে লাভবান হওয়ায় আগামীতে তিনি আরও কয়েক বিঘা জমি বাড়াবেন বলে জানান।
বিরুলিয়া ফুল চাষি সমিতির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসির জানান, বসন্ত বরণ ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে তাদের এখানকার ফুলের বাজার জমে উঠেছে। প্রতিদিন বিরুলিয়ার স্থানীয় বাজারগুলোতে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে ফুল সংরক্ষণ ও রফতানি করার ব্যবস্থা থাকলে চাষিরা অধিক লাভবান হতো বলেও জানান তিনি।
সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ বলেন, সাভার উপজেলায় প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। তার মধ্যে ১২ থেকে ১৫ হেক্টর জমিতে জারবেরা চাষ হচ্ছে। ২৫০ থেকে ২৬০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে।
তিনি বলেন, সাভারে ৪ শতাধিক ফুল চাষি রয়েছে। জারবেরা একটি উচ্চ মূল্যের ফুল। একেকটি জারবেরা ফুল ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জারবেরা চাষিদের আমরা নতুন নতুন উৎপাদন কলা কৌশল সম্পর্কেও পরামর্শ দিচ্ছি।
গোলাপের নতুন পদ্ধতি ই-ক্যাপিং সম্পর্কেও আমরা চাষিদের জানাচ্ছি এবং অনেকগুলো ই-ক্যাপিং টেকনোলজি প্রদান করেছি। ই-ক্যাপের মাধ্যমে গোলাপ ফুলটাকে আরো দীর্ঘ্যস্থায়ী করা যায় এবং বাজারে বেশি দামে বিক্রি করা যাচ্ছে। এভাবে কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, সাভারে ফুল চাষকে কেন্দ্র করে বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ২৫-৩০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়ে থাকে। এই মৌসুমেই কেবল প্রায় ৩ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন