শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিভাজনের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না

| প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতির কথা বলা হলেও এর টেকসই হওয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বরাবরই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, যে উন্নয়ন হচ্ছে, তার ভিত্তি বা শেকড় যদি দৃঢ় না হয়, তবে একটা সময় তা ধ্বসে পড়তে পারে। এ শঙ্কার কথা আবারও ব্যক্ত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সঠিক পথে নেই বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্য দূরীকরণ, শান্তি ও ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে দেশে এখনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। পাশাপাশি এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মূল বাধা হয়ে রয়েছে অর্থ পাচার। আমদানি ও রফতানির আড়ালে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই অর্থ পাচার ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ সকল সংকট বড় বাধা হয়ে রয়েছে। বলা বাহুল্য, দেশে আয়বৈষম্য, সুশাসন, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ব্যাপক লুটপাট নিয়ে অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বরাবরই বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। ড. কামাল হোসেন এসব পাচারকারিদের ‘রাষ্ট্রীয় ডাকাত’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের এসব বক্তব্য-বিবৃতি যে অসার তা মনে করার কারণ নেই। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান বাস্তবতার নিরিখে তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে এ সংকট তুলে ধরছে।

দেশের সার্বিক অর্থনীতি ভাল অবস্থায় রয়েছে, সরকারের এমন দাবীর পক্ষে সরকারের বাইরের অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই একমত নন। দেশের অর্থনীতি যে সরকারের কথা মতো চলছে না, তা একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও বুঝতে পারে। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি না পাওয়া, উৎপাদন কমে যাওয়া, রফতানি বাণিজ্যে ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির ঋণাত্মক দিককে প্রকট করে তুলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধানতম শর্ত হচ্ছে অবাধ বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, বিগত প্রায় এক দশক ধরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রটিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বিনিয়োগের ধারাটি যেভাবে গতি লাভ করার কথা সেভাবে করছে না। বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। দেশ থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, এর অন্যতম কারণই হচ্ছে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা। অথবা এমন সুযোগ বা পরিবেশ থাকা যাতে টাকা পাচার করা সম্ভব। তা নাহলে এত বিপুল অর্থ পাচার হবে কেন? ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে যারা খেলাপি হয়েছে, তাদের এই অর্থ কোথায় গেল বা কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে, তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এসব অর্থ যদি উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ হতো, তাহলে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। দেখা যাচ্ছে, এসব অর্থের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। সরকার ঋণ খেলাপিদের ঋণ পরিশোধে সুযোগ দিয়েও তা উদ্ধার করতে পারছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব খেলাপি ঋণের সিংহভাগই পাচার হয়ে গেছে। শুধু খেলাপি ঋণের অর্থই নয়, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যারা বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে, তাদের অনেকে দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে বসেছে। আবার যারা সত্যিকার অর্থে বিনিয়োগকারি তারা সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিভাজনের কারণে বিদেশে বিনিয়োগ করছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই নেতিবাচক ধারার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন। রাজনৈতিক বিভাজন অর্থনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কারণ, যারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক নন অথচ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী তাদের পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। ফলে তারা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্তরা একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হলেও ভবিষ্যতে অর্থের উৎস সম্পর্কিত জটিলতার মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কায় বিনিয়োগ করার পরিবর্তে পাচার করে দিচ্ছেন। বিভাজনের এই অপসংস্কৃতির কারণেও দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। অথচ আমরা যদি মালয়েশিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখব, দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ চাইনিজ এবং তারাই অর্থনীতিতে মূল ভূমিকা পালন করছে। সরকারপন্থী বা সরকারপরিপন্থী বলে কিছু নেই। চীনে হান সম্প্রদায় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে ঐক্য ও সমতা আছে। এ কারণেই তারা ব্যাপক উন্নয়ন করে চলেছে। এখানে কোনো ধরনের বিভাজন নেই। সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতেও চীনা, মালয় ও এশিয়ার বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী বৈষম্য ও বাধাহীনভাবে ভূমিকা রাখছে বলেই দেশটি ব্যাপক উন্নতি করে চলেছে। আমাদের দেশেই কেবল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিভাজন ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টরা ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পেলেও তার বাইরের লোকজন তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পকে সরকার অর্থনীতির উন্নয়নের সূচক হিসেবে বিবেচনা করলেও এর সুফল সাধারণ মানুষ খুব কমই পাচ্ছে। এ ধরনের নজির ইথিওপিয়ায়ও দেখা গেছে। দেশটিতে বড় বড় প্রকল্প দেখানো হলেও দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠী তার সুফল খুব একটা পায়নি। সেখানে টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। অন্যদিকে ভারতে বিজেপি সরকার আসার পর সেখানে জিডিপি প্রায় ৮ শতাংশে পৌঁছেছিল। বিজেপি যখন হিন্দুত্ববাদের ধোঁয়া তুলে বিভাজনের রাজনীতি শুরু করল, তখন থেকেই দেশটির অর্থনীতি ধ্বসে পড়তে শুরু করে। এখন দেশটির অর্থনীতি এতটাই নাজুক যে জিডিপি ৫-এর নিচে নেমে গেছে। একইভাবে আমাদের দেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন বলবৎ থাকলে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে না, জনগণও সমতা ভিত্তিক সুফল পাবে না।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি একক কোনো উদ্যোগের বিষয় নয়। এক্ষেত্রে দল-মত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যই মুখ্য। রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য ছাড়া টেকসই ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে। কে কোন রাজনীতি করে সেদিকে না তাকিয়ে তার অর্থনৈতিক কর্মকন্ডেের সক্ষমতার দিকে তাকাতে হবে। এখন দেশে রাজনীতি বলতে কিছু নেই। সরকারের উচিত হবে এ সুযোগে সকলের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জোরদারের মাধ্যমে টেকসই করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন