ভাষা হচ্ছে মানুষের আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা ও ভাব প্রকাশের বাহন। ইরশাদ হচ্ছে, “খালাকাল ইনসানাওয়া আল্লামাহুল বয়ান”-তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে “বয়ান” শিখিয়েছেন। বাংলা আমাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা। এ ভাষার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল ৬৮ বছর আগে। তাই ৫২’র ভাষা আন্দোলন জাতীয় ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।
বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হলে বাংলা ভাষায় পারদর্শীতা অর্জনের কোন বিকল্প নেই। দ্বীন প্রচারে বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ তা‘য়ালা প্রত্যেক নবী-রাসূলকে তার জনগোষ্ঠীর ভাষায় সু-পন্ডিত করে প্রেরণ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে“ আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষি করেই প্রেরণ করেছি, যাতে পরিষ্কার বুঝাতে পারে”। (সূরা ইব্রাহিম: আয়াত-৪)
সব ভাষাই মহান আল্লাহর সৃষ্ট ও তার নির্দশন। ইসলামের কোন পরিভাষা নেই। যে ভাষাতেই ইসলাম প্রবেশ করেছে সে ভাষাকে আপন করে নিয়েছে। ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সে ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। সে ভাষায় সৃষ্টি করেছে সাহিত্য।
পৃথিবীতে যেমন নানা দেশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা জাতি, গোত্র, বর্ণ, ধর্ম ও ভাষা। এই পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে প্রত্যেকের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি একই ভাষা ভাষী মানুষের কন্ঠস্বর, উচ্চারণভঙ্গি পৃথক পৃথক। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার কুদরতের নিদর্শন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, আর তাঁরই (কুদরতের) অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি এবং পৃথক পৃথক হওয়া তোমাদের ভাষা ও বর্ণের নিশ্চয় এতে (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্য। (সূরা রূমঃ ২২)
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে তার দেশের ভাষা প্রিয় ও মধুর। মাতৃভাষা বাংলা আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। কারণ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলে আনন্দ ও তৃপ্তি পাই। তাছাড়া মাতৃভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। এটা আমাদের বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবের।
আল্লাহ তায়ালা হলেন অন্তর্যামী, আমরা যে ভাষাতেই তাকে ডাকিনা কেন তাতে তিনি সাড়া দেবেন। কালামে পাকে রয়েছে “নিশ্চয়ই আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন। (সূরা বাক্বারা-১৮২)” “নিশ্চয়ই আল্লাহ সব শুনেন, সব দেখেন। (সূরা মুজাদালাহ-১)” “নিশ্চয়ই আল্লাহ পূর্ণরূপে জানেন (তোমাদের ) অন্তর সমূহের কথাও। (সূরা মায়িদাহ-৭)”
হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) পর্যন্ত রাসুলগনকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে প্রেরণ করে মানুষকে হেদায়তের জন্য যে ১০৪টি আসমানী কিতাব প্রেরণ করেন তা প্রত্যেক রাসুলের কওমের ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। প্রধান ৪টি আসমানী কিতাবের মধ্যে তাওরাত লেখা হয় হযরত মূসা (আঃ) এর উপর সুরয়ানী (হিব্রæ) ভাষায় এবং সর্বশেষ মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ হয় হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) এর উপর আরবী ভাষায়। আল কোরআনে বলা হয়েছে, “আমি সব রাসুলকেই তাঁদের স্বজাতির ভাষা ভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে (পরিষ্কার ভাবে আল্লাহর হুকুম সমূহ) বুঝাতে পারে। (সূরা ইব্রাহীম-৪)” কোরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হওয়ার পেছনে যদিও নানাবিধ কারণ রয়েছে তন্মধ্যে প্রধানতম কারণ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর মাতৃভাষা আরবী এবং যাদেরকে প্রথম এই গ্রন্থ বুঝানো হবে তাদের ভাষা ছিল আরবী। মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা- ‘আমি একে নাযিল করেছি কোরআন রূপে আরবী ভাষায় যেন (আরবী ভাষা হওয়ার কারণে প্রথমে) তোমরা বুঝতে পার। (সূরা ইউসুফ-২) অতএব, পবিত্র কোরআনের আলোকে বুঝা যায়, পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষ সৃষ্টিগত সমান। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বংশ ও ভাষা নিয়ে গর্ব করার কিছুই নাই। এগুলোর বিভক্তি শুধু পরিচয়ের জন্য। তবে আল্লাহর নিকট ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে, ঈমানদার, সৎকর্মশীল ও পরহেজগার। আল্লাহ পাক বলেন, “হে মানব জাতি আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ আদম (আঃ) এবং একজন নারী হাওয়া (আঃ) থেকে (এ দিক দিয়ে তোমরা সকলেই সমান) আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। বস্তুত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক মর্যাদাশীল সে ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরহেজগার।” (সূরা হুজরাত-১৩)
কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী নিজেদেরকে বাঙ্গালী জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি এবং বাংলা ভাষার চেয়ে উর্দূকে শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসাবে মনে করায়, সংখ্যা গরিষ্ঠ লোকের ভাষা “বাংলা ভাষা” হওয়া সত্তে¡ও উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষনা করার অপপ্রয়াস চালায়। যার ফলে বাঙ্গালী জাতি সেদিন এই জুলুমের বিরুদ্দে প্রতিবাদ করেছিল সম্মিলিতভাবে এবং ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী (৮ই ফাল্গুন) বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাদের মধ্যে রফিক, বরকত, জব্বার সালাম সহ আরো অনেক। আমরা আজো তাদের ভুলতে পারিনি এবং ভুলবো না। পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে- “ তোমরা অন্যায়ভাবে কারো উপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করো না, কারো উপর অত্যাচার ও জুলুম করোনা, আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। হাদীস শরীফে আছে, তোমাদের সামনে কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ করে, তবে তোমরা প্রথমে শক্তি দ্বারা প্রতিরোধ করবে, তা যদি না পারো কথা দ্বারা করবে, তাও যদি না পার তাহলে তা আন্তরিকভাবে ঘৃণা করবে।” তাই ইসলামের দৃষ্টিতে বাঙ্গালী জাতির ভাষা আন্দোলন ছির সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত ও ন্যায় সঙ্গত। একুশে ফেব্রুয়ারী বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙ্গালীর গৌরব ও ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে আমাদের মাতৃভাষার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল তারই স্মৃতিবিজরিত তারিখ একুশে ফেব্রুয়ারী। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন