মো. সামছুল হক
যাকাত হলো, আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করা এবং যা মানুষের মনের কৃপণতাকে দূর করে, মানুষের আত্মাকে পবিত্র করতে সাহায্য করে। আর যারা যাকাত প্রদান করেও আরো দান-খয়রাত করে। তাদের অন্তর থেকে কৃপণতা দূর হয়ে তাদের আত্মা পবিত্র হওয়ার পথে থাকে। আল্লাহ যাদেরকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তারা আল্লাহর নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে ধনী ব্যক্তি হয়; কিন্তু তারা আভ্যন্তরীণ দৃষ্টিতে ঋণ গ্রহীতা। আল্লাহ ধনী ব্যক্তিদেরকে ঋণ হিসেবে ধন-সম্পদ দিয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, কতভাগ অর্থ প্রতি বছর আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেই হিসেবে সকল ধনী ব্যক্তিকে তাদের ধন-সম্পদ, অর্থ হতে, শতকরা আড়াই টাকা হারে, প্রতি বৎসর আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করাকে বলা হয়, যাকাত আদায় করা। আল্লাহর তরফ থেকে প্রতি বছর আল্লাহর প্রতিনিধিরা ধনী ব্যক্তিদের নিকট থেকে, আল্লাহর ঋণ গ্রহণ করে, বা যাকাত গ্রহণ করে। পৃথিবীতে অমুসলিম ব্যতীত, সকল গরিব ব্যক্তি হলো আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ যদি সকল গরিব ব্যক্তিকে ধনী করে দেন। তবে, যাকাত গ্রহণ করার মতো কোনো গরিব ব্যক্তি থাকবে না। তখন সকল ধনী ব্যক্তি, তাদের যাকাত আদায় করতে না পারার কারণে, সকলকে দোজখের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। এজন্য আল্লাহ পৃথিবীতে ধনী গরিব সৃষ্টি করেছেন। যেন, একে অন্যকে সাহায্য করে পুণ্য লাভ করে, জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে। ধনীদের মধ্যে যারা সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করে, তাদের যাকাত গরিবরা গ্রহণ করে, তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করার পথ করে দেয়। অতএব, গরিব ব্যক্তি হলো, ধনীদের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করার পথ। আল্লাহ বলেছেন, হে মু’মিনগণ! ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন (বাকারা-১৫৩)। সকল গরিব ব্যক্তি হলো ধৈর্যশীল তারা সারাদিন অর্ধাহারে, অনাহারে দিন যাপন করে এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় পথের পার্শ্বে রাত্রি যাপন করে, তবুও ধনীদের সম্পদ চুরি বা লুণ্ঠন করে না। তারা ধৈর্য ধরে পৃথিবীতে বসবাস করছে। কারণ, তারা আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে পৃথিবীতে অবস্থান করছে। আল্লাহ গরিব ব্যক্তিদেরকে ধন-সম্পদ না দেয়ার কারণে, তাদের কোনো হিসাব নেই, এবং যাদের কোনো হিসাব নেই, তাদের অতি সহজে জান্নাতে প্রবেশ করার সম্ভাবনা থাকবে। আর, যার যত বেশি ধন-সম্পদ থাকবে, কিয়ামতের দিন তাকে তত বেশি হিসাব দিতে হবে, এবং জান্নাতে প্রবেশ করাও কঠিন হবে। আল্লাহ বলেছেন, আর আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা একে অপরের শত্রু হয়ে এবং পৃথিবীতে তোমাদের জন্য রইল অল্পদিনের বাসস্থান ও জীবিকা (বাকারা-৩৬) হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া, তারা ইবলিস শয়তানের প্ররোচণায় আল্লাহর নিষেধ বাণী অমান্য করার কারণে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন, পৃথিবীতে তোমাদের জন্য রইল অল্পদিনের বাসস্থান ও জীবিকা। হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে ৯৬০ বছর জীবিত ছিল। ৯৬০ বছর পরকালের তুলনায় মাত্র অল্পদিন, পৃথিবীতে গরিব ব্যক্তিরা, ৮০ বা ৯০ বছর জীবিত থাকে। যেখানে ৯৬০ বছর অল্পদিন, সেই তুলনায় ৮০ বা ৯০ বছর কিছুই নয়। এই অল্পদিন সকল গরিব মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, ধৈর্য ধরে বসবাস করার কারণে, আল্লাহ তাদেরকে পরকালে শান্তিতে রাখবেন; এবং সকল গরিব ব্যক্তিকে, সকল ধনী ব্যক্তি হতে পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ধনী কাকে বলে এবং গরিব কাকে বলে? বাহ্যিক দৃষ্টিতে ধনী হলো, যার ধন-সম্পদ আছে, সে হলো ধনী ব্যক্তি। আর বাহ্যিক দৃষ্টিতে যার ধন-সম্পদ, অর্থ কিছুই নেই, সে হলো গরিব ব্যক্তি। আভ্যন্তরীণ দৃষ্টিতে ধনী হলো, আল্লহর নিকট থেকে যারা ঋণ গ্রহণ করে ধনী হয়েছে, তারা হলো ঋণ গ্রহীতা। আর আভ্যন্তরীণ দৃষ্টিতে গরিব হলো, আল্লাহর প্রতিনিধি। অর্থাৎ ধনী ব্যক্তিদের নিকট থেকে, আল্লাহর ঋণ গ্রহণকারী বা যাকাত গ্রহণকারী। আল্লাহ বলেছেন, আত্মীয়-স্বজনদের দিবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও পর্যটককেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ (বনী ইসরাঈল-২৬, ২৭) আল্লাহ যাকে ধন-সম্পদ দেন, তার মৃত্যুর পরে, সেই ধন-সম্পদ তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। কেননা, আল্লাহ পরীক্ষা করার জন্য ধন-সম্পদ দিয়ে থাকেন। তাই, সকল ধনী ব্যক্তিকে মনে রাখতে হবে যে, তাদের মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহর ঋণ সঠিকভাবে পরিশোধ করলে, কিয়ামতের দিন তাদের হিসাব দিতে সহজ হবে। সুতরাং গরিব আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি ও পর্যটকদের দান করতে থাকলে, আল্লাহর ঋণ পরিশোধ হতে থাকবে, এবং তাদের মন থেকে কৃপণতা দূর হলে, তাদের মৃত্যুও শান্তির সাথে হবে। আর যদি কোনো ধনী ব্যক্তি, তার যাকাত আদায় না করে, দান-খয়রাত না করে, তার অর্থ অপব্যয় করলে, সে শয়তানের ভাই হবে। এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার নিকট থেকে খুব কঠিন হিসাব নিবেন ও তার জান্নাতে প্রবেশ করা কঠিন হবে। আবার অতি কৃপণ হওয়া যাবে না, এবং অতি দাতাও হওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেছেন, তুমি বদ্ধ-মুষ্টি (অতি কৃপণ) হয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্ত (অতি দাতা) হয়ো না; হলে তুমি নিন্দিত ও নিস্ব হবে (বনী ইসরাঈল-২৯)। অমুসলিম গরিব ব্যক্তিকে যাকাত প্রদান করা জায়েয হবে না। কারণ, অমুসলিম ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতিনিধি নয়। আল্লাহ বলেছেন, স্মরণ করুন, যখন তার প্রভু বলেছিলেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর। তখন সে বলল, আমি বিশ্বের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম (সূরা বাকারা-১৩১)। যারা আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে তারা মুসলিম। আর যারা আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে না, তারা অমুসলিম। অমুসলিম ব্যক্তিরা আল্লাহর দাসত্ব করে না এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবাদৎও করে না। তাই, অমুসলিম ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারে না। আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাথে শিরিক করার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এছাড়া, অন্যান্য পাপের ক্ষেত্রে যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করবেন। কেউ আল্লাহর সাথে শিরিক করলে, সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয় (নিসা-১১৬)। কিন্তু অমুসলিম ব্যক্তিকে যাকাত ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে সাহায্য করা যাবে। কেননা, সকল মানব সন্তানের আদি পিতা-মাতা হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া এবং তারা মুসলিম ছিল। তাদের সন্তান হিসাবে সকল মানব সন্তান ভাই ভাই এবং সকলেই মুসলিম। তাই, পৃথিবীতে সকল শিশু মুসলিম হয়েই জন্ম গ্রহণ করছে। কারণ, আল্লাহ সকল মানব সন্তানকে হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া থেকে সৃষ্টি করছেন। কিন্তু পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম সৃষ্টি হওয়ার কারণে, যে শিশু যে ধর্মের পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, সেই শিশু বড় হয়ে, ঐ ধর্মেরই অনুসারী হয়ে থাকে; এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউর উপাসনা করে। সুতরাং তাদেরকে যাকাত ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে সাহায্য করা যাবে। পক্ষান্তরে, কোনো অমুসলিম ব্যক্তিকে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউর উপাসনা করার জন্য, কোনো মুসলিম ব্যক্তির সম্মতি প্রদান করা, বা অর্থ প্রদান করা, অথবা যাকাতের অর্থ প্রদান করা জায়েয হবে না। কেউ যদি প্রদান করে, তারই শিরিক করা হবে। যেমন, যদি কোনো ব্যক্তি একটি ঘর নির্মাণ করে, সেই ঘর নির্মাণ করার সঙ্গে, কোনো ব্যক্তি সম্মতি প্রদান করলে বা অর্থ প্রদান করলে, তারও সেই ঘর নির্মাণ করার সঙ্গে অংশগ্রহণ করা হবে। সুতরাং সকল ব্যক্তিকে দোজখ হতে রক্ষা পেতে হলে, সকল ব্যক্তিকে শিরিক করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সঠিকভাবে যাকাত আদায় করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন