মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী
দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেমেদ্বীন, বাংলায় সীরাত সাহিত্যের প্রবর্তক, বহুগ্রন্থ প্রণেতা, ইসলামী আন্দোলনের পুরোধাব্যক্তিত্ব, মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আর নেই। তিনি গত ১৯ রমজান, মোতাবেক ২৫ জুন ২০১৬ ইসায়ী রোজ ইফতারের কিছুক্ষণ আগে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন’। চিন্তাশীল একজন ইসলামী স্কলার হিসেবে দেশের বাইরেও তার খ্যাতি ছিল। বাংলাদেশে ইসলামী আর্দশ প্রচার ও প্রসারে তার অনন্য ভূমিকা দেশের তৌহিদী জনতা চিরদিন স্মরণ করবে। তিনি সকল দল, মতের নেতা-কর্মী, আলেম-ওলামাদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। এদেশের আলেম-ওলামা এবং ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের জন্য দীর্ঘকাল প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ফখরে মিল্লাত মাওলানা খান আজীবন ইসলামী রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। নেতৃত্বের পালাবদলে অনেক চড়াই উৎরাইয়ের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো পদের জন্য রাজনীতি করেননি। এই সত্যটি সচেতন মহল নিশ্চয় অকপটে স্বীকার করবেন। ইসলামী ঐক্যজোট ও জমিয়তের রাজনীতি থেকে এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ যুগে তথাকথিক বিশ্বায়নের বিকৃতি ও আকাশ সংস্কৃতির দাপটে অনেক জাতি জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। এ বাস্তবতায় মাটি ও মানুষের প্রতি বিশ্বস্ত মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ভূমিকা অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবি রাখে। বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক চেতনা ও ধর্মীয় কল্যাণকর মূল্যবোধ গঠন ও লালনে তিনি এখনো নিবেদিত প্রাণ। মেধাবী এ ব্যক্তিত্বের কর্মময় জীবন এ দেশের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে প্রেরণা যোগায়। স্বকীয় সত্তা বহাল রাখার সংগ্রামে সাহস সঞ্চার করে। মুহিউদ্দীন খান একজন ব্যক্তিই নন, বহুমুখী তৎপরতায় এক উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। তার সম্পাদিত মাসিক মদীনা পত্রিকাটি দেশের সর্বাধিকপঠিত পত্রিকা হিসেবে ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পত্রিকাটি পৌঁছে গিয়েছিল। বিশেষ করে মাসিক মদীনার প্রশ্নোত্তরগুলো পাঠকরা মনযোগ সহকারে পড়তেন। তিনি বিশ্ববিখ্যাত তাফসীরে মা’য়ারেফুল কোরআন বাংলা অনুবাদ করেন। তিনি রাবেতায় আলম আল ইসলামীর সদস্য এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মাওলানা মুহিউদ্দীন খান তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআনসহ শতাধিক গ্রন্থর লেখক ও অনুবাদক ।
জন্ম : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ১৯৩৫ ঈসায়ীর ১৯ এপ্রিল মুতাবিক ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ৭ই বৈশাখ শুক্রবার জুমআর আজানের সময় কিশোরগঞ্জ জেলাধীন পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের ছয়চির গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার আনসার নগরে। তার পিতা মৌলবী আনসারুদ্দীন খান ছিলেন আমীরুল মুুমিনীন সায়্যিদ আহমাদ শহীদ (র.)-এর নিষ্ঠাবান অনুসারী। সায়্যিদ আহমাদ শহীদের উত্তরসূরী ফুরফুরার বিখ্যাত পীর মাওলানা আবু বকর সিদ্দীকী (র.)-এর নিকট বায়আত হয়ে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় সফলতা অর্জন করেন। তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সভাপতি শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (র.)-এর ভক্ত ছিলেন। জমিয়তের মোমেনশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দীর্ঘকাল পালন করেন। মরহুমের মাতা রাবিয়া খাতুন হলেন শাহ্ শামসুদ্দীন তুর্কী(র.)- এর বংশধর। মাতার কাছেই মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। হাফিয নঈমুদ্দীনের নিকট তিনি কায়দা, সিপারা ও কোরআন পড়া শিখেন। পিতা তাকে ‘পাঁচবাগ ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসা’র প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। কিন্তু মাতার ইন্তিকালের পর তিনি নানীর তত্ত্বাবধানে থাকায় নানাবাড়ির নিকটবর্তী তারাকান্দি মাদরাসায় ১৯৪৭ ঈসায়ীতে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে মন বসাতে না পারায় তিনি দু’বছর পর আবার পাঁচবাগ মাদরাসায় ফিরে আসেন। তিনি পাঁচবাগ মাদরাসা থেকে ১৯৫১ ঈসায়ীতে আলিম ও ১৯৫৩ ঈসায়ীতে স্কলারশিপসহ ফাযিল পাস করেন। পাঁচবাগের শিক্ষকগণের মধ্যে কলিকাতা ও দেওবন্দের ডিগ্রিধারী অত্যন্ত মেধাবী ও বিচক্ষণ আলিম মুফতী মুহাম্মাদ আলী খুরশীদমহলী ছিলেন তার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক। ক্লাসের পড়ার বাইরে অনেক কিছুই তিনি তার কাছে শিখেছিলেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের খোঁজ-খবর তিনি তার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি পিতার নিকট বাংলা ও আরবী সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। ১৯৫৩ ঈসায়ীতে উচ্চ শিক্ষার্থে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৫ ঈসায়ীতে হাদীস বিষয়ে কামিল ও ১৯৫৬ ঈসায়ীতে ফিক্হ্ বিষয়ে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় যেসব শিক্ষকের নিকট অধ্যয়ন করেন তাদের মধ্যে আল্লামা যাফর আহমাদ উসমানী, মুফতী সায়্যিদ আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী, আল্লামা আবদুর রাহমান কাশগড়ী (র.) উল্লেখযোগ্য। আল্লামা যাফর আহমাদ উসমানী মাদরাসায় বুখারী শরীফ পড়াতেন। তার কাছে তিনি বুখারীর প্রথমার্ধ দুবার পড়েন। একবার হাদীস পড়ার বছর, আরেকবার ফিক্হ্ পড়ার বছর। তাছাড়া মাঝে মাঝে ইমামগঞ্জ মাসজিদের দারসেও গিয়ে বসতেন। উল্লেøখ্য যে, আল্লামা উসমানী উক্ত মসজিদে বাদ ফজর আশরাফুল উলূম ও জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগের ছাত্রদেরকে বুখারী পড়াতেন। বুখারী শরীফের শেষাংশ পড়েছেন মুফতী সায়্যিদ আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদীর নিকট। ফিক্হ্ পড়েন আল্লামা শাফী হুজ্জাতুল্লøাহ্ আনসারী (র.)’র নিকট। তিনি ছিলেন লক্ষেèৗর প্রখ্যাত আলিম ও উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী মাওলানা আবদুল বারী ফিরিঙ্গিমহল্লীর জ্ঞাতি ভাই। মুসলিম শরীফ ও তিরমিযী শরীফের একাংশ অধ্যয়ন করেন মাওলানা মুমতাজ উদ্দীন (র.)-এর কাছে।
সাংবাদিকতা : পাঁচবাগ মাদরাসার প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালে তাকে পিতা বেঙ্গল গভর্নমেন্টের প্রচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলার কথা’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার গ্রাহক করে দেন। বিজনৌর থেকে প্রকাশিত উর্দূ অর্ধসাপ্তহিক ‘মদীনা’ এবং দিল্লী থেকে প্রকাশিত উর্দূ মাসিক ‘মওলবী’ তাদের ঘরে নিয়মিত আসত। তাছাড়া তার পিতার নিজস্ব একটা গ্রন্থাগার ছিল। তাতে সে যুগের অনেক মূল্যবান বই ছিল। পিতা তাকে বই-পুস্তক সংগ্রহ করার ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দিতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকার প্রতি তার মনে তীব্র আকর্ষণ গড়ে উঠে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাত্রজীবন থেকেই সহিত্যচর্চা শুরু করেন। ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নকালে ‘সাপ্তাহিক তালীম’, ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ ‘সাপ্তাহিক কাফেলা’, ‘সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম’, ‘দৈনিক ইনসাফ’, ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক মিল্লাত’ প্রভৃতি তখনকার বহুল প্রচারিত পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫৫ ঈসায়ীর শেষের দিকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘পাসবান’ নামক বিখ্যাত উর্দূ দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৯৬০ ঈসায়ীতে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫৭ ঈসায়ীতে ‘আজ’ নামে ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। তার সম্পাদনায় ১৯৫৭ ঈসায়ীর ১৫ই আগস্ট ‘আজ’-এর প্রথম সংখ্যা তখনকার সময়ের সেরা লেখকদের রচনা নিয়ে প্রকাশিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ‘আজ’ বাজারের সকল সাময়িকীর সাথে প্রতিযোগিতায় প্রচার সংখ্যার শীর্ষে পৌঁছে। ১৯৬০ ঈসায়ীতে কর্তৃপক্ষ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া পর্যন্ত তিনি তা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৬০ ঈসায়ীতে ‘মাসিক দিশারী’, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ ঈসায়ী পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন এবং ১৯৬১ ঈসায়ী থেকে অদ্যাবধি ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনা করছেন। বিবাহ : ১৯৫৮ ঈসায়ীতে মোমেনশাহী জেলাধীন ত্রিশাল উপজেলার নওয়াপাড়া মুন্সিবাড়ি নিবাসী মাওলানা হাফিয তাফাজ্জুল হুসাইনের দ্বিতীয় সন্তান রহিমা খাতুনের সাথে তার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। তিনি তিন পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান লাভ করেন। ছেলেরা হলেন মোস্তফা মঈনুদ্দীন খান, মোর্তজা বশীরুদ্দীন খান ও আহমাদ বদরুদ্দীন খান। মেয়েরা হলেন রাবিয়া পারভীন ও আয়িশা সিদ্দীকা ইয়াসমিন।
মাতার অন্তিম উপদেশ : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান মাত্র বার বছর বয়সে তার স্নেহময়ী মাকে হারান। মুমূর্ষু অবস্থায় মা তাকে ডেকে বলেন, “বাজান, আমি তো চললাম। আমি না থাকাকালে তুমি কি কর তা আমি দেখব। এমন কিছু কর না যা দেখে আমার আত্মা কষ্ট পায়।” তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে জিজ্ঞেস করেন, “মাগো, বড় হয়ে কি করলে তোমার আত্মা খুশি হবে?” মা তখন ধরা গলায় বলেন, “তোমাকে নিয়ে কত স্বপ্নই তো ছিল। সব কথার বড় কথা, তুমি হবে ইসলামের একজন সাহসী সৈনিক। যদি আল্লøাহ্ পাক তওফীক দেন তবে বড় হয়ে ‘মাসিক নেয়ামত’-এর মতো একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে চেষ্টা করবে। আল্লøাহর কথা, আল্লøাহর রাসূলের কথা লিখে প্রচার করবে। আমি দুআ করে যাই, আল্লাহ্ তোমাকে সে শক্তি দিবেন।” ১৯৪৬ ঈসায়ীর ৮ই অক্টোবর মুতাবিক ১৩৫৩ বঙ্গাব্দের ২২ আশ্বিন মঙ্গলবার মাগরিবের সময় স্নেহময়ী মাতা ইন্তিকাল করেন।
‘মাসিক মদীনা’ প্রকাশ : ১৯৬১ ঈসায়ীতে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সম্পাদনায় ‘মাসিক মদীনা’ প্রকাশের মাধ্যমে তার মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ১লা মার্চ বিকাল পাঁচটায় ৫৫/৩ ইংলিশ রোড, ঢাকায় অবস্থিত মদীনা কার্যালয়ের সম্মুখস্থ খালি জায়গায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত হন ডক্টর মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ্, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, মোশাররফ হোসেন, তালিম হোসেন, চৌধুরী শামসুর রহমান, খান বাহাদুর জসীমুদ্দীন, দেওয়ান আবদুল হামীদ প্রমুখ বিখ্যাত লেখক, কবি ও দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। ‘মাসিক মদীনা’র প্রথম কপি একশ টাকায় কিনে নেন খান বাহাদুর জসীমুদ্দীন (নারায়ণগঞ্জ) এবং দ্বিতীয় কপি কিনেন ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ্। পরদিন ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ প্রভৃতি বিখ্যাত বাংলা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মাসিক মদীনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ‘মদীনা’র ক্ষুরধার লেখনী ও তেজস্বী ভাষায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে স্বার্থান্বেষী মহল এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা সম্পাদকের উপর একাধিক মামলা দায়ের করে। ১৯৯৫ ঈসায়ীতে শুনানী শেষে বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হান্নান এক আদেশ বলে সম্পাদককে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। কালক্রমে ‘মাসিক মদীনা’ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় ম্যাগাজিনে পরিণত হয়।
ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠা :
বিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশকের মাঝামাঝিতে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য ও ডেপুটি স্পীকার এটিএম আবদুল মতীনের সহযোগিতায় বায়তুল মুকাররাম কমপ্লেক্সের ভেতরেই একটা দালানের দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়ে ‘দারুল উলূম ইসলামী একাডেমি’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠান মাত্র এক বছরের মধ্যে অন্যূন দশটা কিতাব অনুবাদ করে প্রকাশ করে। এখান থেকে ১৯৬০ ঈসায়ীতে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সম্পাদনায় ‘মাসিক দিশারী’ নামে একটা গবেষণা পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে প্রতিষ্ঠানটি একটা ভাল অবস্থানে পৌঁছলে দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক আইয়ূব খানের আমলে একে সরকারিকরণ করা হয়। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি ইচ্ছা করলে এখানে ভাল বেতনে সম্মানজনক চাকরি করতে পারেন। কিন্তু এ প্রস্তাবে তিনি সম্মত হননি এ কারণে যে, ইসলামের সহীহ্ ব্যাখ্যা দেয়ার উদ্দেশ্যে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন তা সরকারি ইসলামের নানা অপকর্মে ব্যবহৃত হবে। কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগপত্র নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদে যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ রাখা হয়।
ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা :
১৯৫৯ ঈসায়ীতে ময়মনসিংহ শহরে পূর্ব পাকিস্তানের সকল সাময়িক পত্র-পত্রিকার সম্পাদক-মালিকদের একটা সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক জনমত’ সম্পাদক কিতাব আলী তালুকদার এবং তার প্রধান সহযোগী ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। সম্মেলনের অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য ‘সাপ্তাহিক জনমত’ কার্যালয় সংলগ্ন একটা খালি বাড়ি প্রশাসনের নিকট থেকে বরাদ্দ নেয়া হয়। দেশের সকল সাময়িক পত্র-পত্রিকার সাথে যোগাযোগ ও সম্মেলনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এ বাড়িতে বিশ/একুশ দিন অবস্থান করেন। এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জাকির হুসাইন। সভাপতিত্ব করেন ‘সাপ্তাহিক আরাফাত’ সম্পাদক মাওলানা আবদুল্লøাহিল কাফী। এতে ময়মনসিংহ শহরের সর্বস্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শরীক হন। সম্মেলনে উক্ত বাড়িকে প্রেসক্লাবের জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ করান মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এবং তাৎক্ষণিকভাবে কিছু আসবাবপত্র সংগ্রহ করে তা চালু করেন। এ সম্মেলন থেকেই গঠিত হয় ইস্ট পাকিস্তান পিরিওডিক্যাল এসোসিয়েশন। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল অবহেলিত সাময়িক পত্র-পত্রিকাগুলোর মানোন্নয়ন ও দাবি-দাওয়া আদায়। মাওলানা আবদুল্লøাহিল কাফী এ সংস্থার সভাপতি, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সহ সভাপতি ও কিতাব আলী তালুকদার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
কোরআনের উপদেশাবলি প্রকাশ :
বিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় পবিত্র কোরআনের প্রত্যক্ষ উপদেশাবলীর সমন্বয়ে একটা মূল্যবান পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। এ পুস্তক সংকলনের জন্য যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছিল তার সভাপতি ছিলেন শামসুল উলামা বেলায়েত হুসাইন এবং সদস্য ছিলেন ডক্টর মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ্, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ডক্টর সিরাজুল হক ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ নির্বাচন ও তা বাংলায় অনুবাদ করে কমিটির কাছে পেশ করার দায়িত্ব অর্পিত হয় মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের উপর। তিনি এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেন।
পিতৃবিয়োগ :
১৯৭৬ ঈসায়ীর ৬ই সেপ্টেম্বর মুতাবিক ১৩৯৬ হিজরীর ১০ই রামাজান সোমবার দুপুর প্রায় ১১টার সময় পিতা হাকীম মৌলবী আনসারুদ্দীন খান ইন্তিকাল করেন। সেদিন আসরের নামাজের পর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার নামাজের ইমামতি করেন মরহুমের জ্যেষ্ঠপুত্র মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। জানাযায় উপস্থিত ছিলেন খলিফায়ে মাদানী মাওলানা মুহিবুর রাহমান লাকসামী, খলিফায়ে মাদানী মাওলানা আমিনুল হক মাহমূদী, মাওলানা সায়্যিদ তোয়াহা, মাওলানা আলী নেওয়াজ রাহিমাহুমুল্লাহ্ প্রমুখ বিশিষ্ট আলিমসহ প্রায় ২০-২৫ হাজার লোক। জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
টিপাইমুখ বাঁধ লংমার্চ :
ভারত সরকার একতরফাভাবে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কি. মি. দূরে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর সম্মিলিত উজানে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এ বাঁধ নির্মিত হলে নদীদ্বয়ের নাব্য হারিয়ে যাবে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তাই এ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ‘ভারতীয় নদী আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি’র ব্যানারে ২০০৫ ঈসায়ীর ৯ ও ১০ই মার্চ টিপাইমুখ অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেন। এতে দেশের প্রায় ত্রিশটা সংগঠন যোগদান করে। লংমার্চ শেষে জকিগঞ্জে অনুষ্ঠিত লাখো জনতার সমাবেশে তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে টিপাইমুখ বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত করেন এবং তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
সমাজকল্যাণমূলক কার্যাবলি : অসহায়, দরিদ্র ও ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, সম্বলহীন লোকদের বসতবাড়ি নির্মাণসহ সার্বিক কল্যাণে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। বান্দরবন জেলার কয়েকশ উপজাতি পরিবার তার সহযোগিতায় ইসলাম গ্রহণ করে। সেখানে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষকে তিনি ‘তাওহীদ মিশন’ নামক সংস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসন করেন। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বাড়ি, মাসজিদ, মকতব ও স্কুল নির্মাণ করেন। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন এলাকায় বহু মাসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা, মকতব, পাঠাগার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন।
বিদেশ সফর :
ইসলামের অগ্রগতি ও মুসলিম জাতির কল্যাণের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে তিনি সাঊদী আরবের মাক্কা, মাদীনা, জিদ্দা, রিয়াদ; সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি, দুবাই; ইরাকের বাগদাদ, বসরা, নজফ, কারবালা; মিশরের কায়রো, সুয়েজ, তানতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য নগরীগুলো একাধিকবার সফর করেন। তাছাড়া তিনি কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, সুমালিয়া, নাইজেরিয়া, সাইপ্রাস, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিঙ্গাপুর, মালয়সিয়া, ইন্দোনেসিয়া প্রভৃতি দেশ কয়েকবার সফর করেন। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন