মানুষের কোলাহল একদম নেই। নেই দাপাদাপি। অসহ্য যত শোরগোল। সী-বাইক নামের যন্ত্রদানবের আওয়াজ, অস্থির ছোটাছুটির যাতনা বন্ধ। সমুদ্র সৈকত ঘেঁষে সারি সারি হোটেল মোটেল রিসোর্ট ভবনগুলো এখন ভূতুরে বাড়িঘর। কী পর্যটক? জনশূণ্য পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজার। তার বিশাল বালুকা বেলাভূমিজুড়ে চৈত্রের ঠা ঠা রোদ। আর দমে দমে শোঁ শোঁ বাতাসে ভর করে শুধুই ভেসে আসছে সমুদ্রের তর্জন-গর্জন।
কারণ। সেই একটাই। এখন করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী সংক্রমণ রোধে সমস্ত মানুষজন ঘরবন্দি। অবিরাম লকডাউন, শাটডাউন বা টানা ছুটিতে বন্ধ-অচল পুরো বাংলাদেশ। ভয়-আতঙ্কে থমকে আছে দুনিয়াবাসী। যা কেউ কখনও দেখেনি আগে।
পৃথিবী নামের গ্রহটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, যদিও পৃথিবীবাসী অসুস্থ, ভীত-শঙ্কিত, পীড়িত এবং অশান্ত। অন্যদিকে জেগে উঠেছে, খেলছে অপরূপ মহিমাভরা পরিবেশ-প্রকৃতি। আর হাসছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতও। এ যেন হঠাৎ এক জাগরণের খেলা। ভাঙাভিটায় গড়ার আয়োজন। সজীবতা, সৃজন এবং সুন্দরতার পালা। যেন একটু দম নিচ্ছে পৃথিবী নামের গ্রহটা। সবার মনে জাগায় অপার বিস্ময়। বাড়ছে দিন দিন কৌতূহল অনেকেরই মাঝে।
আজ বহুদিন হয়ে গেল সৈকতজুড়ে শুধুই খাঁ খাঁ। শূণ্যতা চারদিকে। এখন কে ফেলবে ময়লা-আবর্জনা রাশিরাশি? সাগরের পানিও আপাতত দূষণমুক্ত। কারণ জাহাজ, ট্রলার, যান্ত্রিক অযান্ত্রিক হাজারো নৌযানের চলালল নেই। সাগরে নির্বিচারে মাছ শিকার নেই। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি জাহাজ-নৌযানের সতর্ক সচকিত আসা-যাওয়া ছাড়া সমুদ্রবক্ষÑ সেখানেও শূণ্যতা লাগাতার।
বঙ্গোপসাগরের আবহাওয়া এখন শান্ত। তাই নেই কোন সতর্ক সঙ্কেত।
অতীতে অদেখা অজানা অবাক-বিস্ময় এমনকি সৃষ্টিকর্তার রহস্যঘেরা এমনিতর সময়গুলো অতিক্রম করেই চলেছে। আর তা করতে করতে আজ গোটা পৃথিবীর সঙ্গেই কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার থেকে শুরু করে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ড, হাজারো নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গিরিপথ, খাল-বিল, উপত্যকা, হ্রদ-ঝরণাধারা কঠোর ভাষায় সেই দাবি সেই আকুতি তুলেছে যেন-
“আমাকে আমার মত থাকতে দাও। আমি নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছি...। যেটা ছিলোনা ছিলোনা- সেটা না পাওয়াই থাক” (কণ্ঠশিল্পী অনুপম রায়)। তার মানেÑ ‘প্লিজ লীভ মি এলোন’।
অথবা যদি বলা হয়-
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর, হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী..। (কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। কবিতা: ‘সভ্যতার প্রতি’।
নীরব-নির্জন প্রকৃতির খেলা আর মেলায় কী কী ঘটছেÑ
করোনাভাইরাস আতঙ্ক সারা দুনিয়াকে যখন গ্রাস করে আছে এ সময়ই নীরব-নির্জন ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে মায়াময় প্রকৃতি নিজের সুষমা সৌন্দর্যরাশি একের পর এক মেলে ধরছে। এবং তার নিজেরই কাছে। নিজেই তা উপভোগের সুসময় বেছে নিয়েছে যেন। অবিরত চলছে প্রকৃতির বুকে হাসি-খেলা আর মেলা। প্রকৃতির সমাহার বাড়ছে দিন দিন। আর সবই ঘটে চলেছে মনুষ্যতাণ্ডবের আড়ালে আবডালে।
এরইমধ্যে মুক্ত স্বাধীন প্রকৃতির মাঝে সবচেয়ে বড় চমক দেখা গেছে, গত সপ্তাহ থেকে সৈকত নগরী কক্সবাজারের লাগোয়া সমুদ্রতটের কাছাকাছি ছুটে আসে ডলফিনের দল। গভীর সমুদ্র থেকে সৈকতের কাছের পানিতে বহুতল হোটেল মোটেল পাড়ার ঠিক বিপরীত দিকে এসেও ঢেউয়ের তালে তালে লাফালাফি, ডিগবাজি খেলে চলেছে ডলফিনরা। যা এখন রোজকার ঘটনা। তবে দেখার তো কে থাকবে সেখানে? জনাকয়েক স্থানীয় বাসিন্দা হয়তো নিজের দরকারি কাজের কোনো গরজে সেদিকে গিয়েই দেখেন ডলফিন দলের ঘোরাফেরা। ডলফিনের আনন্দ মেলার এই দৃশ্য মোবাইলে ধারণের সুবাদে দেশ-বিদেশে ভাইরাল হয়ে যায়।
‘করোনা মহামারী দুর্যোগের মাঝে প্রকৃতিতে ভিন্নরূপ। কোলাহল-বিহীন শান্ত প্রকৃতির আচরণ পরিবর্তনের এই যে ‘বিউটি’ দিক। এর পেছনে সামুদ্রিক বিজ্ঞান-সম্মত কী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ’? দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন তাঁর পাঠকমহলের নিকট তা তুলে ধরার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন তখনই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে গত ২৯ মার্চ’২০২০ইং প্রকাশিত সচিত্র সংবাদের শিরোনামটি ছিলÑ ‘মানুষের শোরগোল এবং ডলফিন’। সংবাদে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্সেস অনুষদের দু’জন সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী এবং অধ্যাপক ড. মো. হোসেন জামালের অভিমত ও বিশ্লেষণ।
আজ বুধবারও তারা জানালেন, মানুষের ঝামেলা-জট-দূষণ ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে ডলফিন দলে দলে এসে প্রকৃতির আপন নিয়মে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কাছে-কিনারে খেলাধুলা করবে। লাফিয়ে উঠবে পানিতে। খেলবে ডিগবাজি। আবার বাসস্থানে ফিরেও যাবে। এভাবেই চলবে। যতক্ষণ না আগের মতো ডিসটার্ব দেওয়া না হচ্ছে। কেননা ডলফিনরা খুবই প্লে-ফুল অর্থাৎ আমুদে সামুদ্রিক প্রাণি। ওরা কিন্তু মানুষকে ভয় পায় না, পেতে চায়ও না। কাছে ঘেঁষতে চায়।
কিন্তু শব্দদূষণ তাণ্ডবসহ মানুষের নিষ্ঠুর সব কর্মকাণ্ডের কারণেই ওরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। ওরা বেশ বুদ্ধিমান প্রাণি। ভালোমন্দ সহ্য করার ক্ষমতা আছে। আছে ওদের দূর থেকেই প্রখর ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তি। সাধারণত বঙ্গোপসাগরের আমাদের পানিসীমায় ‘ইরাবতী’ এবং ‘বটল নোজ’ এই দুই ধরনের ডলফিন বেশিই বিচরণ করে। যাদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র বঙ্গোপসাগরের ‘দ্য সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এলাকায়। সেটি সুন্দরবনের দক্ষিণে।
তারা (শর্তসাপেক্ষে) আশাবাদী, আমাদের সমুদ্র প্রকৃতিকে দূষণরোধসহ সব উপায়ে সুরক্ষা করা গেলে ডলফিন দলে দলে খেলতে আসবে কক্সবাজার সৈকত বরাবর। ওদের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি হয়ে উঠবে তখনই। যা এতকাল ধরে ওদের কাছে ভয়ের ঠিকানা। কোলাহলমুক্ত দূষণমুক্ত পরিবেশ প্রকৃতি নিশ্চিত থাকলে ডলফিনের অবাধ বিচরণের সুবাদে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার বিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তা কীভাবে? কার দায় কে নেবে?
জাগছে আর সাজছে পরিবেশ-প্রকৃতিÑ
নির্জন ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ কক্সবাজারসহ সমগ্র দেশে যেন প্রতিনিয়তই জাগছে আর সাজছে পরিবেশ-প্রকৃতি। তার আপন নিয়মের ধারাতেই এসব ঘটছে মানুষের চোখের আড়ালে। করোনা আতঙ্কের জেরে যতদিন অপরিণামদর্শী মানুষের ধ্বংসের হাত-পা ও তাবৎ অপকাণ্ডের আঘাত না আসছে তততিন ধরেই অব্যাহত থাকবে প্রকৃতিতে মেরামত, বুনন আর সৃজনের ধারাপাত।
যেমনÑ মাত্র কিছুদিনের জন কোলাহল আর যান্ত্রিক অত্যাচার বন্ধ থাকার সুবাদে ডলফিনের খেলেধুলে ঘুরে বেড়ানোই কী শুধু? এরই মাঝে সমগ্র কক্সবাজার ও তার বালুরাশি, মাটি-ভূমি-পাহাড়-টিলাসহ অনেক দিক দিয়েই চলছে সৃষ্টি এবং আনন্দের মেলা।
মানুষের কোনোই কোলাহল না থাকার ফলেই দিনে দিনে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে সাগরলতা, গুল্ম-রাজি এতকাল পর মাটির তলা থেকে সবুজের গালিচা বিছিয়ে দিয়েই চলেছে। যা আগে ছিল শুষ্ক খটখটে বালুর পাহাড়। সবুজের জালের সাথে ফুটছে অগণিত জাতের নাম জানা আর না জানা ফুল, বুনোফুল। বাহারি সব রঙের। বালুরাশিকে সুশোভিত করে তুলছে।
সবচেয়ে এর বড় দিক হলো, মানুষের আগ্রাসন, উত্তাল ঢেউ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে ক্ষয়ে যেতে থাকে সৈকতের বালুমাটি এবং তার মূল। এখন এসব সৃষ্টি আর গড়নের খেলায় বালুমাটির মূলের দিকে শক্ত-বন্ধন তৈরি হচ্ছে। অবিরত তাই করছে এসব বাহারী লতাগুল্ম, বনবীথি, ছোট ছোট বৃক্ষরাজি, ঘাষ আর ফুলরাশি। এলাকাবাসীই জানান, গত কয়েকদিনে কক্সবাজারের সৈকতের নানা জায়গায় সাগরলতা জেগে উঠছে। বেশ ছড়িয়েও পড়ছে। এভাবেই সবখানে বাড়ছে প্রকৃতির অপরূপ শোভা। মাটি, মূল ও বালিরাশি মজবুত হতে থাকলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত আগের চেয়ে বেশিগুণে সহ্য করার সক্ষমতা পাবে কক্সবাজার সৈকত। যার মেরামত প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে স্বাভাবিক পরিবেশে প্রকৃতিরই আপন নিয়মের ধারায়।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিউল আলমÑ
এসব প্রসঙ্গে আজ বুধবার ইনকিলাব প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট পরিবেশ-প্রকৃতি বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি বললেন, “করোনা সঙ্কট পরিস্থিতিতে মানুষ এখন আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধ্বংসকরণ কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখেছে। কিংবা বাধ্য হয়েছে। বলতে গেলে বিশ্ব প্রকৃতির উপর মানুষের জুলুম কমেছে। আর সেই সুবাদে প্রকৃতি তার হারানো আচরণে ফিরে আসছে। তাই দৃশ্যমান। প্রকৃতি মনের সুখেই যেন নিজেকে জেগে তুলছে। পৃথিবীর সামনে রূপ-নিসর্গ মেলে ধরছে। গাছপালা নিধন কমেছে। আর বাড়ছে গাছের বেড়ে ওঠার সুযোগ।
তিনি জানান, এ মুহূর্তে বিজ্ঞানীদের ধারণা পৃথিবীজুড়ে ক্ষতিকর কার্বন ও নাইট্রোজেন জনিত দূষণ শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। পৃথিবীটা বিষাক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াও কমেছে। গ্রিন হাউজ ক্ষতির মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে। এই ধারা যতদিন চলবে ততদিন এসব কিছু আরও উন্নতির দিকেই যাবে।
তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বৈশ্বিক মহামারীর এই চরমতম আতঙ্ক ও সঙ্কটকালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের তাবৎ জাতি-মানুষ জীবনধারণ, জীবনযাপন সঙ্কট, অর্থনৈতিক সমস্যা-সঙ্কট, বেকারত্বের হুমকিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপর্যয় মোকাবিলা করে চলেছে। এহেন মহাদুর্যোগকালে সকল নেতিবাচকতার মাঝেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ-প্রকৃতির রাজ্যে ইতিবাচকতার যে আয়োজন-গঠন-পুনর্গঠন-গড়ন-সৃজন আর আনন্দমেলা-খেলা, উচ্ছ¡লতা, কলতান বইছে। আর সবই চলছে প্রকৃতির আপন নিয়মেই।
রবী ঠাকুরের সেই ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতা দিয়েই শেষ করিÑ
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত¡গুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব--
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধনসভ্যতার প্রতি
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত¡গুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব--
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন