হারুন সাহেব নিতান্ত সাদামাটা মানুষ। একটা প্রাইভেট ব্যাংকে কাজ করেন। অফিসে যাওয়া আর বাড়ি আসা তার কাজ বলতে এই, আর কিছু নেই। করোনা ছড়ানোর খবরে কাজকর্মে হারিয়ে ফেলছেন খেই। প্রতিদিন অফিসে ঢুকতেই সহকর্মী ফরিদ সাহেব একটা হাই তুলে লম্বা সুরে বলেন, প্রতিদিন মৃত্যু। পঁচিশ হাজার ছাড়িয়েছে, ত্রিশ হাজার পেরিয়েছে, পঞ্চাশ হাজার হাজার ছুইছুই...। পঁচিশ , ত্রিশ, পঞ্চাশ শুনে সকাল বেলা যে কেঁপে ওঠা, সে আতঙ্ক বয়ে বেড়াতে হয় সারাদিন। অবস্থা এমন ফরিদ সাহেব হা হু করলেও কেঁপে ওঠেন হারুন সাহেব। তার ধারণা ধীরে ধীরে তিনি প্যানিক ডিজঅর্ডার এর রুগী হয়ে যাচ্ছেন। বিমর্ষচিত্তে চেয়ারে গা এলিয়ে ভাবেন, দিন দিন ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে করোনা। অঘোষিত লকডাউন চললেও তাদের দু›ঘন্টা হাজিরা দিতে হচ্ছে।
ফরিদ সাহেব হাক দেন, এই যে হারুন সাহেব।
-হু। -সদ্যবিধবা মহিলার মতো মুখ কালো করে বসে আছেন কেন? -করোনা নিয়ে আতঙ্ক আছি।
-বেশি বেশি পেপে খাবেন।
-পেপে খেলে কী হবে?
-করোনা থেকে বাচার এক মহা পথ্য।
-চীন, ইতালির ডাক্তাররা বলেছে?
-আরে রাখেন আপনার চীন, ইতালি। ওসব কোন ডাক্তার হলো। যত্তসব ঢংতার। আমার কথা শুনুন, প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা লবণ পানি গুলিয়ে খাবেন। -আচ্ছা।
-আর শুনুন বাসায় ফিরে প্রথমেই চুলা জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ গরম ছ্যাঁকার মাধ্যমে শরীর ভাইরাস মুক্ত করবেন।
-হু। -সকালে অফিসে আসার আগে দুটো থানকুনি পাতা চিবিয়ে খেয়ে আসবেন।
-হু। ফরিদ সাহেবের কথা শেষ হয় না। আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। বেশি বেশি ভিটামিন সি খাবেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। ফলে তো ভেজাল। বাজার থেকে ভিটামিন সি ট্যাবলেট কিনে খেতে পারেন। চকলেট ফেল। এগুলো দশ বিশটা খেলেও প্রবলেম নাই।
হারুন সাহেব হা হু, জি আচ্ছার ভেতর নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। এসব জি আচ্ছার ভেতর গুটানো আতঙ্ক। থানকুনি পাতার কথা তিনি আগেও কোথায় যেন শুনেছন। অফিস শেষে বাজারে ঢোকেন। লোকে লোকারণ্য বাজারে রাজ্যের শূন্যতা। সামান্য কিছু মানুষ নিতান্ত প্রয়োজনে বাজারে এসেছে। তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক। দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়ছে। সবকিছু পাওয়াও যাচ্ছে না। কাচা বাজারের এক দোকানী কে বলে, ‹থানকুনি পাতা আছে। লোকটা যেন হারুন সাহেবের অপেক্ষায় ছিলেন, সেভাবে তাকিয়ে বলেন, না,পাতার শেকড় আছে।
-ওতে কাজ হবে? -হবে মানে! মানুষ তো বোঝে না। শেকড় না থাকলে গাছ হয়? শেকড়ের ভেতর ই সব। -শেকড় কত?
-তিন শেকড় তিনশো টাকা।
পকেটে তিনশত টাকা না থাকায় থানকুনির শেকড় কেনা হয় না। ইচ্ছে করে এক আটি শেকড় নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। বাজারের ভেতর থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন কাজ। গনধোলাই খেয়ে মরার সম্ভাবনা আছে। সেটা যদিও বা পেরিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু রাস্তায় থাকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে ধরা পড়তেই হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস আর চাপা আতঙ্ক নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন হারুন সাহেব। সভা সমাবেশ, স্কুল কলেজ, সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও, জনসমাগম চায়ের দোকানে। বিড়ি টানা, পান খোর মানুষ গুলো কিছুই হয়নি একটা ভাব নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এদিকে বেশি বেশি ভিটামিন সি খেতে পরামর্শ দেয়া ফরিদ সাহেব ইদানীং বাথরুমে আধাঘন্টা সময় পার করেছেন। তার কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ দেখা দিয়েছে। আজ তিনি বাথরুমের ভেতর থেকে চিতকার করছেন। ফরিদ সাহেব বাথরুমে আলাদা স্যান্ডেল পরেন। ভালো করে হাত পা পরিস্কার করে বাথরুম শেষে বাইরে রাখা জুতা পরেন। আজ সে জুতা পাওয়া যাচ্ছেনা। জুতা কই, জুতা কই বলে সমানে চিতকার করে যাচ্ছেন। সমাধানের শেষ হাতিয়ার হিসাবে অভিশাপ দিতে শুরু করেন,
আমার জুতা যে নিয়েছে চুরি করে,
সে যেন করোনাভাইরাসে মরে।
জুতা যদি নাই পাই,
শুন রাখ এ জগতে বেশিদিন তোর হবে না ঠাই। জেনারেল ম্যানেজার আশফাক উদ্দিন চিতকার শুনে চুপচাপ বসে থাকলেও অভিশাপ শুরু হওয়া মাত্র ছুটে যান। ‹বাথরুমে কবিতা পাঠ করছেন কেন?›
বড়কর্তা কে দেখে ফরিদ সাহেব কিছুটা স্বর নামিয়ে বলেন, কবিতা না স্যার; অভিশাপ দিচ্ছি। -কেন? -আমার জুতা চুরি হয়েছে স্যার।
-জুতা চুরি হয়নি আমি ফেলে দিয়েছি। -ফেলে দিয়েছেন? -হ্যাঁ। এটা আপনার বাড়ির বাথরুম নয় যে ঘন্টা ধরে দরজা দিয়ে বসে থাকবেন। রেস্ট নেবেন, ঘুমাবেন, কবিতা চর্চা করবেন। ফরিদ সাহেবও তেতে ওঠেন, কাজটা কিন্তু ভালো করেননি। ইচ্ছা করছে পায়ের স্যান্ডেল....
বাকি কথা শেষ হবার আগেই জি.এম সাহেব খেকিয়ে ওঠেন, এই হ্যান্ড স্যানিটাইজার টা নিয়ে আয় তো। আজ পুরোটা মুখ চেপে খাইয়ে দেব।
হারুন সাহেব চিতকার শুনে ছুটে আসেন। তিনি হড়বড় করে বলা কথার ভেতর শুধু শুনেছেন, স্যান্ডেল আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার এই দুটো শব্দ। এমনিতেই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। পাওয়া যাচ্ছে না।মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলেন, স্যার হ্যান্ড স্যানিটাইজার কী খেতেও হয়? মুহুর্তে জি.এম সাবের সাহেব বিশেষজ্ঞ বনে যায়। বলেন, শুনুন বিশ মিনিট পর পর বিশ মিনিট সময় নিয়ে হাত ধোবেন। ফরিদ সাহেব চিতকার করে বলেন, ওনার কথা একদম শুনবেন না। হাত কিন্ত হাতের যায়গায় থাকবেনা। খুলে পড়ে যাবে। ইস বশ মিনিট ধরে হাত ধোবেন।
হারুন সাহেব নিরবে সরে পড়েন। ঝগড়াঝাটি তার পছন্দ নয়। বিপদের দিনেও কিছু মানুষ থাকবে তাদের জ্ঞান গরিমা প্রকাশে ব্যস্ত। অহংকার ধরে রেখে মারামারি করবে। দেখতে দেখতে দু›ঘন্টা পেরিয়ে যায়। বাড়ি ফেরার পথে দেখে একজন জটলা পাকিয়ে করোনার ওষুধ বিক্রি করছে। তার ওষুধে একশো পার্সেন্ট গ্রান্টি। সকাল সন্ধ্যা দুই চামচ। তিন সপ্তাহ, প্রতি ফাইল তিনশো টাকা।
হারুন সাহেব দাঁড়িয়ে যান। যা বক্তব্য তাতে চার ফাইল ওষুধ নিলে তার পরিবার নিশ্চিন্তে আনন্দ ফুর্তি করে বেড়াতে পারবে। ওষুধ নেবেন ঠিক সে সময় পেছন থেকে চটাচট লাঠিপেটার শব্দ ভেসে আসে। হুড়োহুড়ি। হারুন সাহেব দীর্ঘদিন পর চল্লিশ কিলোমিটার গতিতে দৌড় শুরু করেন। আপাতত এ ঝাপটা থেকে বাচা দরকার। ওষুধ বিক্রি করা ডাক্তারের কী অবস্থা কে জানে! অনেকটা পথ পেরিয়ে যেখানে থামেন সেটা আরেক জটলা। সেখানে করোনা ধারে কাছে ভিড়ে না টাইপ মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। মানুষ ঠেলাঠেলি করে নিজের স্থান পোক্ত করছে। হারুন সাহেব দাঁড়ান না। আপন মনে ভাবেন দেশে সবাই যেন করোনা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছে। কী যে হয়? বিড়বিড় করে বলেন, মালিক তুমি আমাদের রক্ষা কর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন