শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

রোগ মুক্তির মালিক আল্লাহ তা‘আলা

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

আল্লাহ তা‘আলা মাঝে মধ্যে রোগ-বালাই দিয়ে বান্দার ঈমানের দৃঢ়তা বা ওজন পরীক্ষা করে থাকেন। তিনি দেখতে চান, বিপদ-আপদকালীন সময়ে তাঁর বান্দাদের মধ্যে কে বা কারা, তাঁর উপর অবিচল আস্থা বা বিশ্বাস রেখে, ধৈর্যের সাথে সামনের দিকে এগিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে।’’ [সূরা বাকারা : ১৫৫]
‘‘আর ভালো এবং মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি।’’ [সূরা আম্বিয়া : ৩৫]
বর্তমান বিশ্ব দু’টো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। দেখেছে বহু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ। মহামারি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মানুষ দেখেছে কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েডসহ অনেক রোগের প্রকোপ। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো একযোগে এত সর্বগ্রাসী বিস্তার এর আগে তেমনভাবে আর দেখা যায়নি। পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রোগবালাই মহামারি আকারে বিস্তারের কথা উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে দেশের মসজিদগুলোতে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে বিশেষভাবে মোনাজাত করা হচ্ছে আল্লাহর সাহায্যের জন্য। মানুষকে হুঁশিয়ার করা হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্যসচেতন হওয়ার জন্য। এখন শোনা যাচ্ছে, বিশ্বের কিছু কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জুমার নামাজের জামাতও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে।
একটি অণুসম ভাইরাস কিভাবে বিশ্বকে অচল করে দিতে পারে, তা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে বিশ্ববাসী। কিভাবে করোনাভাইরাস নামক একটি মারাত্মক জীবাণু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে অপ্রতিরোধ গতিতে তাও দেখছে বিশ্বের মানুষ। এসবের কাছে আমরা অর্থাৎ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী মানুষ কত অসহায় তা আবার প্রমাণিত হলো। ক্ষুদ্র করোনাভাইরাসের কাছে পারমাণবিক শক্তিও অচল ও অসহায়। এ মারাত্মক ভাইরাসের প্রতিষেধক কবে নাগাদ মানুষের হাতে এসে পৌঁছবে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
মানুষের ভালো-মন্দ উভয়ের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা সমভাবে ক্ষমতাবান। আমরা অসুস্থ হলে, তিনিই আমাদের সুস্থতা দান করেন। রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে চিকিৎসক শুধুমাত্র চেষ্টা করতে পারেন। মানুষ একে অপরের জন্য কেবল মাত্র দু‘আ করতে পারে। আরোগ্য দানের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ তা‘আলার দয়ার উপর নির্ভর করে। আল্লাহর সাহায্য বা দয়া ব্যতিত কঠিন রোগ-ব্যাধি থেকে কারোরই আরোগ্য লাভ করা সম্ভব নয়। তিনি যদি কারো উপর আযাব গজব দান করেন, কেউ তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। সৃষ্টি জগতের সব কিছুই তাঁর ইচ্ছার অধীন। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘‘আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো দুর্দশা স্পর্শ করান, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। আর যদি কোনো কল্যাণ দ্বারা স্পর্শ করেন তবে তিনিই তো সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আর তিনিই তাঁর বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান।’’ [সূরা আনআ’ম : ১৭-১৮]
“বল তো কে নিঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে পুর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত করেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই ধ্যান কর।” [সূরা নামল : ৬২]
রোগ মুক্তির ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের আয়াতে শেফা নামে ৬ টি আয়াত রয়েছে। সেগুলো হলো- ১. সূরা তাওবার ১৪ নং আয়াত, “মুসলমানদের অন্তরসমূহ শান্ত করবেন।”
২. সূরা ইউনূসের ৫৭ নং আয়াত, “অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য।”
৩. সূরা নাহলের ৬৯ নং আয়াত, “তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগমুক্তি।”
৪. সূরা বনী ইসরাঈলের ৮২ নং আয়াত, “আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনদের জন্য রহমত।”
৫. সূরা আশ্-শোয়ারার ৮০ নং আয়াত, “এবং যখন আমি রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন।”
৬. সূরা হা-মীম এর ৪৪ নং আয়াত “বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার।”
উপরোক্ত প্রতিটি আয়াতেই কুরআনে মুমিনদের জন্য ‘শেফা’, ‘রহমত’ প্রভৃতির কথা উল্লিখিত হয়েছে। তফসীরবিদ ইমাম বায়হাকী (রহ.) ‘শেফা’ অর্থ আত্মা এবং দেহ উভয়ের শেফা বা নিরাময় বলেছেন। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে যেমন আত্মার যাবতীয় রোগ এবং মন্দ প্রবণতার চিকিৎসা রয়েছে, তেমনি দেহের যাবতীয় রোগ-ব্যাধীরও চিকিৎসা রয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহূ হতে বণিত। হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “খালিক মালিক রব মহা আল্লাহ পাক এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি।” [বুখারী, খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা-৮৪৮, হাদীস নং-৫২৭৬; তাফসীরে কুরতুবী, খন্ড-১০ম, পৃষ্ঠা-২৩৫] ইমাম সুবকী রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহূ উনাকে স্বপ্নে মহান আল্লাহ পাক বলেন, “তুমি কুরআন মজিদের শেফার আয়াতসমূহ একত্র করে তা তোমার ছেলের নিকট পাঠ কর অথবা আয়াতগুলো একটি পাত্রে একত্রে লিখে তা ছেলেকে পান করাও, যতক্ষণ না তাতে সে আরাগ্য হয়। অতঃপর তিনি অনুরূপ করলে উনার ছেলেকে খালিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক সুস্থতা দান করেন।” [তাফসীরে রূহুল মা’আনী, খন্ড-৮ম, পৃষ্ঠা-১৪৫]
”যে ব্যক্তি কুরআনের মাধ্যমে আরোগ্য তালাশ করে না, তার কোন শেফা নেই।” [তাফসীরে কুরতুবী, খন্ড-১০ম, পৃষ্ঠা-২৩৫]
মুমিনগণের উপর কোন মুসিবত আপতিত হলে আল্লাহ তা‘আলা যে দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন- ‘‘যখন তাদের উপর কোন মুসিবত আপতিত হয় তখন তারা বলে, (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য আর আমাদেরকে তারই দিকে ফিরে যেতে হবে)।’’ [সূরা বাকারাহ : ১৫৬]
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে, প্রয়োজনীয় সতর্কতার পাশাপাশি এই দু‘আটি বেশি বেশি পড়া যেতে পারে- “হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট ধবল, কুষ্ঠ এবং উন্মাদনা সহ সব ধরনের কঠিন দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে পানাহ চাই।” [সুনান আবু দাউদ]
আলকুরআন মানুষের হিদায়াতের পাশাপাশি তাদের রোগ-বালাই থেকে পরিত্রানের জন্যও কতই না কার্যকর, কতই না ফলপ্রসু। দুনিয়া ও আখিরাতের সমূহ কল্যাণ লাভের ক্ষেত্রে কতই না বাস্তব এর প্রতিটি তথ্য ও তত্ত।
সুস্থতা আল্লাহ তা‘আলার অনেক বড় নিআমত। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- “দু’টি নিআমতের ক্ষেত্রে অনেক মানুষ ধোঁকার মধ্যে রয়েছে : ১. সুস্থতা ২. অবসর।” [সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪২২]
অনেক মানুষ ধোঁকার মধ্যে থাকার অর্থ হল, প্রথমত এই দুই নিআমত সাধারণত একসাথে লাভ হয় না। অনেক মানুষ সুস্থ, কিন্তু তার অবসর নেই। আবার অনেকে অবসর, কিন্তু সুস্থ নয়। আর কারো ভাগ্যে যদি উভয় নিআমতই একসাথে মিলে যায় তবে এর প্রকৃত মূল্যায়ন খুব কম মানুষই করে থাকে; বরং অযথা কাজকর্মে এ দুই নিআমত নষ্ট হয়ে যায়।
অসুস্থতাও আল্লাহ তা‘আলার অনেক বড় নিআমত। বিভিন্ন হাদীসে রোগ-শোক ও বালা-মসিবতেরও তাৎপর্য ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অসুস্থতা দেহের যাকাত স্বরূপ। এর দ্বারা শরীর গুনাহমুক্ত হয়, পাক-পবিত্র হয়। আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদা বুলন্দ হয়। ভবিষ্যত জীবনের জন্য উপদেশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়।
অসুস্থতার সময় নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা মানুষের কাছে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠে। শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, আভ্যন্তরীণ প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার মিথ্যা অহমিকা অনেকেরই আছে। কোনো অভিনব সৃষ্টিশীল কাজ করে নিজের দিকে তা সম্পৃক্ত করে পুলক অনুভব করার মানসিকতা আছে সবারই। কখনো কোনো বড় কাজ করতে পারলে বুদ্ধির অপরিপক্কতা ও অপূর্ণতার দরুন অত্মমুগ্ধতার শিকার হয়ে যায় অনেকেই। কখনো এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা এ পর্যায়ে পৌঁছে যে, ব্যক্তি নিজেকেই নিজের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক ও সর্বেসর্বা মনে করে বসে। অথচ মানুষ এতটাই দুর্বল ও অক্ষম যে, তাকে পরাভূত করার জন্য ছোট্ট ভাইরাসই যথেষ্ট।
অধিকাংশ সময়ই মানুষ ভুলে যায় যে, তার শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, প্রতিভা ও যোগ্যতা তার নিজের ক্ষমতাবলে পাওয়া নয়; বরং তা মালিকের দান। তিনি দিয়েছেন। চাইলে আবার ছিনিয়েও নিতে পারেন। তাছাড়া মানুষের শক্তি, সুস্থতা ও যোগ্যতার ব্যবহারও আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও তাওফীকের উপর নির্ভরশীল। মানুষের কৃত কল্যাণকর কাজ নিজের শক্তিবলে নয়; বরং দয়ালু ও মহান প্রতিপালকের দয়া ও করুণার কারণেই সম্পাদিত হয়। যদি এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তাওফীকের ছায়া উঠিয়ে নেন তাহলে মানুষ এক পাও উপরে উঠাতে পারবে না। যেমনিভাবে বিদ্যুৎ ছাড়া কারখানার সকল মেশিন অচল পড়ে থাকে তেমনিভাবে আল্লাহর দয়া ও তাওফীক ছাড়া মানুষের সকল প্রতিভা ও যোগ্যতা অচল পড়ে থাকবে। মানুষের অস্তিত্ব, শারীরিক-আত্মিক সকল শক্তি ও প্রতিভা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলার হেফাযত ও তত্ত্বাবধানের মুখাপেক্ষী। তিনি যদি হেফাযতের কুদরতি চাদর একটুখানি উঠিয়ে নেন তাহলে মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সকল প্রতিভা ও যোগ্যতা মূল্যহীন হয়ে পড়বে। মানুষ দুর্বল কোনো পাখী কিংবা কীট-পতঙ্গ থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
S. M. Enamul Haque ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:২৩ পিএম says : 0
অনেক চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপস্থাপনকারীকে আল্লাহপাক যেন নেক হায়াত ও নেক আমল করার তওফিক দান করেন এবং কঠিন রোগ থেকে মুক্তির জন্য আরো বেশি বেশি কোরআনের আয়াত দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়ার তওফিক দান করেন। আমীন।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন