শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

বিপদ-মুসিবতে তাওবা ও ইস্তিগফার

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ও উদ্বেগ দিনদিন বাড়ছে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে এবং লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত। আজ সারা দুনিয়ার মানুষ গৃহবন্দি। আমরা কি একটু ভেবে দেখেছি, একের পর এক বিপদ কেন আঘাত হানছে? কেন আমাদের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না? অথচ প্রতিনিয়ত পাপ কাজ করেই যাচ্ছি।

খুন, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, অধিক মুনাফা লাভের আশায় অসৎ ব্যবসা-বাণিজ্য, অহরহ মিথ্যা বলাসহ এমন কোনো পাপ নেই যা আমরা করছি না? এমনকি মতের অমিল হলে হত্যা করতেও দিধা করছি না।
এতকিছু পরও আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দার দোষ-ত্রু টি ঢেকে রাখতে চান। তিনি চান তার বান্দারা যেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে পবিত্র করার চেষ্টা করে আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। চলার পথে কিছু না কিছু ভুল-ত্রু টি হয়েই থাকে। এসব পাপের জন্য সব সময় তাওবা ও ইসতেগফার করা উচিত।
আমরা যদি আমাদের পাপ থেকে তাওবা ও ইসতেগফার করে থাকি তাহলে হয়তো আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন এবং আমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন।
ইস্তিগফার মানে হলো ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ তা‘আলা হলেন ‘গাফির’ ক্ষমাকারী, ‘গফুর’ ক্ষমাশীল, ‘গফফার’ সর্বাধিক ক্ষমাকারী। ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ একটি ইবাদত। ইস্তিগফার করার জন্য পূর্বে গুনাহ করা শর্ত নয়। ইস্তিগফার দ্বারা আল্লাহর নেয়ামতের দ্বার উন্মুক্ত হয় ও অবারিত রহমত বর্ষিত হয়। ইস্তিগফার শুধু অনুতাপ নয়, শোকরিয়া হিসেবেও করা হয়। মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ তা‘আলা প্রিয় নবী (সা.)-কে বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসে, দেখবেন লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দিনের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তখন আপনি আপনার রবের পবিত্রতা বর্ণনা করুন প্রশংসাসহ, আর তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন । নিশ্চয় তিনি সর্বাধিক তওবা কবুলকারী। (সরা নাসর ১-৩]
তাওবা অর্থ হলো ফিরে আসা। মানুষ যখন ভুল পথে যায় বা বিপথগামী হয়, তখন সেখান থেকে সঠিক পথে বা ভালো পথে ফিরে আসাকে তাওবা বলা হয়। তাওবার পারিভাষিক অর্থ হলো লজ্জিত হওয়া। অর্থাৎ স্বীয় কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে সঠিক পথে ফিরে আসা। তওবার জন্য করণীয় হলো, স্বীয় কৃতকর্মের প্রতি লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া, সেই অপরাধ আর না করার দৃঢ় প্রত্যয় ও সংকল্প গ্রহণ করা এবং নেক আমলের প্রতি বেশিমাত্রায় মনোযোগী হওয়া।
ইস্তিগফার ও তাওবা প্রায় জোড়া শব্দ হিসেবে দেখা যায়, যেমন: তওবা-ইস্তিগফার। কখনো কখনো দু’টি শব্দ সমার্থকও হয়।
মানুষ মাত্রই ভুল করে। কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ আল্লাহ শুধু মানুষ সৃষ্টি করেননি, মানুষকে পাপের দিকে ধাবিত করতে সৃষ্টি করেছেন শয়তান। সেই শয়তানকে কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের মধ্যে রক্ত চলাচলের মতো অবস্থান করে ওয়াসওয়াসা তথা কুমন্ত্রণা দেওয়ার শক্তি দান করেছেন। এ জন্য আমরা দেখি, আল্লাহর সৃষ্ট প্রথম মানুষ তথা আদম (আ.) শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে প্রথম ভুলটি করেন। অতঃপর আদম আ. নিজের অপরাধ স্বীকার করে তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেন। অন্যদিকে শয়তান আল্লাহর হুকুম অমান্য করে; কিন্তু সে নিজের ভুল স্বীকার না করার কারণে ফেরেশতার মর্যাদা থেকে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়। অর্থাৎ শয়তান আল্লাহর হুকুম অমান্য করেছে এবং আদম আ.ও আল্লাহর একটি হুকুম অমান্য করেছে। পার্থক্য হচ্ছে, শয়তান তাওবা না করে নিজের অপরাধের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে অভিশপ্ত হয়েছে; কিন্তু আদম (আ.) অপরাধ স্বীকার করে তাওবা ও ইস্তিগফার করার মাধ্যমে নিস্কৃতি লাভ করেন। এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, অপরাধ সবাই করে; তবে যে ব্যক্তি অপরাধ করার পর তওবা ও ইস্তিগফার করে, সে-ই উত্তম। মহানবী (সা.) এ কথাটিই বলেছেন, ‘প্রতিটি মানুষই অপরাধী আর সর্বোত্তম অপরাধী হচ্ছে তওবাকারী।’ [তিরিমিজি]
তাওবা ও ইস্তিগফার আল্লাহ তা‘আলার অতি পছন্দের একটি ইবাদত। আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।” [সূরা আল বাকারা : ২২২]
তাই প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিষ্পাপ হওয়া সত্তে¡ও প্রতিদিন ৭০ থেকে ১০০ বার তাওবা ও ইস্তিগফার করতেন। অনুরূপ ঈমানের পর নামাজ প্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হওয়া সত্তে¡ও এই নামাজ আদায়ের পর তিনবার ইস্তিগফার পড়া সুন্নত। অর্থাৎ ইস্তিগফার শুধু পাপের পরে নয়, ইবাদতের পরেও করা হয়।
মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তা‘আলার দরবারে বান্দার তাওবা অধিক পছন্দনীয়। কোন মানুষ অপরাধ করার পর যখন আল্লাহর কাছে তাওবা করে এবং তার দ্বারা সংঘটিত গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে অত্যধিক পছন্দ করেন, তার তাওবা কবুল করেন এবং তাওবার মাধ্যমে বান্দাকে পবিত্র করেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই মুমিনদেরকে তাওবা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে তাওবা [প্রত্যাবর্তন] কর, নিশ্চয় তোমরা সফলকাম হবে।” [সূরা নূর আয়াত: ৩১]
আর যারা তাওবা করে না, আল্লাহ তাদের জালেম বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,“ যারা তাওবা করবে না, তারাই অত্যাচারী।” [সূরা হুজুরাত : ১১]
উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের দু’টি ভাগে ভাগ করেছেন। এক- তাওবাকারী, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, তারাই সফলকাম। দ্বিতীয়- যারা তাওবা করে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারাই অত্যাচারী ও জালিম। এ দুই ভাগের মধ্যে কোনো তৃতীয় ভাগ নাই। আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, আমরা কোন ভাগের অন্তর্ভূক্ত হবো?
বান্দা যখন কোনো অপরাধ করে আল্লাহর নিকট ফিরে যায় এবং তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি অধিক খুশি হন।
আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দার তাওবায় ওই ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন, যে ব্যক্তি তার বাহন সাওয়ারী নিয়ে কোন জনমানব শূন্য প্রান্তরে অবস্থান করছিল, হঠাৎ তার সাওয়ারিটি পালিয়ে গেল। সাওয়ারিটির সাথে ছিল তার খাদ্য ও পানীয় বস্তু। লোকটি সাওয়ারিটি খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে তার ব্যাপারে হতাশ হয়ে একটি গাছের নিকট এসে তার ছায়ায় এসে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পেল তার সাওয়ারিটি তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে অধিক খুশিতে তার সাওয়ারির লাগাম চেপে ধরে বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা এবং আমি তোমার রব! লোকটি অধিক খুশিতে উল্টা-পাল্টা বলে ফেলল। [সহীহ মুসলিম]
রাসূল সা. যেভাবে তাওবা ও ইস্তিগফার নিজে করেছেন এবং আমাদের করতে বলেছেন আমরা তাঁর মতো করেই তাওবা ও ইস্তিগফার করতে পারি-
‘আসতাগফিরুল্লাহ’ “আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” প্রতি ওয়াক্তের ফরয সালাতে সালাম ফিরানোর পর রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দু‘আ ৩ বার পড়তেন। [মিশকাত-৯৬১]
‘আসতাগফিরুল্লাহ ওয়া আতূবু ইলাইহি’ “আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর দিকে ফিরে আসছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিদিন ৭০ বারের অধিক তাওবা ও ইসতিগফার করতেন।” [বুখারী :৬৩০৭] ‘আসতাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা-ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূম ওয়া আতূবু ইলাইহি’ “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন মা‘বূদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছে তাওবাহ্ করি।”
এই দূ‘আ পড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন-যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়নকারী হয়।” [আবু দাউদ-১৫১৭, তিরমিযী-৩৫৭৭, মিশকাত-২৩৫৩] ‘রাব্বিগ ফিরলী ওয়াতুব আলাইয়া ইন্নাকা আনতাত তাওয়া-বুর রাহীম’ “হে আমার রব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী করুণাময়।”
রাসূলুল্লাহ (সা.) মাসজিদে বসে এক বৈঠকেই এই দু‘আ ১০০ বার পড়েছেন। [আবূ দাঊদ-১৫১৬]
(সাইয়েদুল ইস্তিগফার-বা আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার শ্রেষ্ঠ দুআ : “হে আল্লাহ তুমিই আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারণ তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।”
এই দু‘আ সকালে পড়ে রাতের আগে মারা গেলে অথবা রাতে পড়ে সকালের আগে মারা গেলে সে জান্নাতে যাবে। [বুখারী-৬৩০৬]
এ সকল দু‘আ ছাড়াও কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ তা‘আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনার আরও বিভিন্ন দু‘আ বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো পড়ার চেষ্টা করতে হবে। এমনকি নিজের ভাষায় নিজের মত করে মহান আল্লাহর নিকট নিজের অপরাধগুলো তুলে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও তিনি ক্ষমা করবেন ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও ।” [সূরা নূর ২৪/৩১]
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকল অপরাধ মার্জনা করে তার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করে দিন। আমীন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন