সারাদেশ যখন করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সেখানে প্রতিনিয়ত সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ভেকু দিয়ে তিনটি পয়েন্টে পৌলী ও ঝিনাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী একটি মহল। সরকারীভাবে টাঙ্গাইল জেলা লকডাউন করা হলেও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই প্রতিদিন প্রায় কয়েকশত ট্রাক বালু বিক্রি করছে এই মহল। ফলে নদী পাড়ের মানুষ রয়েছে নানা শঙ্কায়। সেই সাথে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শহর রক্ষা বাঁধ।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভাধীন পৌলী রেল সেতুর পাশে এবং মহেলা লৌহজং নদীর তিনটি পয়েন্টে দীর্ঘদিন ধরে রাতের অন্ধকারে বালু উত্তোলন করে আসছে একদল প্রভাবশালী বালু খেকোরা। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় এই এলাকার আশপাশে বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। ইতোপূর্বে ভাঙ্গনে শতাধিক পরিবারের ভিটে-বাড়ি নদী গর্ভে চলে গেছে। দুই বছর আগে রেলসেতুর দু’পাশের এবং এপ্রোজ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ভোগান্তির শিকার হয় হাজার হাজার মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভাধীন পৌলী নদীর ওপর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মহাসড়ক ও রেল সেতুর অদূরে রাতের বেলায় দুটি ভেকু দিয়ে বালু কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। তারপাশেই মহেলা গ্রামের লৌহজং নদীর দুটি পয়েন্টে চারটি ভেকু দিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। আর এই তিনটি পয়েন্ট থেকে অসংখ্য ট্রাক ভর্তি মাটি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাইড রক্ষা বাঁধটিও রয়েছে হুমকির মুখে। পৌলী নদী ও লৌহজং নদী থেকে বালু উত্তোলনের পর তা ট্রাক দিয়ে এই গাইড রক্ষা বাঁধ দিয়েই চলাচলের ফলে বর্ষার আগে ব্যাপক ঝুকিঁতে রয়েছে বাধঁটি। সেই সাথে সাধারণ মানুষের চলাচলের এই সড়কটিতে অতিরিক্ত মাত্রায় ট্রাক চলাচলের কারনে প্রায় ৩ কিলোমিটার সড়ক চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই পুরো সড়কটি কাদাঁয় ভরে যায়। অপরদিকে বালু ভর্তি ট্রাক চলাচলের ফলে ওই এলাকার মানুষদের বাড়ি-ঘর ধুলা-বালুতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পৌলী নদীতে ভেকু বসিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে গ্যাস পাইপ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকে। এরআগে ভেকু বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে দুইবার তিতাস গ্যাসের মূল পাইপলাইন ফেটে ভেসে উঠে। এতে টাঙ্গাইল, গাজীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষকে পোহাতে হয়েছে চরম দুর্ভোগ। ওই সময় নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বেশ কিছুদিন বালু উত্তোলন ও বিক্রি বন্ধ থাকে। পরে পাইপলাইন মেরামত করা হলে পুনরায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে প্রভাবশালীরা। সম্প্রতি দিনের বেলায় বালু উত্তোলন করলে জেলা প্রশাসন থেকে ভেকু ধ্বংস করা হয়েছে। এরপর থেকে দিনের বেলায় বালু উত্তোলন বন্ধ থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত চলে এই বালু উত্তোলন। অপরদিকে করোনা ভাইরাসের কারনে টাঙ্গাইল লকডাউন থাকায় দিনের বেলায় ট্রাকে করে বালু বিক্রি বন্ধ রাখলেও সন্ধ্যার পর থেকে অবাধে চলে বালু বিক্রি। ফলে প্রতিদিন প্রায় কয়েকশত মানুষের আনাগোন হয় ওইসব এলাকায়। এর ফলে করোনা ভাইরাস আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী জানান, আমরা নদীপাড়ের মানুষ। সারা বছর এই নদী থেকে এলাকার প্রভাবশালী কিছু লোক বালু উত্তোলন করে। তাদের সাথে তো আর আমরা পারি না। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কথা তো আর কেউ শুনে না। আমরা একটা কথা বললে তারা আমাদের মারতে আসে, ভয় দেখায়। তাই কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাই না। আর যারা করবে তাদের নিয়েই তো এই বালুর ব্যবসা করে যাচ্ছে। এই বালু উত্তোলনের কারনে প্রতি বছর বর্ষায় আমাদের বাড়ি-ঘর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। যখন ভাঙ্গন দেখা দেয় তখন শুধু প্রশাসনের লোকজনকে দেখতে পাই। কিন্তু বর্ষার পর আর তাদের কাউকে দেখা যায় না। এরআগে অবশ্য প্রশাসনের লোকজন এসে ভেকু ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু তারপর দিনের বেলায় না করে রাতের বেলায় বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। এ নিয়ে প্রশাসনের কাছে বার বার বলাও পরও তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে তো আমাদের বাড়ি-ঘর, রেল সেতু, মহাসড়ক, শহড় রক্ষা বাঁধ সব কিছু ভাঙ্গনের কবলে পড়বে। আর আমাদের চলাচলের জন্য একটি মাত্র সড়ক এই বাঁধ। প্রতি বছর এ বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়। তার উপর আবার প্রতিদিন প্রায় কয়েকশত ট্রাক চলাচল করে। এই সড়কে চলাচল করা আমাদের জন্য দায় হয়ে পড়েছে। বাজার থেকে মালামাল নিয়ে আসতে সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি হলে কাদা হয়ে যায়। আবার শুকনো অবস্থায় ধুলা-বালু বাড়িতে ভরে যায়। আমাদের দৈনন্দিন কাজ করতে অনেক সমস্যা হয়। আর বর্তমানে করোনা ভাইরাসে আমরা এমনেই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। এরমধ্যে বিভিন্ন জায়গার মানুষ আমাদের এই গ্রামে প্রবেশ করে। এ নিয়ে প্রশাসনের কোন মাথা ব্যর্থা নেই। সবাই আরে সবার চিন্তা নিয়ে। আমাদের কথা চিন্তা করার সময় তাদের নেই।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক বালু ব্যবসায়ী জানায়, সরকারী ভাবে তো আর আমাদের বালু উত্তোলন করার অনুমতি দেয় না। সরকারী লোকদের ম্যানেজ করে আমরা এই বালু উত্তোলন করছি। দিনের বেলায় নানা সমস্যার কারনে আমরা রাতের বেলায় বালু উত্তোলন করি। বর্তমানে ৮ থেকে ১০ জন মিলে পৌলী ও লৌহজং নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এখানে অনেক মানুষ আসে। আমাদের সাথে কথা বলে আমরা তাদের খুশি করে দেই। তারা চলে যায়। আমাদের কোন সমস্যা হয় না।
বালু উত্তোলনের বিষয়ে কাদের, মনির, একাব্বর, হাবিলসহ অনান্যদের সাথে কথা হয়। তারা বলেন, আমরা নদী থেকে বালু উত্তোলন করি না। আমাদের জমি আছে সেই জমি থেকে আমরা বালু কাটি। আমাদের রেকর্ড করা জমি থেকেই আমরা বালু বিক্রি করি। আর নদীর পাড়ে অনেকের জমি আমরা কিনে নিয়েছি। সেই জমি থেকেই আমরা ভেকু দিয়ে বালু উত্তোলন করি। আর এ বিষয়ে ডিসি অফিসেসহ অনান্য অফিসে কাগজ পত্র জমা দেওয়া আছে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, পৌলী নদীতে বালু উত্তোলনের জন্য কাউকে অনুমতি দেয়া হয়নি। যারা রাতের বেলায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে তাদের নাম তালিকা করে বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হবে। বালু উত্তোলন বন্ধে আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু করা সম্ভব আমরা সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এছাড়াও যেসকল ব্যক্তি এই বালু ব্যবসায় জড়িত তাদের আইনের আতত্তায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে কালিহাতী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার রহমান বলেন, পৌলী নদী ও লৌহজং নদীতে ভেকু দিয়ে রাতের বেলায় একটি মহল বালু উত্তোলন করছে এমন একটি অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন