বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

রবীন্দ্র কবিতায় কল্পচিত্র

আ হ মে দ উ ল্লা হ্ | প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

বাংলা সাহিত্য মানেই রবীন্দ্রনাথ, একথা কেউ অস্বীকার করলে, গোয়াতুর্মি ব্যতিত আর কী হতে পারে? যিনি একাধারে কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, নাট্যকার, চিত্রকর, অভিনেতা, দার্শনিক, বিজ্ঞানীসহ এমন কোনো আলোকিত গুণ নেই যা রবীন্দ্রনাথের জীবনকে আলোকিত করেনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য পেয়েছে যুগোপযুগী আলোকিত গতিপথ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে, বাংলা সাহিত্যকে তিঁনিই নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এর আগেও পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এতটা সুদূরপ্রসারী করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

জোড়াসাঁকোর জমিদার বাড়ির ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ ভারতবর্ষকে আলোকিত করে জন্ম নিয়েছেন এই যুগস্রষ্টা মহামানব। ছোট্টবেলা থেকেই মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত কবি বড় হয়ে ওঠেন ঠাকুর বাড়ির চাকর-বাকরদের হাতে। যার ফলে শৈশব থেকে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে খোলা ফসলের মাঠ, নীল আকাশ, সবুজ ঘাস, দূরের গাছপালা, রাতের উজ্জ্বল চাঁদ ও তারাদের সাথে; এরাই যেন কবির আসল বন্ধু। প্রকৃতির সাথেই মন মিশিয়ে বেড়েওঠা ঠাকুর বাড়ির ওই শিশুটি পূর্ণবয়সে হয়ে ওঠে বিশ্বের সেরা কবি।
এই কীর্তিমান কবি ছিলেন সৌন্দর্যপূজারী, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধক। শুধু কবিতা নয়, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধসহ সাহিত্যের সব শাখাতেই কবির দক্ষতা ছিল আলোকোজ্জ্বল। যুগস্রষ্টা এই কবিই বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের জনক। এছাড়াও তিনি খুব উঁচু স্তরের একজন সংগীতজ্ঞ, সুরকার এবং অভিনেতাও ছিলেন। ভালো মানের ছবিও আঁকতে পারতেন তিনি। বিশেষ করে নিজের প্রতিকৃতিও তিঁনি অঙ্কন করেছেন অত্যন্ত নিঁখুতভাবে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সৌন্দর্য ও ভাব-গাম্ভীর্যতা তাঁকে এনে দিয়েছিল সাহিত্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল পুরস্কার; যা, তৎকালীন এশিয়া মহাদেশের সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার। বর্তমানে অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেও বাংলা সাহিত্যে অদ্যাবধি তিনিই একমাত্র নোবেল পুরস্কারের গৌরব ধরে রেখেছেন।
বিশ্বকবি ছিলেন সত্যের প্রতীক; অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন কঠিন ভাষায়। জালিয়ানওয়ালাবাগে যখন ব্রিটিশ সরকার নির্দয়ভাবে গুলি করে হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষকে হত্যা করে, ঠিক তখনই ওই অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি ব্রিটিশদের দেয়া ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেছিলেন এবং ব্রিটিশ বড়লাটের কাছে কঠিন প্রতিবাদী ভাষায় একখানা চিঠি লিখে ওই নারকীয় হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দ্রা এবং কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছিলেন।
দেশেপ্রেমের অনন্য উদাহরণ লক্ষ করা যায় কবির কবিতা ও ব্যক্তিগত জীবনেও। যে কালে ব্রিটিশ ভারতে সাহেবী পোশাক পরিধান করা রেওয়াজ ছিলো এদেশে। গণ্যমান্য লোকেরা সাহেবী পোশাক পরেই সভা-সমিতি, উৎসব অনুষ্ঠানে যেতেন কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম এতটাই আন্তরিক ও প্রখর ছিলেন যে, তিনি জাতীয় পোশাক পরেই সর্বত্র আসা-যাওয়া করতেন।
যুগে যুগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবরূপ রূপায়নে আমাদের জীবনকে ঐশ্বয্যমন্ডিত করেছেন। উজ্জ্বল করেছেন সমগ্র বাঙালির মুখ, সারাবিশ্বে। তাই তো তাঁর জন্মবার্ষিকীতে বাঙালিমাত্রই খুঁজে নেয় নিজ উৎসের মন্ত্ররূপটিকে। বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী কৃতজ্ঞতাভরে আবেগতাড়িত হয়ে গেয়ে ওঠে -
চির নতুনের দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।
ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বাংলাদেশে কবিগুরুর লেখা সংগীতই রাস্ট্রীয় জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অসংখ্য কবিতা, গানসহ বিভিন্ন রচনায় কবির দেশপ্রেম উজ্জ্বলভাবে বিকশিত হয়ে ওঠেছে, যা প্রাণে দেশপ্রেমের দ্যোতি বিকিরণ করে-
গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পর
আমার মন ভোলায় রে...
দেশপ্রেমসহ অন্যা বৈশিষ্টের পাশাপাশি রবীন্দ্রকবিতা চিত্রকল্প প্রয়োগে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন। সাহিত্যে সুদীর্ঘ কাল ধরে এই চিত্রকল্পের ব্যবহার হয়ে আসছে, তবে কল্পচিত্রের বিষয়টি কিছুটা ভিন্নতর। রবীন্দ্র সাহিত্যের পরতে পরতে চিত্রকল্পের সমাবেশ বেশ উজ্জ্বল তো বটেই, পাশাপাশি কল্পচিত্রেরও বহুমাত্রিক প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।
কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার অনেক পুরনো রীতি, যা ক্রমশ ম্রিয়িমান। চিত্রকল্প ছাড়া কেবল শব্দের সুষম বিন্যাসে কবিতা ঋদ্ধ হয় না বলেই সত্য; কিন্তু চিত্রকল্প এখন সাহিত্যের অন্যতম আলোচিত বিষয়বস্তু হিসেবে মূর্তমান হয়ে ওঠছে।
অনেকে বলে থাকেন- চিত্রকল্পই মূলত কবিতা; রং ও তুলির ব্যবহার ব্যতীত যেমন ছবি আঁকা অসম্ভব, তেমনি শুধু শব্দমালা দিয়ে চিত্রকল্প তৈরি করাও অসম্ভব, শব্দ বুনটের সাথে সংযুক্ত থাকতে হয় কবিহৃদয়ের গভীর অন্তর্দৃষ্টি, ভাবাবেগ ও ধীশক্তি। কিন্তু বর্তমানে চিত্রকল্পের স্থান দখল করে নিচ্ছে কল্পচিত্র।
চিত্রকল্পকে ইংরেজিতে বলা হয় strong mental picture। আরো অনেকভাবে বলা হয়, Image being a synonym for picture, images need not be only visual; any of the five senses (sight, hearing, touch, taste, smell) can respond to what a poet writes.
কবিরা তাঁদের মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা ভাবে ও ব্যঞ্জনায় ইচ্ছেমতো চিত্রকল্প তৈরি করে থাকেন। Ezra Pound-এর মতে, এই ওসধমব কোনো বুদ্ধিদীপ্ত বা ভাবোদ্দীপক জটিলতারই প্রকাশ।
তৎকালীন কবি ও সমালোচক Ezra Pound-এর নেতৃত্বে ১৯১৩ সালে একদল কবিগোষ্ঠী চিত্রকল্পবাদ শুরু করেন ইংলন্ডে। Imagery-র বা চিত্রকল্প সম্পর্কে যে লক্ষণগুলি পাশ্চাত্য তাত্তি¡করা চিহ্নিত করেছিলেন, তাতে চিত্রকল্প সম্পর্কে সম্যক ধারণা ব্যক্ত না করলেও বেশ ভালোভাবেই চিত্রকল্পবাদ বা Imagism এর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
বিশ শতকের প্রথম দিকে Poetry এবং Egoist- পত্রিকাকে কেন্দ্র করে T.E Hume, Ezra Pound, Amy Loel প্রমুখ কবিগণের স্বচেষ্টার ওসধমরংস একটি বড় ধরনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
দেবদাস জোয়ারদার চিত্রকল্পের সরাসরি সংজ্ঞা নির্দেশ না করেই এর স্বরূপ লক্ষণটি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তোমার সৃষ্টির পথ নামক গ্রন্থে রবীন্দ্রকবিতায় চিত্রকল্পের বৈচিত্র্য সম্পর্কে তিনি সূ²তার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বললেন- শুধু সাহিত্যের শব্দে নয়, প্রতিদিনের প্রতিজনের মুখে মুখর শব্দগুলির নেপথ্যে বাজে কবিত্বের অনেক নীরব সুর।
লুইস এর Picture made out of words এর থেকেও উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা চিত্রকল্পের অরো গভীরতর সৃষ্টিপ্রক্রিয়াকে জ্যোতির্ময় করে, যদিও লুইস বলেছেন চিত্রকল্প হবে charged with emotion or passion।
অমলেন্দু বসু বলেছেন- বাংলা নাম ইংরেজি নামের নিকটতম প্রতিশব্দ হওয়া একান্ত সঙ্গত। দ্বিতীয়ত, চিত্রকল্প শব্দটিতে কেবল একশ্রেণির Image-ই সূচিত হয়, যে Image, visual imagination দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে, যার ফলে কাব্যানুভূতির বাক্সময়রূপটি শুধু চিত্রধর্মী বলে মনে করা হয়েছে। অথচ কবিকল্পনার বাহন যে ভাষা, যে বাক্-মালা, তাতে দৃশ্যানুভূতি যেমন সম্ভব, শ্রবণানুভূতি, স্পর্শানুভূতি, স্বাদানুভূতিও তেমনি সম্ভব। অর্থাৎ কুশলী ভাষা প্রয়োগে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিই উদ্বুদ্ধ হতে পারে; অতএব Image অর্থে চিত্রকল্প শব্দটির প্রয়োগে Image ভাবনার প্রসারতা ও জটিলতা সংকীর্ণ ও পঙ্গু করে ফেলা হবে। এই বলে তিনি এর প্রতিশব্দ করেছেন বাক্প্রতিমা।
বাক্প্রতিমা কেন? এর কারণ নির্ণয়ে দেবদাস জোয়ারদার বলেছেন- ইন্দ্রিয়ানুভূতি থেকেই ওসধমব উৎসারিত হোক না কেন, তার অবলম্বন বাক্ বলেই যাবতীয় verbal Imageকে ডক্টর অমলেন্দু বসু বাক্প্রতিমা বলার পক্ষপাতী।
অধ্যাপক দেবদাস জোয়ারদার আরো লিখেছেন- কবি যখন এতকাল পর্যন্ত অননুভূত বা ক্বচিৎ কখনও অনুভূত সাদৃশ্য দেখতে পান তাঁর নিজের উপমেয়ের সঙ্গে বাইরের উপমানের, তখনই তাঁর চোখের এবং তার চেয়েও বেশি তাঁর মনের হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ওই চিত্রকল্প বাইরে ঝলমল করে ওঠে।
রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদ সূচনা হয় মূলত ১৯১২ সাল থেকে। ওই সময়ে Poetry পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি কবিতা। তাই অনুমান করা যায় যে Imagist-দের একটি দল রবীন্দ্রনাথকে সগোত্র বলেই মনে করেছিলেন; কিন্তু কেন এমনটা করেছিলেন? এমন তো নয় যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় খুব একটা চিত্রকল্প তারা দেখতে পেরেছিলেন।
আবার রবীন্দ্রনাথের দিক থেকেও বলা যায় চিত্রকল্পবাদ-এর বৈশিষ্ট্যসমূহকে লক্ষ রেখে তিনি কিন্তু গীতাঞ্জলি কাব্যটি রচনা করেননি। মুলত এই অন্তর্ভুক্তির ভিন্ন কোনো কারণ বা ইতিহাসও থাকতে পারে।
অনেকেই ধারণা করেন যে, Ezra Pound হয়তো ভুল করেছিলেন রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে! আসলে এমনটা নয়, কারণ গীতাঞ্জলির কবি সমগ্র রবীন্দ্র-কাব্যের নিরিখে fragmentary এবং এই জাতীয় কবিতায় সরাসরিই এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। ওই মিলের দিকটি তাদের মনে ধরেছিল। সেজন্য পরবর্তীকালে যখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর lyrics of love and life ছাপাতে থাকেন, তখন Ezra Pound সহ অন্যান্যরা তাদের স্বতঃসিদ্ধ ধারায় রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যান।
পক্ষান্তরে কবির কল্পনা জগত থেকে সৃষ্ট কোনো নতুন চিত্রকে কেন্দ্র করে সাবলীল শব্দ প্রয়োগের অন্ত্যমিল, মাত্রা-ছন্দ বিন্যাসে সৃষ্ট কবিতায় যে চিত্র বিকশিত হয়ে ওঠে তাকেও কল্পচিত্র হিসেবে ধরা যায়। যেমন- রবীন্দ্রনাথের পরশপাথর, সিন্ধুপাড়ে, স্পর্শমনিসহ আরো বহু কবিতায় অন্তর্দৃষ্টিতে তাকালে জীবনের রহস্যময় কতিপয় চরম সত্যের কল্পচিত্র বিকশিত হয়ে ওঠে। তবে, একথা বললে বোধহয় ভুল হবে না যে, কবিতার সকল বৈশিষ্ট্যে আলোকোজ্জ্বল রবীন্দ্রকাব্যে চিত্রকল্পের পাশাপাশি কল্পচিত্রও অনন্য বৈশিষ্ট্যে বিকাশমান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
শরিফুল ইসলাম ৩ জুলাই, ২০২০, ৯:৩৭ পিএম says : 0
একটাও উদাহরণ দিলেন না।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন