আবু তালহা সজীব
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে এ ইতিহাস মাত্র ১৫ বছরের হলেও উপমহাদেশের প্রাচীনতম উচ্চতর কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে এর ইতিহাস দীর্ঘ ৭৮ বছরের। কেন্দ্র করে মূলত উপমহাদেশের কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যাত্রা শুরু করে ১৫ জুলাই, ২০০১ সালে। ১৫ জুলাই ২০১৬তে ১৬ বছরে পদার্পণ করল এ বিদ্যাপিঠ। তবে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৬তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এমনকি গত বছরের প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতেও কোনো ধরনের অনুষ্ঠান করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ইতিহাসের পাতায় শেকৃবি : ১৯৩৮ সালের ১১ ডিসেম্বর শেরেবাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার প্রথম কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করেন। যার নাম দেয়া হয় দি বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। ইংল্যান্ডের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কারিকুলাম অনুসরণপূর্বক ১৯৪১ সালে ইনস্টিটিউটের একাডেমিক যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ জন মুসলমান ও ১০ জন হিন্দু ছাত্র নিয়ে বিএসসিএজি কোর্স শুরু হয়। এরা দুই বৎসর বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোতে লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিয়ে মেধা ভিত্তিতে বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটে গিয়ে ভর্তি হতে পারত। দুই বৎসর কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পড়ালেখা করে পরীক্ষায় পাসের পর কৃতী শিক্ষার্থীরা জেলা কৃষি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে চাকরি করতে পারত। এরাই ১৯৪৩ সালে বাংলার প্রথম কৃষি গ্র্যাজুয়েট। ১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষে আইএসসি পাসের পর ত্রিবার্ষিক বিএজি ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়। যদিও মৌলিক অনুষদের মর্যাদা তখনও অক্ষুণœœ থাকে। তার সাথে চার বৎসরের কোর্সটিও ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলে ১৯৪৮ সালে পুরাতন ও নতুন মিলে দুটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা একই বছরে ডিগ্রি পায়। ১৯৫১ সালে এমএজি কোর্স চালু করা হয়।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট, পাকিস্তান আমলে এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম রাখা হয় বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। তবে সর্বসাধারণের কাছে এটি ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিতি না পেয়ে ‘কৃষি কলেজ’ হিসেবেই খ্যাতি লাভ করে। এদেশের দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের অন্নের সংস্থান, কৃষি শিক্ষা, কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণে এ ইনস্টিটিউটের গ্র্যাজুয়েটগণই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অথচ এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত না করে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ১৯৬৪ সালে এ ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন সরকার বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটকে (বিএআই) স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ঘোষণা দিলেও ১৯৯০ সালে পরবর্তী সরকার তা বাতিল করে। ২০০১ সালের ৬ জানুয়ারি বিএআই হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেন এবং ৯ জুলাই, ২০০১ সালে সংসদে আইন পাস করে। ১৫ জুলাই, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ- এর বর্তমান সভাপতি ও অত্র প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র কৃষিবিদ আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম এমপি, মো. মহবুবউজ্জামানসহ বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট প্রাক্তন ছাত্র সমিতি ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন গ্র্যাজুয়েটদের নিরলস চেষ্টা ও অকৃত্রিম সেবার দ্বারাই বাংলাদেশের কৃষির উন্নতির ভিত্তিমূল রচিত হয়েছে। ১৯৪৩ সাল থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব গ্র্যাজুয়েট পাস করেছে মূলত তারাই সূচনা করেছে এদেশের কৃষি গবেষণা কার্যক্রমের। ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় এই প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটরা কৃষকের সাথে মিলেমিশে এদেশের কৃষিকে চলমান রেখেছিলেন যার ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। ’৫২- এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের সময় এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও গৌরবময়। জানা যায়, তৎকালীন সময়ে পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে ঢাকার ছাত্রনেতারা আশ্রয় নিতেন এ প্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের অংশগ্রহণও ছিল লক্ষণীয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদ, এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদ, অ্যানিম্যাল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ৩০টি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার জন্য রয়েছে পাঁচটি খামার। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে পাঁচটি হল রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ছেলেদের এবং দুটি মেয়েদের জন্য বরাদ্দ।
গবেষণাক্ষেত্রে অবদান :
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্ররা রিসার্চ সিস্টেম (সাউরেস) এবং ড. ওয়াজেদ মিয়া কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের মাধ্যমে গবেষণা করে নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। আর শেকৃবি বহিরাঙ্গন বিভাগ কৃষি প্রযুক্তি কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে সাউ সরিষা-১, সাউ সরিষা-২, সাউ সরিষা-৩, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আলুবীজ ও পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে সফলতা, টমেটো, টমাটিলো, রুকোলা, জামারুসান মূলা, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিভিন্ন বিদেশি ফুলের উৎপাদন সফলতা উল্লেখযোগ্য। এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র এএসএম কামাল উদ্দিন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিয়েছন অমৃত কলার চাষ। তিনি পেঁপে ও আনারসের লাগসই চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। ড. নূর মোহাম্মদ মিয়া ও ড. ছিদ্দিক আলীসহ অনেক কৃষিবিদ উচ্চ ফলনশীল ধান বিআর-৩, বিআর-৪, বিআর-১০, বিআর-১১, বিআর-১৪, বিআর-১৯, বিআর-২৩ জাত আবিষ্কার করে শুধু নিজ দেশে নয় প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, পশ্চিম আফ্রিকায় স্বীকৃতি পেয়েছেন। কাজী পেয়ারার জনক ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা এ বিশ্ববিদ্যালযেরই ছাত্র। ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা এবং ড. এসএম জামান নামে দুজন কৃষি বিজ্ঞানী বাংলাদেশ সরকারের ‘সায়েন্টিস্ট অ্যামিরিটস’ পদে ভূষিত হয়েছিলেন। অধিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে। আর এ নতুন নতুন জাত কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে কৃষিবিদরা, যার ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন