বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

কাতারে শ্রমিকদের প্রতি অন্যায় হচ্ছে : অ্যামনেস্টি

বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০২০, ১২:৩৪ পিএম

কাতারে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে নতুন নতুন সব স্টেডিয়াম ও অবকাঠামো নির্মাণের ধুম। তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশটি এ কাজ করতে গিয়ে এখন গলদঘর্ম। প্রায়ই শ্রম আইন লঙ্ঘন করা নিয়ে নেতিবাচক সংবাদের শিরোনামও হয়। বিশেষ করে, স্টেডিয়াম ও অবকাঠামো নির্মাণে যুক্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে শতভাগ সফল নয় তারা। ২০১৯ সালে দেশটিতে নয়জন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। কাতারি আয়োজক কমিটি অবশ্য দাবি করছে, টুর্নামেন্ট প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় তাদের কারো মৃত্যু হয়নি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে কাতারে ফিফা বিশ্বকাপের জন্য নির্মীয়মাণ স্টেডিয়ামে কর্মরত বহু শ্রমিক ৭ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। অনেককে আংশিক বেতন দেয়া হয়েছে। আবার বহু আছেন বেতনই পান নি। এ অবস্থায় তারা সেখানে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে সৌদি আরবের সরকারি সংবাদ মাধ্যম অনলাইন সৌদি গেজেট। এতে বলা হয়েছে, কাতার মেটা কোটস (কিউএমসি) নামের একটি কোম্পানির প্রায় ১০০ শ্রমিক আল খোর শহরে ৬৮ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডের প্রকল্পে ৬০ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আল বায়্যিত স্টেডিয়াম নির্মাণ করছেন। এসব শ্রমিক এখনও তাদের পুরো মজুরির অপেক্ষায় আছেন।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার স্বাগতিক দেশ কাতার।

এ জন্য তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্টেডিয়াম নির্মাণ করছে। এসব নির্মাণে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকও কাজ করছেন। ওই স্টেডিয়ামের মধ্যে আল বায়্যিত স্টেডিয়াম অন্যতম। কাতারে এসব স্টেডিয়ামকে বলা হচ্ছে ‘ক্রাউন জুয়েলস’। ধারণা করা হচ্ছে, এই আল বায়্যিত স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনাল হতে পারে। কিন্তু সেখানে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করার মতো এত কঠিন বিষয় গত মাস নাগাদ ফিফার পরিচালনা পরিষদ জানতোই না।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, তারা কিউএমসির বর্তমান ও সাবেক কর্মচারীদের সাক্ষাতকার নিয়েছে। আদালতের রেকর্ডগুলো এবং চুক্তির বিষয়ে পর্যালোচনা করেছে। অ্যামনেস্টি দেখেছে, কর্মরতদের আবাসিক পারমিট নবায়নে কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে কিউএমসি। এর মাধ্যমে তাদেরকে আটক ও দেশছাড়া করার হুমকিতে ফেলেছে তারা। আটক এসব মানুষ এখন দোহা’য় গাদাগাদি করে রাখা শিবিরে অবস্থান করছেন। সেখানে তাদেরকে খাবার সরবরাহ দিচ্ছে কিউএমসি।
অ্যামনেস্টি বলেছে, তারা কাতার কর্তৃপক্ষ, ফিফা এবং কাতার বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগ্যাসের কাছে কিউএমসির বিষয়টি উত্থাপন করার পর কিছু শ্রমিক তাদের পাওনার অংশ পেতে শুরু করেছেন। তবে তারা এখনও বকেয়া বেতনের পুরোটা পান নি। এই অনুসন্ধানের জবাবে ফিফা বলেছে, অ্যামনেস্টির অনুসন্ধানের পর তারা বিষয়টি অবগত হয়েছে এবং কাতারের সুপ্রিম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আরো বলেছে, কাতারে তাদের অংশীদার যারা আছেন, তারা এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন, যাতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হয়।

কর্মরত শ্রমিকরা অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, বেতন বিলম্বিত করার ফলে আল বায়্যিত স্টেডিয়ামের সব কর্মীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ঘানা, কেনিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন ও অন্য দেশের মোট প্রায় ১০০ অভিবাসী শ্রমিক। বেতন বিলম্বিত করা শুরু হয় ২০১৯ সালের শুরুতে। তারপর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের মার্চের শেষ নাগাদ কোনো বেতনই পান নি কিউএমসির শ্রমিকরা। কোনো কোনো বেতন আগস্টের শুরু পর্যন্তও বন্ধ করে রাখা হয়।
জানুয়ারিতে বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় বার বার। এর ফলে কিছু শ্রমিক কাতারের লেবার কোর্টে মামলা করে দেন। কিন্তু এরই মধ্যে এ সমস্যা সমাধানে সম্মত হয় কিউএমসির প্রতিনিধিরা। কিন্তু তারা কথা রাখেন নি। অন্য শ্রমিকদের বলা হয়, যদি তারা আগেভাগে তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ করতে এবং দেশে ফিরে যেতে রাজি হন, তবেই তাদের বেতন দেয়া হবে। কিছু শ্রমিক বলেছেন, তাদেরকে কাজে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হতে পারে, তাদের চুক্তি আগেভাগে শেষ করে দেয়ার অজুহাত খোঁজা।

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে আল বায়্যিত স্টেডিয়াম থেকে বাকি সব শ্রমিককে সরিয়ে নেয় কিউএমসি। তাদেরকে বলা হয়, তাদের ফ্যাক্টরিতে রিপোর্ট করতে, যেখানে অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের মতো জিনিসপত্র তৈরি ও ফিনিশিং কাজ করা হয়। ২২ শে মার্চ পর্যন্ত বেতন ছাড়াই এসব শ্রমিক সেখানে অব্যাহতভাবে কাজ করতে বাধ্য হন। ২২ শে মার্চে করোনা ভাইরাসের কারণে ওই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

অ্যামনেস্টিকে কাতারের সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগ্যাসি বলেছে, তারা ২০১৯ সালের জুলাইয়ে অডিট সাক্ষাতকারের সময় শ্রমিকদের কাছ থেকে কিউএমসির সমস্যা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে। তারপর থেকে তারা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিষদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ভবিষ্যত কন্ট্রাক্টের ক্ষেত্রে তাদেরকে ব্লাকলিস্টেড করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের সম্পর্কে শ্রম মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও কিউএমসি শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ পাওনা পরিশোধ করে নি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কমিটি এবং অন্যদের সঙ্গে প্রায় এক বছর দেনদরবার করে অ্যামনেস্টি। তাতে কমিটি অ্যামনেস্টিকে জানায়, শ্রমিকদের বেতন শিগগিরই দেয়া হবে। কিন্তু ৭ই জুন শ্রমিকরা অ্যামনেস্টিকে নিশ্চিত করেন যে, তারা তাদের পাওনার কিছু অংশ পেয়েছেন। যদিও সবাই পাওনা পান নি। এ অবস্থায় অ্যামনেস্টির কাছে লিখিতভাবে কিউএমসি জানায়, আর্থিক জটিলতার কারণে বেতন পরিশোধ করা বিলম্বিত হচ্ছে। তারা এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। এ নিয়ে কাতারের শ্রম মন্ত্রণালয়কে লিখেছে অ্যামনেস্টি। কিন্তু তার কোনো জবাব পায়নি অ্যামনেস্টি।

২০১৮ সালে দুর্ঘটনায় একজন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আল-জানুব স্টেডিয়ামে অনেক উপর থেকে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। এছাড়া নির্মাণকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ১০ জনের মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে ২০১৮ সালে।

কাতারের ২৭ লাখ ৫০ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ৯০ শতাংশই বিদেশী! তারা বিশ্বকাপের নির্মাণকাজের জন্যই মূলত বিভিন্ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে যান। এসব বিদেশীর মধ্যে অন্তত ২৬ হাজার মানুষ বিশ্বকাপ অবকাঠামো নির্মাণে সরাসরি যুক্ত।
কমিটি ওয়েলফেয়ার রিপোর্ট বলছে, ২০১৯ সালের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনায় তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়, আহত হন অন্তত ১১ জন। এছাড়া ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একজন তুর্কি কাঠমিস্ত্রি মারা যান হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, জুনে ২৭ বছর বয়সী এক নেপালি মারা যান হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে, অক্টোবরে আরেক নেপালি কাতারে যাওয়ার পাঁচদিন পর আত্মহত্যা করেন।

গত বছর ৫৪ বছর বয়সী এক ভারতীয় ইলেকট্রিশিয়ানের মৃত্যু হয় হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। এক মাস পর টিবিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৩৫ বছর বয়সী এক নেপালি, আর ডিসেম্বরে নিজের মেসে মৃত্যুবরণ করেন ২১ বছর বয়সী এক ভারতীয়। কার্ডিওলজি জার্নালের এক সমীক্ষা বলছে, কার্ডিওভাস্কুলার সম্পর্কিত কারণেই ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে কাতারে অন্তত ১৩০০ নেপালির মৃত্যু হয়েছে! এএফপি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন