রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে প্রতিদিন বিকালের পর কাঁচপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় বিরতিহীন সার্ভিসের কিছু মিনি বাস। নির্ধারিত ভাড়া ২০ টাকা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এখন ভাড়া হয়েছে দ্বিগুণ। এসব বাসের নেই রুটপারমিট ও ফিটনেস সার্টিফিকেট। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে থেকেও এরকম বাস সার্ভিস আছে কাঁচপুর, মদনপুর পর্যন্ত যাওয়ার। এগুলোরও রুটপারমিট এবং ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। অথচ পুলিশের নাকের ডগায় এগুলো নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারি বাসের মধ্যে বেশিরভাগ কোম্পানীতেই রয়েছে পুরাতন লক্কর ঝক্কর মার্কা বাস ও মিনিবাস। এসবের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। আবার যেগুলোর আছে সেগুলো ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য নয়। বিআরটিএ-এর সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট নেয়া হয়েছে। শুধু বাস মিনিবাস নয়, ঢাকায় চলাচলকারি ট্রেম্পু, হিউম্যান হলার, অ্যাম্বুলেন্স, পিকাপভ্যান, মিনি ট্রাকসহ হাজার হাজার যানবাহন চলছে ফিটনেস ছাড়াই। গুলিস্তান থেকে নয়াবাজার হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত চলাচলকারি হিউম্যান হলারের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, এগুলোর আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে বহু আগেই। গাড়ির নম্বর প্লেট তো দূরে থাক, নম্বর প্লেট ঝুলানের মতো অবস্থাও নেই বডিতে। মতিঝিল- গুলিস্তান থেকে মিরপুর ১২ পর্যন্ত চলাচলকারী বিকল্প অটো সার্ভিস, নিউ ভিশন, ইটিসি ট্রান্সপোর্ট, হাজী ট্রান্সপোর্ট, হিমাচল, খাজাবাবা পরিবহন, রানওয়ে একপ্রেস, স্বাধীন এক্সপ্রেস, শিকড় পরিবহন, সময় পরিবহন, মিরপুর ইউনাইটেড সার্ভিস ও বিহঙ্গ পরিবহনের বেশিরভাগ বাসই পুরাতন লক্কর ছক্কর মার্কা। শুধু মতিঝিল-মিরপুর রুটে নয়, রাজধানীর শতাধিক রুটে চলাচলকারি বাসগুলোর অবস্থা একই রকম। যাত্রীদের অভিযোগ, এসব বাসের বেশিরভাগই চলাচলের অযোগ্য। বৃষ্টি এলে ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। জানালায় কাঁচ নেই। কাঁচ থাকলেও সেগুলো খোলে না। বসার সীটগুলো নড়বড়ে। হাতে ধরার রড নড়াচড়া করে। যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কায় শক্ত করে ধরতেও ভয় লাগে। দরজাগুলো ভাঙ্গা আরও কতো কি? তারপরেও বাসগুলো চলছে। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, এসব বাসের বেশিরভাগই অতি পুরাতন। যে কোনো সময় এগুলো নিষিদ্ধ হতে পারে এই ভাবনা থেকেই মালিকপক্ষ এগুলোর ফিটনেস করায় নি। ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে এভাবেই বছরের পর বছর চলছে এগুলো।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ২৫ ধারা অনুযায়ী যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেক গাড়িরই ফিটনেস নবায়ন করা হয় না। ১০ বছর অতিক্রম হয়েছে, নবায়নবিহীন অবস্থায় চলছে এমন গাড়ির নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিএ। ভুক্তভোগিদের প্রশ্ন তারপরেও কি এসব বাস চলাচল বন্ধ হবে? পুলিশ বলছে, নিবন্ধন বাতিল হলে সেই বাস আর কোনোভাবেই চলাচল করতে পারবে না। করতে দেয়া হবে না।
বিআরটিএ-এর কর্মকর্তারা জানান, আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। এ জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর আগেও নবায়নের জন্য দফায় দফায় সুযোগ দিয়েছে বিআরটিএ। পরিবহন মালিকদের চাপে জরিমানা মওকুফ করেও নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয় একাধিকবার। এরপরও ফিটনেস নবায়ন না করায় স্থায়ীভাবে নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআরটিএ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ইনকিলাবকে বলেন, করোনা সংক্রমণের মধ্যে ফিটনেস করার সময়টা আরও বাড়ানো উচিত। এখন তো বিআরটিএ-এর অফিসও পুরোদমে চালু হয়নি। সেখানে ভিড় লেগেই আছে। আর ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য গাড়ি মেরামত করতে হয়। এখন মেকানিক পাওয়া যাচ্ছে না। মালিকরা আছে আতঙ্কের মধ্যে। আমরা চাচ্ছি করোনার জন্য যে সময়টা নষ্ট হয়েছে সে সময় মানে আরও অন্তত তিনমাস যাতে সময় বাড়ানো হয়। তা না হলে মালিকরা একেবারে পথে বসবে। তবে বিআরটিএ পরিচালক (অপারেশন) সীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করার জন্য একাধিকবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
বিআরটিএ-এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১০ বছরের অধিক সময় ফিটনেসবিহীন সারাদেশে এমন গাড়ির সংখ্যা ৫৬ হাজারের বেশি। দেশে মোট ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪টি। এর মধ্যে বাস ১৩ হাজার ৮৯০, কার্গোভ্যান ১৫৪৪, কাভার্ডভ্যান ৫ হাজার ৫৮৯, ডেলিভারি ভ্যান ৭ হাজার ৫৭, হিউম্যান হলার ১৩ হাজার ৫৪৬, জিপ ৯ হাজার ৬৬০, মাইক্রোবাস ২১ হাজার ৭৮৭, মিনিবাস ৮ হাজার ৭৪৮, পিকআপ ৪৯ হাজার ৮০৮, ট্রাক ৫১ হাজার ৫৭৫, প্রাইভেট কার ৪৬ হাজার ১৩৩, ট্যাক্সিক্যাব ১৬ হাজার ৯৪৫ এবং অটোরিকশা ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৫৭টি। এ ছাড়াও ট্যাঙ্কার, ট্রাক্টর, অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে।
এদিকে গাড়ির ফিটনেস নবায়নের ব্যাপারেও পরিবর্তন এসেছে। আগে নিবন্ধিত কার্যালয়ে গাড়ি নিয়ে নবায়ন করাতে হতো। এখন বিআরটিএর যে কোনো সার্কেল অফিসে নিলেই গাড়ির ফিটনেস করা যায়। সরকারের নতুন আইন অনুযায়ী, ফিটনেস খেলাপি হলে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৬ মাসের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। ফিটনেস সনদ দিতে হলে সংশ্লিষ্ট যানবাহন কারিগরি ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। খতিয়ে দেখতে হয় গাড়ির ৬০টি দিক। এর মধ্যে রয়েছে ইঞ্জিন অ্যাসেম্বলি (পাওয়ার ইউনিট), ধোঁয়া নির্গমনের অবস্থা, গাড়ির ভেতর ও বাইরের খুঁটিনাটি সব দিক, চালকের নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের মান, স্টিয়ারিং ও ব্রেক সিস্টেমের ধরন এবং মান, ব্রেক সিস্টেমের সব দিক, ইঞ্জিন ও চেসিসের অবস্থান ও মান, সব ধরনের বাতির কার্যকারিতা, মিটার, ইন্ডিকেটর, এক্সেল লোড, পাওয়ার স্টিয়ারিং। এসব পরিদর্শনের কাজ শেষ করার পর মেলার কথা ফিটনেস সনদ। কিন্তু চোখের দেখায় অল্প সময়ের মধ্যেই ফিটনেসের বৈধতা পাওয়ার অভিযোগ আছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ৫টি ভেহিক্যাল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে চালুর আগেই সব কটি অচল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে একটি পুনরায় মেরামত করে একমাত্র মিরপুর অফিসে চালু করা হয়। বাণিজ্যিক পরিবহন যাচাইয়ের কাজটি করে এই ভিআইসি। আর ব্যক্তিগত ও হালকা যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় খালি চোখে। ভিআইসিতে পরিদর্শনের ধাপে চার ধরনের পরীক্ষা হয়। ওজন স্কেলে ‘এক্সেল লোড’ পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় টায়ারের ঘনত্ব। এরপর পরীক্ষা করা হয় গতি। সবশেষে গাড়ির গতিরোধক বা ব্রেক পরীক্ষা করা হয়। পরিদর্শন ধাপটি শেষ করতে অন্তত ১৮-২০ মিনিট লাগার কথা। ক্ষেত্রবিশেষে এক মিনিটেই শেষ হয় যাচাইপর্ব। তা ছাড়া নবায়নের ফি দেওয়াই এখন গাড়ির ফিটনেসের অন্যতম মানদন্ড হিসেবে বিবেচ্য।
এসব বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের বলেন, পুরাতন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার সাথে সাথে নতুন গাড়ি যাতে নামানো হয় সে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে পরিবহন সঙ্কটে ভুগবেন সাধারণ যাত্রীরা। যতো ভাল বাস সার্ভিস চালু করা যাবে প্রাইভেট কারের সংখ্যা ততোই কমবে। এতে করে যানজট অনেকটাই কমে আসবে। তিনি বলেন, কিছু কিছু রুটে লক্কর ঝক্কর মার্কা হিউম্যান হলার চলছে। ওই সব রুটে উন্নতমানের বাস সার্ভিস চালু করলে যাত্রীসেবার মান যেমন বাড়বে, তেমনি ভোগান্তিও কমবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন