রুট পারমিট ও ফিটনেসবিহীন এবং এক রুটের পারমিট নিয়ে অন্য রুটে চলাচলকারী বাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত যৌথ অভিযান নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে। অভিযোগের ভিত্তিতে এসব বাসের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হচ্ছে। ভাড়ার তালিকা না থাকা, মেয়াদউত্তীর্ণ ট্যাক্স টোকেন, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর অপরাধে বাসচালকের বিরুদ্ধে এবং আসন সংখ্যা পুনর্বিন্যাসসহ অন্যান্য অপরাধে জরিমানা আদায় করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবুও কমছে না ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা।
এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় স্বপন কুমার সরকার (৬২) নামে একজন নিহত হয়েছেন। রাজধানী সুপার মার্কেটের পাশে এ ঘটনায় ঘটে। সকালে রাজধানী সুপার মার্কেটের পাশে দিয়ে স্বপন কুমার রিকশায় করে যাচ্ছিলেন। এ সময় ডিএসসিসির একটি ময়লার গাড়ি রিকশায় ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। কয়েকজন পথচারী জানান, ডিএসসিসি যে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় স্বপন কুমার সরকার নিহত হয়েছেন সেই গাড়িরও ফিটনেস ছিলো কিনা তাতেও সন্দেহ। ঘটনার পর পরই চালক পালিয়ে যান।
ওয়ারী থানার ডিউটি অফিসার উজ্জ্বল হোসেন জানান, সকালে মার্কেটের সামনের রাস্তায় মৃত অবস্থায় পরে ছিল ওই ব্যক্তি। পরে খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। নিহত ব্যক্তির বাসা গেন্ডারিয়ায় বলেও জানা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে তিনি জানান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মারা যান ওই ব্যক্তি। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছি। ফুটেজ দেখে ঘাতক চালকের পরিচয় শনাক্ত করে তাকে আটকের চেষ্টা করছে।
এর আগে, গত ২৪ নভেম্বর নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির চাপায় মারা যায়। এরপরের দিন ২৫ নভেম্বর পান্থপথে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেলে থাকা যাত্রী আহসান কবির খান মারা যায়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব গাড়ির মালিকদের অর্থদণ্ড করা হচ্ছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে অন্তত পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৭৭টি। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন গাড়ি ছিল চার লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ২৬ জানুয়ারি এ তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন জাতীয় সংসদে। অর্থাৎ প্রায় এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বেড়েছে ৫৯ হাজার ৪৮টি। ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকদের খুদে বার্তা বা এসএমএসের মাধ্যমে ফিটনেস হালনাগাদের জন্য নিয়মিত তাগাদা দেয়া হচ্ছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড, ডাম্পিংসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারপরও মালিকদের একটি বড় অংশ বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। গাড়ির মালিকদের একটি অংশ নিয়মিতভাবে কর দিচ্ছেন না।
১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ফিটনেসবিহীন মোটরযান ধ্বংস বা চিরতরে ব্যবহারের অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করছে বিআরটিএ। এসব মোটরযানের নিবন্ধন বাতিলের কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। কিন্তু দেশে গত এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। কর মওকুফের পরও মালিকরা গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করছেন না। এসব গাড়িতে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। বারবার অভিযানে নেমেও কমছে না এ ধরনের গাড়ির সংখ্যা। ২০১২ সালের এপ্রিলে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কমিটির সভায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৩ সালের জুনে কমিটির সভায় তিন মাসের মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ি অপসারণের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এসব কেবল ঘোষণাতেই আটকে আছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আগামী ২৬ ডিসেম্বর চালু হতে যাওয়া বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রমে পরীক্ষামূলক যাত্রাপথে সূচনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আমাদের যে সকল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন ছিল উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সে কাজগুলো সম্পন্ন করছি। আশা করি, আগামী ২০২২ সালের মাধ্যেই এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে ঢাকাবাসী এর যথাযথ সুফল পাবে। গত বুধবার নগরীর শংকরে পথচারী পারাপার সেতুর উদ্বোধন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, আগামী ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরীতে বহুল প্রতীক্ষিত বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রমের প্রথম পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হচ্ছে। সে লক্ষ্যে অভিযান জোরদার করেছি। পরীক্ষামূলক যাত্রার নির্ধারিত রুটসহ অন্যান্য রুটে রুট পারমিটবিহীন, ফিটনেসবিহীন এবং এক পারমিট নিয়ে অন্য রুটে পরিচালনা করা বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান থাকবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর অন্যান্য কারণের মধ্যে ছিল ৬৬ হাজার ৬৬১টি অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন) গাড়ি। এখনও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এটি।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সম্প্রতি এ সংক্রান্ত আদেশপত্র জারি করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, কোনো মোটরযান পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বিআরটিএ’র কোনো সার্কেল অফিস থেকে যাতে ফিটনেস সনদ দেয়া না হয়। মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেয়ার প্রতিবেদন কমিটিকে নিয়মিতভাবে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করতে হবে।
ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ফিটনেসবিহীন কিছু গাড়ির কারণে রাস্তায় অন্য গাড়িরও চলাচল করতে সমস্যা হয়। কোনো গাড়ির ফিটনেস না থাকলে ওই গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা-জরিমানা আদায় করছি। এমনকি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাস চালক ও মালিকদের একচেটিয়া দৌরাত্ম্যের করণে এই নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। পুরোনো ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। এটা বন্ধ করতে হবে। তা নাহলে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা থামানো যাবে না। বিআরটিএও দ্বায় এড়াতে পারে না। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন