করোনাকালীন সময়ে সর্বত্রই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ও সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত নির্দিষ্ট তিন ফুট বা তদূর্ধ্ব দূরত্বে থেকে সেবা গ্রহণ-প্রদানের ধারণাটি শুধু রাস্তায়, দোকানে, ঔষধালয়ে, হাসপাতালে, গাড়িতে, ব্যাংকেই না, বরং মানুষের মনেও নিগূঢ়ভাবে দাগ কেটেছে। এই দাগকেই উপজীব্য করে, দূরত্বকেই মূল ভিত্তি ধরে, প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় আমরা ক্রমশঃ অভ্যস্থ হয়ে উঠার প্রচেষ্টায় একাট্টা হচ্ছি জীবন-জীবিকার তাগিদে। যদিও এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতি অনেকের জীবনে শুধুই প্রথম নয়, হলফ করে বলা যায় বিরলও বটে। এর ফলে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি আর্থিকখাতেও অনলাইন বা ডিজিটাল পরিষেবার চর্চা ত্বরান্বিত হচ্ছে সর্ববয়সীদের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ডিজিটাল ব্যবস্থায় অর্থ প্রেরণ ও গ্রহণ আরও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, স্থান-কাল-পাত্র-কৌলিন্য-সৌম্য নির্বিশেষে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সময় সময় প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে লেনদেনের সীমার পরিমাণ যুক্তিসঙ্গতার নিরিখে হ্রাস-বৃদ্ধি করছে, যাতে বিশেষ শ্রেণির ভোক্তাগণকে মূল ব্যাংকিং ধারার বলয়ে আবৃত করা যায়। ব্যাংকগুলোর বিকল্প পরিষেবাসমূহের মধ্যে ‘ডেবিট’ ও ‘ক্রেডিট’ কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকের কেনাকাটা, বিল পরিশোধ, খাওয়া-দাওয়ার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ সময়ে বা উৎসবের প্রাক্কালে মূল্যহ্রাস বা ছাড়ের ছড়াছড়িতে ভোক্তাক‚লেরা মোটামুটি অভ্যস্থ, এক্ষেত্রে ব্যক্তি কেন্দ্রিক ভোক্তা সেবায় প্রাধান্যপুষ্ট ব্যাংকগুলোর পরিষেবা সত্যিই নতুন ধারার প্রবর্তক। আপতকালীন সময়ের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাবে, প্রযুক্তি নির্ভর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিভিন্ন অন্তর্জাল নির্ভর সেবার পরিধি ও ব্যাপ্তির প্রসার বর্তমানে চোখে পড়ার মতো। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের চেক বিহীন অয়্যার ট্রান্সফারে অর্থ স্থানান্তরের ইএফটিএন-এর দু’টো সেশন এবং আরটিজিএস-এর পাঁচটি মুদ্রার লেনদেন ছাড়াও ভবিষ্যতের লেনদেনা নিরবিচ্ছিন্ন রাখার উদ্দ্যেশ্যেই ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের ব্যবস্থার এক বাস্তব ও যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে আন্তঃব্যাংকিং লেনদেন নিষ্পত্তিকল্পে এনপিএসবি’র সদস্য হতে প্রেষণা দিচ্ছে।
এতদবিষয়ে বিভিন্ন দেশীয় প্রতিথযশা পত্রিকা, অন্তর্জালের পত্রিকা বা ব্লু মবার্গ’র প্রযুক্তি পরিষেবা ব্যবহারকারীদের রেখ-চিত্রের উল্লম্ফন আরও নতুন ভোক্তাদের আকৃষ্ট করছে, যা স্বল্প ও বিনে প্রচারে সেবা গ্রহণেচ্ছু নতুন গ্রাহককে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেহেতু আমরা বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারকারী হিসেবে পূর্বের সকল রেকর্ড ডিঙ্গিয়ে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, তাই মুঠোফোনের ক্লাউড সেবা বা মুখ চিহ্নিতকরণের ইত্যাদি বিষয়ে কিছুটা হলেও প্রযুক্তি ধারণাসম্পন্ন। যা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বিগ ডেইটা প্রস্তুতের চারণক্ষেত্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-কেওয়াইসি’র নীতি অতীব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নতুন যুগে আর্থিক ব্যবস্থাপনার এক অনন্য মাইলফলক হিসেবে ব্যাংকিং খাতে বিবেচিত হবে। এখানে বর্ণিত প্রযুক্তির সহায়তায় আর্থিক পরিষেবার বিভিন্ন মাধ্যম সম্পর্কে সু-স্পষ্ট ধারণা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা ইত্যবসরে কিছু কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাস্তবে রূপ দিয়ে নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে ফিনটেক বা অর্থ-প্রযুক্তি অত্যন্ত চর্চিত বা উচ্চারিত বিষয়। বিশেষ করে বিভিন্ন লেনদেনের দ্বার সংযোজন বা একীভ‚তকরণে ব্যাংকগুলোকে আরও স্পল্প সময়ে, সঠিক প্রযুক্তিতে, উচ্চ জবাবদিহিমূলকভাবে, সর্বাধিক সংখ্যক গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করা যায়। আর এটা অপেক্ষাকৃত কম খরচ ও কম মানবসম্পদ ব্যবহার করেই করা সম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশে বিশ্বে পরিচিত ফিনটেক’র কিছু পরিষেবা পাওয়ার ব্যাপারে আরও কিছুদিন হয়ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এখনই ঐ সকল সেবা বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত নয় তন্মধ্যে বিট কয়েন, ক্রিপ্টো কারেন্সি অন্যতম। তাছাড়া, ডেইটা মাইনারের অপ্রতুলতাও অন্যতম কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। তবে এই সকল সময়োপযোগী বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা সত্যিকার অর্থেই আশা-জাগানিয়া। অর্থ-প্রযুক্তির এক অনন্য পরিষেবা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস ব্যাংকিং আর্থিকসেবা ব্যবস্থার এক নতুন দিগন্ত বা চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। মাত্র সাত বছরেই গ্রাহক সংখ্যা ও সেবার বহুমুখিতা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। পরিষেবাটির নতুনত্ব ও সহজীকরণের জন্য। এখনতো কিউআর কোড ব্যবহার করেই ছবির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত সহজেই লেনদেন করা যায়, এটাই হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহারের বেগময়তা ও সঠিকতার সম্মিলন। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব সহজেই গ্রাহকক‚লের লেনদেনের ধারা, ইতিহাস, পছন্দের বিগ ডেইটা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট গ্রাহক-শ্রেণি-বয়স ভিত্তিক নতুন অভিনব সেবাপণ্যের বিপণনের দ্বার উন্মুক্ত করতে সচেষ্ট হবে। সম্পূরকভাবে, টেকফিন নামে আরেকটি বিষয়ে বৈশি^ক আর্থিক অঙ্গনে সমহারে আলোচিত ইস্যু এবং আর্থিক খাতের জন্য ঝুঁকিও বটে, যেখানে ফেইসবুক, গুগল, হোয়াটস অ্যাপস, আলিবাবা ইত্যাদি মহিরূহসম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সেবা দিতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা ও পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে তাদের গ্রাহকগণের তথ্য, জীবন-বৃত্তান্ত, ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা ইত্যাদির বিশাল তথ্য ভান্ডার, যা সত্যিই সমুদ্রসম তথ্য উপাত্তের সম্ভার বিশ্লেষণ করেই কাজে লাগাতে হয়।
তবে এটাও সত্য যে, আর্থিক পরিষেবায় প্রযুক্তি ব্যবহারের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়, যাতে করে অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত প্রতিক‚লতা বা প্রতিবন্ধকতা যথাসম্ভব এড়ানো সম্ভব হয়। এইক্ষেত্রে অত্যন্ত চৌকস মানব সম্পদের সহায়তা নিতে হবে, যাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাস্তব জ্ঞান ও প্রযুক্তিবান্ধব হিসেবে চিহ্নিত ও পরিগণিত। এমতাবস্থায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। অন্যথায় অন্তর্জালের চৌর্যবৃত্তির প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রতিষ্ঠানের অর্জিত সুনামের সাথে সাথে আর্থিক ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যাপক প্রযুক্তিভিত্তিক সেবাদানে বা সেবাগ্রহণের সর্বাপেক্ষা অত্যাবশ্যকীয় জরুরি বিষয় হচ্ছে নতুন প্রযুক্তির পরিচিতি ও ব্যবহারিক জ্ঞান; যাতে করে আপতকালীন সময়ে প্রত্যুৎপন্নমতি আচরণে ক্ষতির বিস্তার বা প্রভাব ঠেকানো যায়। এক্ষেত্রে ব্যাংকারদের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, এই ‘লকডাউন’ বা ‘ওয়ার্ক এট হোম’ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিভিত্তিক নিজস্ব জ্ঞানের ‘কুড়ালে’ আরেকটু শান দিয়ে সক্ষমতা অর্জনে সচেষ্ট হলেই ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাও খুবই সম্ভব।
লেখক: এসপিও, এনআরবি গ্লােবাল ব্যাংক লিমিটেড, মতিঝিল শাখা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন