সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকী

মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার

শেখ মুজিবুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

আজ এই মহান পরিষদে আপনাদের সামনে দুটি কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজকে ভাগ্যবান মনে করছি। মানবজাতির এই মহান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রতিনিধিত্ব লাভ করায় আপনাদের মধ্যে যে সন্তোষের ভাব লক্ষ করেছি, আমিও তার অংশীদার। বাঙালি জাতির জন্য এটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম আজ বিরাট সাফল্যে চিহ্নিত।
জাতিসংঘ সনদে যে মহান আদর্শের কথা বলা হয়েছে, তা আমাদের জনগণের আদর্শ এবং এ আদর্শের জন্য তারা চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে। এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সব মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে।

বাংলাদেশের সংগ্রাম ন্যায় ও শান্তির জন্য সর্বজনীন সংগ্রামের প্রতীকস্বরূপ। সুতরাং বাংলাদেশ শুরু থেকে বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের জন্মের পর তার এক-চতুর্থাংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে তার আদর্শ বাস্তবায়নে বিরাট বাধার মুখে অবিরাম সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। জাতিসংঘের সনদে যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা অর্জনের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লাখ লাখ মুক্তি সেনানীকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। এই সংগ্রাম এখনো চলছে। গায়ের জোরে বেআইনিভাবে এলাকা দখল, জনগণের ন্যায়সংগত অধিকারকে নস্যাৎ করার কাজে শক্তির ব্যবহার ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে চলেছে এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ব্যর্থ হয়নি। আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও গিনি বিসাউয়ে বিরাট জয় অর্জিত হয়েছে। এ জয় দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে ইতিহাস জনগণের পক্ষে ও ন্যায়ের চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত।

পৃথিবীর বহু স্থানে অন্যায়-অবিচার এখনো চলছে। আমাদের আরব ভাইয়েরা এখনো লড়ছেন তাঁদের ভূমি থেকে জবরদখলকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের জন্য। প্যালেস্টাইনি জনগণের ন্যায়সংগত জাতীয় অধিকার এখনো অর্জিত হয়নি। উপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্যে এখনো পৌঁছেনি। এ কথা আফ্রিকার জন্য আরো দৃঢ়ভাবে সত্য। সেখানে জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় স্বাধীনতা ও চরম মুক্তির জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামে এখনো ব্যাপৃত। বর্ণবৈষম্য এই পরিষদে চরম অপরাধ বলে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের বিবেককে তা এখনো ধ্বংস করছে। একদিকে অন্যায়-অবিচারের ধারাকে উৎখাতের সংগ্রাম, অন্যদিকে বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। আজ বিশ্বের সব জাতি পথ বেছে নেওয়ার কঠিন সংগ্রামের সম্মুখীন। এই পথ বাছাই করার প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ। অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষার তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় জগতের দিকে আমরা এগোব, না, আমরা তাকাব এমন এক পৃথিবীর দিকে, যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম। এই ভবিষ্যৎ হবে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে মুক্ত। বিশ্বের সব সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বণ্টনের দ্বারা এমন কল্যাণের দ্বার খুলে দেওয়া যাবে, যেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে।

ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ফলে খাদ্যের দাম গরিব দেশগুলোর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে ধনী ও উন্নত দেশগুলোই হচ্ছে খাদ্যের মূল রপ্তানিকারক। কৃষি যন্ত্রপাতি ও উপকরণের অসম্ভব দাম বাড়ার ফলে গরিব দেশগুলোর খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টাও তেমন সফল হতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বহু গুণ বেড়ে গেছে। তাদের নিজেদের সম্পদ কাজে লাগানোর শক্তিও হ্রাস পেয়েছে। এরই মধ্যে যেসব দেশ ব্যাপক বেকার সমস্যায় ভুগছে তারা তাদের অতি নগণ্য উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও কেটে-ছেঁটে কলেবর ছোট করতে বাধ্য হয়েছে। এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল। বিশ্বের সব জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে অগ্রসর না হলে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা এমন বিরাট আকার ধারণ করবে, ইতিহাসে যার তুলনা পাওয়া যাবে না।

এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে আমাদের মধ্যে মানবিক ঐক্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার স্বীকৃতিই শুধু বর্তমান সমস্যার যুক্তিসংগত সমাধান ঘটাতে সক্ষম। বর্তমান দুর্যোগ কাটাতে হলে অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। বর্তমানের মতো এত বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা জাতিসংঘ অতীতে কখনো করেনি। এ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যুক্তির শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। এ ব্যবস্থায় থাকবে নিজের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রতিটি দেশের সার্বভৌম অধিকারের নিশ্চয়তা। এ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বাস্তব কাঠামো, যার ভিত্তি হবে স্থিতিশীল ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বের সব দেশের সাধারণ স্বার্থের স্বীকৃতি। এখন এমন একটি সময় যখন আমাদের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে যে আমাদের একটা আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ব হলো বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যাতে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মর্যাদার উপযোগী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণায় এ অধিকারের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা অনুযায়ী আমাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব এমনভাবে পালন করতে হবে, যাতে প্রত্যেক মানুষ নিজের ও পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জীবন ধারণের মান অর্জনের নিশ্চয়তা লাভ করে।

আন্তর্জাতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশই যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করতে সক্ষম, সে সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক সংকট দূর করার পরিবেশই শুধু গড়ে উঠবে না, এ প্রতিযোগিতায় যে বিপুল সম্পদ অপচয় হচ্ছে, তা মানবজাতির সাধারণ কল্যাণে নিয়োগ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ প্রথম থেকেই জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করছে। এই নীতির মূল কথা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সবার সঙ্গে মৈত্রী। শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য, তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারব এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সব সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হব। সুতরাং আমরা স্বাগত জানাই সেসব প্রচেষ্টাকে, যার লক্ষ্য বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস, অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করা, এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রতিটি স্থানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি জোরদার করা। এই নীতি অনুযায়ী ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা রাখার প্রস্তাবে আমরা অবিরাম সমর্থন জানিয়ে এসেছি।

আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার এলাকারূপে ঘোষণায় অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস, জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বিশ্বের যে উদীয়মান জাতিগুলো একত্র হয়েছিল, তারা শান্তির পক্ষে শক্তিশালী সমর্থন জুগিয়েছে। তারা বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিন্ন প্রতিজ্ঞার কথাই আবার ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার লক্ষ্য জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।

মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সব নর-নারীর গভীর আশা-আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়ে রয়েছে। ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে শান্তি কখনো স্থায়ী হতে পারে না।
শান্তিকামী বলে উপমহাদেশে আমরা আপস-মীমাংসা নীতির অনুসারী। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়েছে এবং অতীতের সংঘাত ও বিরোধের বদলে আমাদের তিনটি দেশের জনগণের মধ্যে কল্যাণকর সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আমরা আমাদের মহান নিকট প্রতিবেশী ভারত, বার্মা ও নেপালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছি। অতীত থেকে মুখ ফিরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টায়ও লিপ্ত রয়েছি।

অতীতের তিক্ততা দূর করার জন্য আমরা কোনো প্রচেষ্টা থেকেই নিবৃত্ত হইনি। ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করে এই উপমহাদেশে শান্তি ও সহযোগিতার নতুন ইতিহাস রচনার কাজে আমরা আমাদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছি। এই ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থাকার অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল, তবু সব অপরাধ ভুলে গিয়ে আমরা ক্ষমার এমন উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছি, যা এই উপমহাদেশে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। উপমহাদেশের শান্তি নিশ্চিত করার কাজে আমরা কোনো পূর্বশর্ত দিইনি কিংবা দর-কষাকষি করিনি। বরং জনগণের জন্য আমরা এক সুকুমার ভবিষ্যৎ প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবান্বিত হয়েছি। অন্যান্য বড় বিরোধ নিষ্পত্তির কাজেও আমরা ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। ৬৩ হাজার পাকিস্তানি পরিবারের দুর্গতি একটি জরুরি মানবিক সমস্যা হয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কথা তারা আবার প্রকাশ করেছে এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য তাদের নাম রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির কাছে তালিকাভুক্ত করেছে। আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া ও আইনানুসারে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার অধিকার তাদের রয়েছে। একই সঙ্গে মানবতার তাগিদে তাদের সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন।

সাবেক পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায়সংগত বাটোয়ারা আরেকটি সমস্যা, যার আশু সমাধান দরকার। বাংলাদেশ আপস-মীমাংসার জন্য প্রস্তুত। আমাদের প্রত্যাশা এই উপমহাদেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে পাকিস্তান আমাদের আহবানে সাড়া দেবে এবং ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে। তাহলে উপমহাদেশে পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা সফল হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। বাংলাদেশ তার সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। যে সম্পর্কের ভিত্তি হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পরস্পরের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। বিশ্বের এ এলাকায় এবং অন্যত্রও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।

এই দুঃখ-দুর্দশা সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসংঘ মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রস্থল। নানা অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও জাতিসংঘ তার জন্মের পর সিকি শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মানবজাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এমন দেশের সংখ্যা খুব কম, যারা বাংলাদেশের মতো এই প্রতিষ্ঠানের বাস্তব সাফল্য ও সম্ভাবনা অনুধাবনে সক্ষম হয়েছে। ড. কুর্ট ওয়াল্ডহাইম তাঁর যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীদের প্রেরণাদানকারী নেতৃত্বে এই জাতিসংঘ আমাদের দেশে বিরাট ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ করেছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, উপমহাদেশে অবশিষ্ট যে মানবিক সমস্যা রয়েছে, তার সমাধানেও জাতিসংঘ এই রকমের গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে যেসব দেশ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলায় এবং বিশ্বসমাজের দ্রুত এগিয়ে আসার উপযোগী নিয়মিত প্রতিষ্ঠান গঠনে বাংলাদেশের বিশেষ স্বার্থ নিহিত রয়েছে। অবশ্য সূচনা হিসেবে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা এরই মধ্যে হয়েছে। এই ব্যবস্থা জাতিসংঘের বিপর্যয় ত্রাণ সমন্বয়কারীর অফিস স্থাপন। সংস্থাটি যাতে কার্যকরভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারে, সে জন্য তাকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা একান্ত দরকার। জাতিসংঘের সব সদস্য দেশেরই এ ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

প্রিয় প্রেসিডেন্ট, সর্বশেষে আমি মানবের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করতে চাই। আমাদের মতো দেশগুলো, যাদের অভ্যুদয় সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে, এই আদর্শে বিশ্বাসই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হতে পারে; কিন্তু আমাদের ধ্বংস নেই। এই জীবনযুদ্ধের মোকাবেলায় জনগণের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞাই শেষ কথা। আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। জনগণের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগই আমাদের নির্ধারিত কর্মধারা। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যায় অংশীদারী আমাদের কাজকে সহজতর করতে পারে, জনগণের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো উদীয়মান দেশগুলোর অবশ্যই নিজেদের কার্যক্ষমতার প্রতি আস্থা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হতে পারি, গড়ে তুলতে পারি উন্নততর ভবিষ্যৎ।
(সূত্র: ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে, সংক্ষেপিত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন