বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে অতীত ইতিহাস থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত যারই অবদান রয়েছে, তাদের সবারই প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব কোণে, একটি আলাদা সংস্কৃতি-সমাজ সমৃদ্ধ জনপদ গঠনে কে অস্বীকার করবে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী, সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, হযরত শাহজালাল (রহ:), নবাব সিরাজউদ্দৌলা, নবাব সলিসুল্লাহসহ অসংখ্য ব্যক্তিত্বের অবদান ও আবেগ। ব্রিটিশরা উপমহাদেশে না এলে বাঙলা-বিহার-উড়িষার পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়কে কেউ আটকাতে পারত না। ইতিহাসের এই ধারায় স্থান করে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বৃহত্তর বাঙলা না পেলেও পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্যে উপনীত হলেন কোনো না কোনোভাবে। কৌশলিক ভুলের কারণে কাশ্মীরের শেখ যা আদায় করতে পারেননি, বাঙলার শেখের কৌশল তা অর্জনে সফল হয়। ছোট আয়তনে হলেও এ এলাকার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় শেখ সাহেরের অবদান অসীম গুরুত্বপূর্ণ।
মরহুম নেতাদের অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করা উচিত। সময়ের বিবেচনায় প্রত্যেকের কৃতিত্ব রয়েছে। অযথা সমালোচনা না করে নেতাদের সময় ও পারিপার্শ্বিকতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। অথচ আমরা ইদানীং দেখছি মরহুম নেতাদের অযৌক্তিকভাবে সমালোচনা করা হয়। ইন্তেকাল করলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বলয়ে তিন মরহুম নেতার প্রচÐ প্রভাব রয়েছে। বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া ও মওলানা ভাসানীর অগণিত ভক্ত রয়েছে। কাউকে অশালীন সমালোচনা করা হলে তার সমর্থকবৃন্দ আহত হয়। একটি শক্তিশালী ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গঠনে এটা বাধা। দেশের শত্রæরা এর সুযোগ নিতে পারে। ইদানীং লক্ষ করা হচ্ছে যে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে অশালীনভাবে মরহুম নেতাদের এমনকি নবী (সা:)-এরও চরিত্র হনন করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, দেখা গেছে অস্ট্রিয়ার নিরাপদ দূরত্বে বসে এক বাঙালি অধ্যাপক নবী (সা:), ইসলাম, বঙ্গবন্ধু পরিবার পুণ্যবতী ফজিলাতুন্নেছাসহ অনেকের সম্পর্কে যা তা বলছেন। এসব ইউটিউব, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে।
আল্লাহর ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধুর একটা বড় অবদান হলো পাকিস্তান থেকে অক্ষতভাবে ফিরে এসে দেশের হাল ধরা। তিনি না এলে গোপন সাত দফাই হতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ভিত্তি। এই সাত দফা চুক্তি সই করাতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে চাপে রাখা হয়। ফলে সই করার পর দেশের কথা চিন্তা করে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য যে, সৈয়দ সাহেব তমদ্দুন মসজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং ছিলেন একজন ধার্মিক মানুষ। শেখ সাহেব সাত দফা সম্পূর্ণ নাকচ করেন। এটা তার পক্ষেই করা সম্ভব ছিল। অন্য নেতারা তা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। সাত দফা নাকচ করা সত্তে¡ও শেখ সাহেব সময় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে ইন্ডিয়ার সঙ্গে কৌশলিক সুসম্পর্ক রাখেন। তবে তার পররাষ্ট্রনীতি সামগ্রিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ছিল। পরবর্তীতে জিয়া এতে আরো কিছু ভারসাম্যতা আনেন সময়ের চাহিদা অনুযায়ী। মোট কথা শেখ সাহেব জীবিত ফিরে দেশের হাল না ধরলে দেশের অবস্থা ভুটানের চেয়েও খারাপ হতে পারত। যারা বলেন যে, বাঙলাদেশের এত কোটি লোকের দেশকে পদানত করা যেত না, তারা তিব্বত, সিনকিয়াং ও ফিলিস্তিনের দিকে তাকান না কেন?
আজ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়া হচ্ছে। আসাম তথা ইন্ডিয়া থেকে চল্লিশ লাখ হতে দুই কোটি মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার মনস্তাত্তি¡ক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার হাইকমিশনার শ্রীংলা এটা অভ্যন্তরীণ বিষয় বললেও খোদ শাসক দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বলছেন ভিন্ন কথা। এর পূর্বে বিজেপি নেতা তোগারিয়া কট্টর মন্তব্য করেন। এখন দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ও ইন্ডিয়ার মুসলিম প্রশ্ন একই কাতারে একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়া বেঁচে থাকলে তাদের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের জন্য হয়তো সমস্যা এত জটিল হতো না।
বঙ্গবন্ধরু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা সমাজ ও দেশসচেতন মানুষের পড়া উচিত। তার চিন্তা-চেতনার অনেক কিছু এতে রয়েছে। মুজিববাদকে স্বীকৃতি দিলে এই গ্রন্থের বিকল্প দেখি না। উপমহাদেশের ‘জিও পলিটিকস’-এর চমৎকার উল্লেখ রয়েছে এতে। এই বই পাঠে অনেকেরই অনেক ভুল ধারণার অপনোদন হবে। এই বই প্রমাণ করে যে, শেখ একজন খাঁটি বাঙালি মুসলমান ছিলেন। তিনি ইসলামের পক্ষেরই নেতা ছিলেন। শেখ স্পষ্ট করে তার চিন্তার প্রকাশ করেছেন এ ভাবে ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি।’ (পৃষ্ঠা ৪৭)
মরহুম নেতাদের নিয়ে আমরা উদার থাকতে চাই। সবাইকে আমরা ভালোবাসি। মৃত্যু বড় কঠিন বিষয়। মরহুমদের জন্য দোয়া খুবই ভালো কাজ হবে। এতে দেশে হানাহানি বন্ধ হবে। আমরা বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া ও মওলানা ভাসানীকে নিয়ে বিভেদ চাই না। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধেই তো মওলানা ভাসানী পল্টনে বক্তৃতা করে তাকে ওআইসিতে যেতে চাপ সৃষ্টি করেন। মওলানা ভাসানী তো বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়া উভয়কেই ভালোবাসতেন। জিয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা অপনোদনে পড়া যেতে পারে : মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি।’
রাজনীতি কখনও কখনও ভয়ঙ্কর। নবী বংশের সঙ্গে খোদ মুসলমান কিছু রাজনীতিবিদ শাসক ভালো ব্যবহার করেননি। মর্মান্তিক কারবালার ঘটনাও ঘটে, যার প্রভাবের জের এখনও চলছে। শিয়া-সুন্নি বিবাদ তারই ডালপালা। আমরা চাই শান্তি সবার জন্য; দেশ, জাতি, সমাজে শান্তি ও অগ্রগতি। মরহুম নেতাদের আত্মা থাকুক সুখ-শান্তিতে। আমরাও যেন থাকি সুখ-শান্তিতে।
লেখক : ইতিহাসবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন