পনের আগস্ট ভোরবেলা টেলিফোন বেজে উঠল। ঘুমিয়ে ছিলাম, উঠে টেলিফোন ধরলাম। অপর কণ্ঠ থেকে- স্যার, আমি ফারুক বলছি লন্ডন থেকে। খবর শুনেছেন স্যার? কি খবর? ঢাকার খবর। কি হয়েছে ঢাকায় আবার? স্যার, ঢাকায় অভ্যুত্থান হয়ে গেছে, শেখ সাহেবের ভাগ্যে কি ঘটেছে এখনও অনিশ্চিত স্যার। বলো কি? সম্ভবত স্যার শেখ সাহেব মারা গেছেন। ফারুক আহমেদ চৌধুরী তখন লন্ডনে ডেপুটি হাইকমিশনার। ফোন রেখে স্ত্রী মাহজাবিনকে বললাম। মাহজাবিন বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমিও না। তবুও ঘটনা যখন ঘটেই গেছে তার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম।
ব্রাসেলসে ফোন করলাম রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবকে। জানতে চাইলাম, ঢাকার খবর কি? রাষ্ট্রদূত নীরব। কথা বলছেন না। একপর্যায়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে খবর দিতে চান না বলে মনে হলো। ভাবনায় পড়ে গেলাম, কি করি। আবার ফোন করলাম। রাষ্ট্রদূত ধরতেই বললাম, ড. ওয়াজেদকে দিন, কথা বলব। ড. ওয়াজেদকে খুলে বললাম সব কিছু। তবে একথা বললাম, পূর্ণ বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত হাসিনা-রেহানাদের যেন না জানায়। তাকে আরও বললাম, যে কোন সাহায্যের জন্যে আমাকে জানাতে যেন ভুল না হয়। আমি যে কোন সাহায্য করতে প্রস্তুত। টেলিফোন রেখে বিবিসি শুনতে গেলাম।
রেডিও অন করতেই শোনা গেল বাংলাদেশে অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। অবশ্য বিবিসি এ কথাও বলল, খবরটি এখনও অসমর্থিত। রেডিও বন্ধ করে ভাবছিলাম কি করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভেসে উঠল। বার বার মনে পড়ল শেখ সাহেবের কথা। প্রথম দিন দেখা হতেই শেখ সাহেব আমাকে অনেক কথা বলেছিলেন। এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ঘটনাবলি ভালো মনে হচ্ছে না। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, শেখ সাহেব তার মৃত্যুর আগাম বার্তা পেয়েছিলেন।
কয়েক ঘণ্টা পর ব্রাসেলস থেকে সানাউল হকের টেলিফোন। খুব অস্থির। হাসিনা-রেহানাকে নিয়ে যেন খুব ঝামেলায় আছেন। ওদের তাড়িয়ে দিলেই বাঁচেন মনে হলো। বললেন, জানো হুমায়ুন, প্যারিস থেকে আবুল ফতেহ গাড়ি পাঠায়নি। কথা ছিল গাড়ি পাঠাবে, ওদের নিয়ে যাবে। এখনও গাড়ি আসেনি। ফতেহকে পাওয়া যায়নি। ওর বাসায় কেউ টেলিফোন ধরছে না। প্যারিসে শফি সামিকে টেলিফোন করলাম। শফি তখন অসুস্থ, হাসপাতালে। শফিকে বললাম, রাষ্ট্রদূত ফতেহকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেখ সাহেবের মেয়ে আসার কথা প্যারিসে। ওরা যদি আসে, ওদেরকে আদর যত্ন কর। ও বলল, ঠিক আছে। আমার বাড়িতে রাখব। শফির স্ত্রী আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
আবার ফোন করলাম ব্রাসেলসে। সানাউল হককে বললাম, ওদের গাড়ি দিয়ে জার্মান সীমান্তে অন্তত পৌঁছে দেন। সানাউল হক রাজি হলেন না। বিস্মিত হলাম। কি বলছেন আপনি। এইটুকু মানবতাবোধও নেই। অথচ শেখ সাহেব তাকে খুব স্নেহ করতেন। ক্ষুব্ধ হলাম। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই ভদ্রলোক কি এমন আচরণ করতে পারতেন? বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের গাড়ি দিতে রাজি নন। বাড়িতে ঠাঁই দেয়া তো দূরের কথা। কি বলব, এই ভদ্রলোকই পরবর্তীতে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। যাকগে ওসব কথা।
সানাউল হককে বললাম, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। ওরা আমার জার্মানির বাড়িতে আসবে। আমি তাদের আশ্রয় দেব। আমি অকৃতজ্ঞ নই। আমার চাকরির মায়া নেই। মানবতা আমার কাছে মুখ্য। আমার বাবা-মা মানুষের সেবা করতে শিখিয়েছেন। বলেছেন, মানুষের বিপদে-আপদে যেন ছুটে যাই। ফলাফল কি হবে জেনেও আমি ওদের জার্মানি আনার ব্যবস্থা করলাম।
পনের আগস্ট সন্ধ্যায় ওরা জার্মানি পৌঁছল। সেদিনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জার্মানি পৌঁছার কথা। সাথে থাকবেন পররাষ্ট্র দফতরের পরিচালক রেজাউল করিম। বেলগ্রেড থেকে কামাল হোসেন আসছেন। আমি বিমানবন্দরে গিয়ে তাকে স্বাগত জানালাম। ড. কামাল তখনও ঢাকার খবর জানেন না। আমি তাদের বাসায় নিয়ে গেলাম। কামাল হোসেন খুবই অস্থির, কথা বলতে পারছেন না। হাসিনা-রেহানাদের আগেই ড. কামাল জার্মানি পৌঁছেছেন।
সারাদিনই কাটালাম রেডিও শুনে। যখন জানতে পারলাম খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তখন আবার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। তখন থেকেই তিনি ষড়যন্ত্র করছিলেন। মোশতাক চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। বহু বছর পর স্মৃতিচারণ করছি।
শেখ সাহেবের মেয়েরা যখন আমার বাসায় পৌঁছল তখন কি দৃশ্য! ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। জীবনে অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। এমন হইনি কখনও। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। হিমশীতল পরিবেশ। একপর্যায়ে তারা কান্নায় ভেঙে পড়ল। কান্নায় বাড়ির নিস্তব্ধতা কেটে গেল। ঢাকায় ফোন করলাম। কোনো টেলিফোনই কাজ করছে না। ঢাকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টেলিফোন পাঠালাম বিস্তারিত জানার জন্য। কোনো উত্তর এলো না।
লন্ডনে ফোন করলাম। তারা বলল, রেডিও রিপোর্ট ছাড়া কিছু জানে না। হাসিনা-রেহানা জানতো না- ঢাকায় শেখ পরিবারের সবাই মারা গেছেন। তাদের সব কিছু জানানো হয়নি। আমার বাসায় তিনটি রেডিও ছিল! একটি রেডিও ছাড়া বাকি দুটি আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখে দিলাম। কীভাবে যেন হাসিনা-রেহানা জেনে গেল, শেখ সাহেব মারা গেছেন। এই খবর শোনামাত্র ড. ওয়াজেদ বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
আমার মনে আছে, শেখ হাসিনা আমায় বলেছিল, জানি জানি কামাল-জামালও চলে গেছে। হাসিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিল, চাচা আমার মা ও রাসেলকে আমাদের কাছে আনার ব্যবস্থা করুন। রাত তখন ১০টা। আমি জানতাম বেগম মুজিব মারা গেছেন। তবু আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি দেখছি কী করা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তারা কীভাবে যেন নিশ্চিত হয়ে গেল- বেগম মুজিবও নেই। কী বলব ওদের অবস্থার কথা। হাসিনার অনুরোধেই আমি টেলিগ্রাম পাঠালাম ঢাকায়, শেখ রাসেলকে যেন জার্মানি পাঠানো হয়। আমার ধারণার বাইরে ছিল, এই অল্প বয়সের শিশুটিকেও হত্যা করা হয়েছে। কোন জবাব এলো না ঢাকা থেকে।
জার্মান সরকারকে জানালাম, আমার বাসায় শেখ সাহেবের দুই মেয়ে, মেয়ের জামাই ও দুই নাতি-নাতনি রয়েছে। জার্মান সরকার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাসার সামনে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিস্তারিত জানতে চাইল- তারা বলল, এক্সেলেন্সি, আমরা আপনার সাহসী ভূমিকাকে উৎসাহিত করছি। তবু আপনি নিজে কোনো ঝামেলায় পড়েন কি-না খেয়াল রাখবেন। বললাম, কোনো অসুবিধা হবে না। মানবিক দায়িত্ব পালন করছি। মনে আছে, ডেস্ক অফিসার আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন নিশ্চিত না হই অসুবিধা হবে না, এ কথা ভেবে। তার ভাষায়- অসুবিধা হতে পারে। সতর্ক থাকবেন। আমাদের জানাবেন সব কিছু।
একপর্যায়ে হাসিনা জানতে চাইল, কে এই ঘটনার নায়ক। আমি বললাম, রেডিও রিপোর্ট থেকে শুনেছি খন্দকার মোশতাকের কথা। হাসিনা কোনো মতেই বিশ্বাস করতে রাজি নয়। আব্বার সঙ্গে খন্দকার মোশতাক চাচা কত ঘনিষ্ঠ। পরিবারের একজন সদস্যের মতো। তিনি এই জঘন্য হত্যাকান্ডে জড়িত থাকতে পারেন না। হাসিনা অবিশ্বাস করলে কী হবে, মোশতাকই এ ঘটনার নায়ক। অভ্যুত্থানের সুবাদে প্রেসিডেন্ট।
সারা দুনিয়া থেকে টেলিফোন আসা শুরু হলো আমার কাছে। তারা জানতে চাইল শেখ পরিবারের দু’সদস্যের কথা। সংবাদপত্র থেকেও ফোনের পর ফোন। এক জার্মান মহিলা মিশনে ঢুকে বললেন, তোমরা কেমন জাতি, তোমাদের নেতাকে হত্যা করতে পার, তোমরা এক অসভ্য জাতি। ভদ্রমহিলা কোনো অবস্থাতে থামতে রাজি নন। তাকে বললাম, শেখ সাহেবের মেয়েদের আমি আশ্রয় দিয়েছি। ভদ্রমহিলা ১২ বছরের এক বালককে নিয়ে এলেন। বললেন, তোমরা কীভাবে এ বয়সের বালককে হত্যা করতে পার। রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচয় দিতে তখন লজ্জা লাগছিল।
এই যখন অবস্থা, তখন জার্মান প্রবাসী কিছু বাংলাদেশি যুবক এসে ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। তারা বলল, আমি কেন শেখ সাহেবের মেয়েদের ঠাঁই দিয়েছি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন তাদের বাসা থেকে বের করে দেই। তা না হলে আমাকে তারা দেখে নেবে। তারা কয়েকটি পাসপোর্ট বের করে বলল- তাতে যেন ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সিল মেরে দেই। তাদের ধারণা বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র হয়ে গেছে।
১৬ আগস্ট ড. কামাল হোসেন লন্ডনের পথে পাড়ি দিলেন। আমার বাসায় যে কক্ষে ড. কামাল উঠেছিলেন সেটি খালি করা হলো। আমার এক ভাগিনা এসে হাজির। সুঠাম দেহের অধিকারী ভাগিনা যখন তার কক্ষে যাচ্ছিল, তখন শেখ সাহেবের এক মেয়ে তাকে দেখে ফেলে। তারা ভাবে অন্য কেউ হয়তো এসেছে, তাদেরকে হত্যা করতে। সারা রাত তারা ঘুমায়নি। ড. ওয়াজেদ আমাকে জার্মানস্থ সোভিয়েত দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ রাখার অনুরোধ জানালেন। তার ধারণা ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে আশ্রয় দেবে। আমি জানালাম, আশ্রয় নিতে চাইলে সোভিয়েত কেন জার্মানিতেই হবে। এটা কোনো সমস্যা নয়। ইচ্ছা করলে লন্ডনেও যাওয়া যেতে পারে।
একসময় ভারতীয় হাইকমিশনার মি. রহমান টেলিফোন করে শেখ পরিবারের সদস্যদের কুশলাদি জানলেন। বললাম, তারা ভালো আছে, আমি দেখাশোনা করছি। তিনি বললেন, মিসেস গান্ধী খুব খুশি হয়েছেন আমি আশ্রয় দিয়েছি জেনে। হাসিনাকে বললাম, ভারতীয় হাইকমিশনার মি. রহমান দেখা করতে চান তার সঙ্গে। সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো। আমি গরহাজির থাকলাম।
ড. ওয়াজেদ সবাইকে নিয়ে গেলেন কার্লশোতে। সেখানে শিক্ষা সফরে এসেছিলেন তিনি। কিছুদিন পর ভারতীয় হাইকমিশনার জানালেন, শেখ পরিবারের সদস্যগণ নিরাপদে, সুস্থভাবে বসবাস করছেন দিল্লিতে। ২৫ আগস্ট জেনেভা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবু সাঈদ চৌধুরী টেলিফোনে জানালেন, মোশতাক সাহেব খুবই ক্ষিপ্ত। কেন আমি হাসিনা-রেহানাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। আবু সাঈদ বললেন, প্লিজ, আপনি ঢাকা যাবেন না। গেলে বিপদ হবে। দু’দিন পর ঢাকা থেকে বার্তা, আমাকে ওএসডি করা হয়েছে। (সংকলিত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন