বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকী

কারাগারে বঙ্গবন্ধুর রোগ ও চিকিৎসা

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

ভারত বিভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র হোস্টেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শেখ মুজিব জড়িত হয়ে পড়েন। কলকাতার লালবাজার থানা থেকে আগত ঢাকার লালবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ হুমায়ুন মুর্শেদ চৌধুরীর সাথে ১৯৪৮ সালের শুরুতে পলাশী ব্যারাকের মাঠে মিটিং করার বিষয় জ্ঞাত করার জন্য শেখ মুজিব সাক্ষাৎ করেন। প্রথম দেখায় তরুণ রুগ্ন আকর্ষণীয় শেখ মুজিব সম্পর্কে ওসির পর্যবেক্ষণ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রথম সাক্ষাতে দারোগা শেখ মুজিবকে সাবধান করে বলেন, ‘তুমি মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে জড়িও না, পড়াশোনা শেষ করো, তুমি পূর্ব পাকিস্তানকে অনেক কিছু দেবে, তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, পুলিশ এড়িয়ে চলো।’ তেজোদীপ্ত শেখ মুজিব ওসির পরামর্শ আমলে নেননি। তবে ওসির পর্যবেক্ষণ পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল, শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ হিসেবে।
রাজনৈতিক কারণে শেখ মুজিব প্রথম জেলে যান ১৪ মার্চ ১৯৪৮ সালে এবং মুক্তি লাভ করেন চার দিন পর ১৬ মার্চ সন্ধ্যায়। পুনরায় শেখ মুজিব গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এবং মুক্তি পান জুলাই মাসে। ১৪ অক্টোবর ১৯৪৯ ভুখা মিছিল থেকে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মুক্তি পান ফরিদপুর কারাগার থেকে। কথিত দুর্নীতির অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন ১১ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে এবং মুক্তি পান ৭ ডিসেম্বর ১৯৬০ সালে ঢাকা হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে। জননিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এবং মুক্তিলাভ করেন ১৮ জুন তারিখে।

১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে শেখ মুজিব এক বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন এবং হাইকোর্টের নির্দেশে পরে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে তিনি আটবার গ্রেফতার হন, ম্যাজিস্ট্র্রেট জামিন দিতে অস্বীকার করেন কিন্তু একই দিনে বিকেলে জেলা জজ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালেও ‘শেখ মুজিব বারে বারে গ্রেফতার হয়েছেন’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ক্রমাগত মিটিং মিছিল এবং জনগণের চাপে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সামরিক সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সৃষ্ট আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। মুক্তির পরপরই শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ১৯৭১ সালে সাড়ে ৯ মাস পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে বন্দি থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিলাভ করেন ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২।

১৯৪৯ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে শেখ মুজিব প্রায় আট বছর জেলে কারাবন্দি ছিলেন এবং কারাজীবনের বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন অসুস্থতার বিবরণ আছে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাজীবনের রোজনামচায়।

১৯৫০ সালে গোপালগঞ্জ, জেলে থাকাকালে ‘দুর্বল হার্ট, চক্ষু যন্ত্রণা ও বাম পায়ে রিউমেটিক ব্যথা’ হয়, ‘ভীষণ জ্বর ও মাথাব্যথা এবং বুকে ব্যথা’, ধরা পড়ে খুলনা জেলে, ‘চোখের অসুখও বাড়ে’। ভালো চিকিৎসার দাবিতে ফরিদপুর জেলে শেখ মুজিব অনশন করেন, জেল চিকিৎসকরা জোর করে টিউব ঢুকিয়ে তরল খাবার প্রবেশ করালে নাকে ক্ষত সৃষ্টি হয়- ‘হার্টের অবস্থা খারাপ হয়, পালপিটিশন বাড়ে এবং নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়।’

১৯৬৬ সালে জেলে থাকাকালে শেখ মুজিব ভোগেন ‘অনিন্দ্রা ও ক্ষুধামন্দায়’। ২৯ জুন ১৯৬৬ সকালে হঠাৎ ‘পায়খানার দ্বার দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরে এবং পাইলস ও গ্যাস্ট্রিকের পুনরাবির্ভাব হয়’, ‘সাথে মাথা ভার, ব্যাপক বদহজম ও খাওয়ায় অনিচ্ছা’। একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং নির্জন কারাবাসেও (Solitary Confinement) শেখ মুজিবের মনে দৃঢ়তা অটল ছিল- ‘আমাকে বাঁচতে হবে, অনেক কাজ বাকি আছে।’

জুলাই মাসে পাইলস কমে কিন্তু পেট মাঝে মাঝে খারাপ হয়, আমাশয় বাড়ে, অনিদ্রা সমস্যা বাড়ায়। যোগ হয় পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত ভয়ানক ব্যথা। পরের বছর প্রায়ই অসহ্য মাথাব্যথা ও চোখের ব্যথায় ভোগেন, সারিডন টেবলেট খেয়ে কিছুটা ভালো থাকেন কিন্তু ‘ওজন কমে এবং পায়খানার দ্বার দিয়ে রক্ত পড়ে, দুর্বলতা বাড়ে।’

স্বাধীনতার পর তিনি ‘সারিডন’ খাওয়া বন্ধ করেছিলেন, যখন আমি তাকে বলেছিলাম যে সারিডনে ক্ষতিকর ফিনাসিটিন আছে, তাই ব্রিটেনে এটা নিষিদ্ধ। সারিডনের অপর দুটো উপাদান ছিল এসিটালসেলিসাইলিক এসিড (এসপিরিন) এবং সামান্য কেফিন। পরবর্তীকালে তিনি ব্যথা নিরাময়ের জন্য রেকিট কোলমান কোম্পানির এসপ্রো খেতেন। এসপ্রোর মূল উপাদান এসপিরিন।
ফরিদপুর, খুলনা ও ঢাকার জেলে থাকাকালে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হোসেন তার চিকিৎসা করেছেন। জেলার সিভিল সার্জনরা জেল হাসপাতালের এক্স অফিসিও সুপারিনটেনডেন্ট। তারা সপ্তাহে দু’বার জেল হাসপাতাল পরিদর্শন করতেন। ডা. মোহাম্মদ হোসেনের পুরো নাম মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী। ব্রাহ্মণ্যত্ব পরিহার করে মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলীর পিতামহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভারত বিভাগের আগে ডা. মোহাম্মদ হোসেন রাচী মানসিক হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। তৎকালীন এক ঘটনা তাকে অবিস্মরণীয় করেছে। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে গভর্নর নিকটবর্তী রাচী মানসিক হাসপাতালে আসেন তার অফিসকে খবর দেয়ার জন্য। তিনি নিজেকে গভর্নর পরিচয় দিলে হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে ধরে আটকে রেখে বলে, ‘নতুন কথা নয়, এখানকার সবাই নিজেদের গভর্নর মনে করেন, ছোট লাট দাবি করেন। থাকুন এখানে, আপনাকেই তো খুঁজছিলাম, মহামান্য আসুন, রাচী গভর্নর হাউজে থাকুন।’

ডা. মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জুরিসপ্রুডেন্সের খ্যাতিমান অধ্যাপক হয়েছিলেন। তিনি সিভিল সার্জন থাকাকালে শেখ মুজিবের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রেফার করেছিলেন। সেখানে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন এস এ লস্কর এবং মেডিসিন অধ্যাপক এ কে সামসুদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবের প্রায় এক মাস চিকিৎসা করেছিলেন, চক্ষু ও হৃদরোগের।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন