অখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রাহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে। এ সময় আমাদের বক্তৃতার ধারাও বদলে গেছে। অনেক সময় হিন্দু বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ নিয়ে আলোচনা হতো। কিছুতেই তারা বুঝতে চাইত না। ১৯৪৪-৪৫ সালে ট্রেনে, স্টিমারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হতো। সময় সময় এমন পর্যায়ে আসত যে, মুখ থেকে হাতের ব্যবহার হবার উপক্রম হয়ে উঠত। এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নেই। পাকিস্তান আনতে হবে এই একটাই স্লোগান সকল জায়গায়।
একদিন হক সাহেব আমাদের ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। দওয়াত নেব কি নেব না এই নিয়ে দুই দল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, ‘কেন যাব না, নিশ্চয়ই যাব। হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগে ফিরে আসতে। আমাদের আদর্শ যদি এত হালকা হয় যে, তার কাছে গেলেই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাব, তাহলে সে পাকিস্তান আন্দোলন আমাদের না করাই উচিত।’ আমি খুলনার একরামুল হককে সাথে নিলাম, যদিও সে ইসলামিয়ায় পড়ে না। তথাপি তার একটা প্রভাব আছে। আমাকে সে মিয়াভাই বলত। আমরা ছয়-সাতজন গিয়েছিলাম। শেরে বাংলা আমাদের নিয়ে খেতে বসলেন এবং বললেন, ‘আমি কি লীগ ত্যাগ করেছি? না, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে? জিন্নাহ সাহেব আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেন না। আমি বাঙালি মুসলমানদের জন্য যা করেছি জিন্নাহ সাহেব সারা জীবনে তা করতে পারবেন না। বাঙালিদের স্থান কোথাও নেই, আমাকে বাদ দিয়ে নাজিমুদ্দীনকে নেতা করার ষড়যন্ত্র।’ আমরাও আমাদের মতামত বললাম। একরামুল হক বলল ‘‘স্যার, আপনি মুসলিম লীগে থাকলে আর পাকিস্তান সমর্থন করলে আমরা বাংলার ছাত্ররা আপনার সাথে না থেকে অন্য কারও সাথে থাকতে পারি না। ‘পাকিস্তান’ না হলে মুসলমানদের কি হবে?’’ শেরে বাংলা বলেছিলেন, ‘১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কে করেছিল, আমিই তো করেছিলাম। জিন্নাহকে চিনত কে?’ আমরা তাকে আবার অনুরোধ করে সালাম করে চলে এলাম। আরও অনেক আলাপ হয়েছিল, আমার ঠিক মনে নাই। তবে যেটুকু মনে আছে সেটুকু বললাম। তার সঙ্গে স্কুলজীবনে একবার ১৯৩৮ সালে দেখা হয়েছিল ও সামান্য কথা হয়েছিল গোপালগঞ্জে। আজ শেরে বাংলার সামনে বসে আলাপ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
এদিকে মুসলিম লীগ অফিসে ও শহীদ সাহেবের কানে পৌঁছে গিয়েছে আমরা শেরে বাংলার বাড়িতে যাওয়া-আসা করি। তার দলে চলে যেতে পারি। কয়েক দিন পরে যখন আমি শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘কি হে, আজকাল খুব হক সাহেবের বাড়িতে যাও, খানাপিনা করো?’ বললাম, ‘একবার গিয়েছি জীবনে।’ তাকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, ‘ভালোই করছ, তিনি যখন ডেকেছেন কেন যাবে না?’ আরো বললাম, ‘আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি মুসলিম লীগে আসতে।’ শহীদ সাহেব বললেন, ‘ভালোই তো হতো যদি তিনি আসতেন। কিন্তু আসবেন না, আর আসতে দেবেও না। তার সাথে কয়েকজন লোক আছে, তিনি আসলে সেই লোকগুলির জায়গা হবে না কোথাও। তাই তাকে মুসলিম লীগের বাইরে রাখতে চেষ্টা করছে।’
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, কোনো সংকীর্ণতার স্থান ছিল না তার কাছে। কিন্তু অন্য নেতারা কয়েকদিন খুব হাসি-তামাশা করেছেন আমাদের সাথে। আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হতো আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেই জন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম।
কোন ছাত্রের কি অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসত। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতই। কারণ, সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম। একদিন বললাম, ‘স্যার, কোনো ছাত্র রোগগ্রস্ত হলে যে কামরায় থাকে, সেই কামরাটা আমাকে দিয়ে দেন। সেটা অনেক বড় কামরা দশ-পনের জন লোক থাকতে পারে।’ বড় কামরাটায় একটা বিজলি পাখাও ছিল। নিজের কামরাটা তো থাকলই। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, দখল করে নাও। কোনো ছাত্র যেন নালিশ না করে।’ বললাম, ‘কেউই কিছু বলবে না। দু-একজন আমার বিরুদ্ধে থাকলেও সাহস পাবে না।’
দৈনিক আজাদই ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত। এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশিম সাহেবকে শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমাদেরও ঐ একই দশা। তাই আমাদের কোনো সংবাদ সহজে ছাপা হতো না। মাঝে মাঝে জনাব মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। পরে সিরাজুদ্দিন হোসেন (বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক) এবং আরও দু-একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করত। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই-একটা সংবাদ ছাপত। দৈনিক মর্নিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ঐ পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকে পুরাপুরি সমর্থন করত, তবুও ওটা একটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণী বলা যায়। আমাদের সংবাদ দিতেই চাইত না। ঐ পত্রিকা হাশিম সাহেবকে মোটেই পছন্দ করত না। ছাত্র ও লীগ কর্মীরা হাশিম সাহেবকে সমর্থন করত, তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে সংবাদ দিত। আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে, বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারার প্রচার করার জন্য। হাশিম সাহেবের পক্ষে কাগজ বের করা কষ্টকর। কারণ টাকা-পয়সার অভাব। শহীদ সাহেব হাইকোর্টে ওকালতি করতে শুরু করেছেন। তিনি যথেষ্ট উপার্জন করতেন, ভালো ব্যারিস্টার হিসাবে কলকাতায় নামও ছিল। কলকাতায় গরিবরাও যেমন শহীদ সাহেবকে ভালোবাসতেন, মুসলমান ধনিক শ্রেণীকেও শহীদ সাহেব যা বলতেন, শুনত। টাকা পয়সার দরকার হলে কোনোদিন অসুবিধা হতে দেখি নাই। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রাকশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে তা পেলে পরে আর জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এই দুইজনই শহীদ সাহেবকে রাজি করতে পারব, এই ধারণা অনেকেরই ছিল।
আমরা দুইজন একদিন সময় ঠিক করে তার সাথে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভালো ভালো লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাতখরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে। আরও দু-একবার দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন।
মুসলিম লীগ অফিসের নিচের তলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারী করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তার যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’।
হাশিম সাহেবের গ্রুপকে অন্য দল কমিউনিস্ট বলতে শুরু করল, কিন্তু হাশিম সাহেব ছিলেন মওলানা আজাদ সোবহানীর একজন ভক্ত। তিনি বিখ্যাত ফিলোসফার ছিলেন। মওলানা আজাদ সোবহানী সাহেবকে হাশিম সাহেব আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন কলকাতায়। আমাদের নিয়ে তিনি ক্লাস করেছিলেন আমার সহকর্মীরা অধিক রাত পর্যন্ত তার আলোচনা শুনতেন। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। কিছু সময় যোগদান করেই ভাগতাম। আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, ‘ তোমরা পন্ডিত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপরে বসে বসে আলোচনা করা যাবে।’ হাশিম সাহেব তখন চোখে খুব কম দেখতেন বলে রক্ষা। আমি পেছন থেকে ভাগতাম তিনি কিন্তু বুঝতে পারতেন! পরের দিন দেখা করতে গেলেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কি হে, তুমি তো গত রাতে চলে গিয়েছিলে।’ আমি উত্তর দিতাম, ‘কি করব, অনেক কাজ ছিল।’ কাজ তো থাকতই ছাত্রদের সাথে, দল তো ঠিক রাখতে হবে।
লেখকের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন