সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

একজন ভালো বন্ধু হারাল বাংলাদেশ

| প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারাল বাংলাদেশ। বার্ধক্যজণিত স্বাস্থ্য জটিলতা, মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া এবং সেই সাথে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা প্রণব মুখার্জি গত সোমবার সন্ধ্যায় ৮৪ বছর বয়েসে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এই বাঙ্গালী কংগ্রেস নেতার সাথে বাংলাদেশের নিবিড় , আত্মিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ আমৃত্যু অটুট ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত প্রণব মুখার্জি ও তাদের মধ্যকার ঐতিহাসিক সম্পর্কের গভীরতায় কখনো ছন্দপতন ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে প্রনভ মুখার্জির হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকবার প্রনব মুখার্জির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন তাঁর অভিভাবকের মতো। প্রণব মুখার্জির দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণায় বাংলাদেশের জন্ম ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহগুলো নানা অনুসঙ্গে উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধুর মহাপ্রয়ানে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। তাঁর স্মরণে আজ বুধবার বাংলাদেশে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের বিজেপি সরকার প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ৭দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। সে দেশের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীসহ ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বস্তরের মানুষ শোক প্রকাশ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

ঘটনাবহুল ভারতীয় রাজনীতির দীর্ঘ পরিক্রমায় প্রণব মুখার্জি নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ কারণে কংগেসের রাজনীতির চানক্য, ক্রাইসিস ম্যানেজার ইত্যাদি খেতাবে ভুষিত হয়েছিলেন তিনি। ভারতের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র বাঙ্গালী প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠিয়ে তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে কসুর করেনি কংগ্রেস। সর্বভারতীয় রাজনীতিক হিসেবে তিনি দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। গত বছর ভারত সরকার তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরতœ’ খেতাবে ভূষিত করেন। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী যর্থাথই বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় রাজনীতির আকাশ থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটল। তিনি ছিলেন আজীবন অসাম্প্রদায়িক এবং সর্বভারতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক। তাঁর মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে সব মহলের মধ্যে যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে এবং বিজেপি সরকারের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তার সুমহান ব্যক্তিত্ব, গ্রহণযোগ্যতা ও শ্রদ্ধার আসনটিই আলোকিত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে পুরো বিশ্ব এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ভারতীয় উপমহাদেশের উপর যে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত গ্রাস করেছে, এ সময়ে রাজনীতির ক্রাইসিস ম্যানেজার প্রণব মুখার্জির প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনা খুব বেশি প্রয়োজনীয় ছিল।

প্রণব মুখার্জির প্রকাশিত আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স’-এর বিভিন্ন অধ্যায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নানা ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের উল্লেখ রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের যে ব্যতিক্রমী ঘনিষ্টতা এবং উচ্চতার দাবি দুই দেশের সরকারের তরফ থেকে করা হয়, তার পেছনে প্রণব মুখার্জির অবদান অনস্বীকার্য। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রণব মুখার্জি ভারতের প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকা পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রশ্নে যে প্রত্যাশা জেগেছিল, এরপর তা অনেকটাই নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। ভারতের একমাত্র বাঙ্গালি প্রেসিডেন্টের সাথে বাংলাদেশের নিবিড় যোগসূত্র এবং তার স্বীকৃতির স্বরূপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরো বহুদিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে। তিনি হিন্দুত্ববাদ, আধিপত্যবাদকে এড়িয়ে ভারতকে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত করার চেষ্টা করে গেছেন। ভারতের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশের স্বার্থ এবং উন্নয়নের বিষয়টিকেও তিনি সমানভাবে গুরুত্ব দিতেন। একজন আদর্শবান বাঙ্গালি হিসেবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরম সুহৃদ, অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে মি. প্রণব মুখার্জির প্রয়ান উপমহাদেশের রাজনীতির জন্য অনেক বড় ক্ষতি। বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধুর মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন