বেশ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, কাঠ-কাগজ পুড়িয়ে, দেহের ঘাম ঝরিয়ে অবশেষে সুযোগ মিলল কলকাতা দেখার। সংখ্যায় আমরা পাঁচ বন্ধু ও একজন অতিথিসহ ৬ জন। পরদিন অবশ্য আরো দু’জন যুক্ত হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর থেকে বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়ার সীমানায় পৌঁছানো পর্যন্ত ঝক্কি-ঝামেলা কম পোহাতে হয়নি। শুধু এটুকুই বলব, ৭-৮ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে আমাদের প্রায় ১৫ ঘণ্টা লেগে গেছে। ওপাশে পৌঁছানোর পর সবার মুখে একটিই কথা, আর দেরি নয়। অটোতে চেপে বোনগাঁ রেলস্টেশন, দ্রুত টিকিট কেটে উঠে পড়লাম আমরা ছ’জনায়।
মনে হচ্ছিল ট্রেনটা আমাদের জন্যই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আমরা চড়লাম, ট্রেনও এগিয়ে যেতে লাগল দমদম অভিমুখে।
ট্রেনের কামরার বৈচিত্র্য খেয়াল করতে করতে পৌঁছে গেলাম দমদম জংশনে। নেমে পড়লাম, ওখান থেকে পাতাল ট্রেনে চেপে সোজা বড়বাজার। মাটির নিচ দিয়ে কী কারিশমাই না দেখিয়ে দিল কলকাতা। ওদের রেল ব্যবস্থা দেখে ঈর্ষান্বিত না হয়ে পারলাম না। আমাদের কেন নেই!! ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম বড়বাজার। এটা আমাদের পুরাতন ঢাকা নাকি কলকাতা, এর নিশ্চয়তা পেতে কিছুটা সময় লাগল।
অবশেষে একটা মধ্যম মানের হোটেলে আশ্রয় মিলল। সবার ঘুম ভাঙল জীবনানন্দের জীবন হরণকারী ট্রামগাড়ির শব্দে। জীবনে প্রথম ট্রাম দর্শনের অনুভূতি। দুশ্চিন্তা ঝেড়ে দাদাদের দেশে আল্লাহর নাম নিয়ে বের হলাম। নাস্তা সেরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গৃহ অভিমুখে অগ্রসর হলাম। বড়বাজার থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি একেবারেই দূরে নয়। হাঁটা শুরু হলো সেই সাথে শুরু হলো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। সবকিছু উপেক্ষা করে ১০টি পা এগিয়ে চলেছে বাড়িটির দিকে। একসময় থামতে হলো কারণ রাস্তার পাশের একটি বৃহৎ ফটকের উপরেই লেখা ‘‘রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।’’ কালবিলম্ব না করে রবীন্দ্র বাড়ির সৌন্দর্য অন্বেষণে এগিয়ে গেলাম সবাই। ফটকের দু’পাশে দুটি কবিতা লেখা যার নিচে স্বাক্ষর করাÑশ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাড়ির এক পাশে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপাদমস্তক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ফটকের ডানদিকের এককোণে খোলামেলা ঘরে নিত্যব্যবহার্য গাড়িটা তাঁরই। একেবারেই বাড়ির মাঝখানের মাঠে একটু উঁচুতে মূর্তিস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখছি সাহিত্যচর্চায় ক্ষণিক বিরতি ঘটিয়ে নির্বাক, নির্লিপ্তরূপে আমাদের দিকেই চেয়ে আছে। তাঁর সাথে (রবীন্দ্রনাথের মূর্তি) সেলফি তুললাম। এখানে ভবন আসলে একটা নয়, তিন-তিনটা। একটি প্রাচীন অংশ যা রবীন্দ্র পরিবারের আঁতুড়ঘর হিসেবে নির্মিত । সাদা রঙের প্রাচীন এই ভবনের সম্মুখে সবাই কিছুক্ষণ ছবি তুললাম। দেখা শুরু হলো মহর্ষি ভবন যার প্রতিটি জায়গা রবীন্দ্র ছোঁয়ায় বিজড়িত। এই ভবনের দোতলা-তিনতলা রবীন্দ্র স্মৃতিতে পূর্ণ জাদুঘর।
যতক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, এক অদ্ভুত ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। বারবারই মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পরতে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া লেগে আছে যা আমিও ছুঁয়ে দিচ্ছি আজ, এতদিন পরে হলেও।
নিচ থেকে জুতো, মোবাইল, ক্যামেরা সংগ্রহ করে কিছুক্ষণ চলতে থাকল ফটোসেসন। সারাক্ষণ রবীন্দ্র সঙ্গীতের ধারা বইতে থাকে ঠাকুরবাড়িতে। এবার বিদায় নিতেই হবে কেননা ভিক্টোরিয়া পার্ক, ইলিয়ট পার্ক, সাইন্স সিটি, হাওড়া ব্রিজ কেমন দেখতে হবে এটা না জানলে কেমন হয়। ফিরে আসার সময় বামদিকে আরেকবার তাকালাম। গাড়িটা তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। যাত্রী চিরতরে ছুটি নেবার পর হয়তোবা গাড়ির চালকেরও ছুটি মিলেছে চিরদিনের জন্য।
ষ মো. তনিউর রহমান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন