সারা দিন নানা ব্যস্ততা আর ছোটাছুটিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদের তুঙ্গে থাকা শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহ নিয়ে আমরা হারিয়ে যাই নিদ্রার কোলে। অবচেতন হয়ে পড়ি নানা শোরগোল থেকে। ঘুমের আবেশ মিশে যায় মলিন বদনখানা। হারিয়ে যায় স্বপ্নের রাজ্যে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: তিনিই তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছেন আবরণস্বরূপ, নিদ্রাকে করেছেন বিশ্রামস্বরূপ। -সূরা আল ফোরকান:৪৭
এ আয়াতে রাত্রিকে ‘লেবাস’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। লেবাস যেমন মানবদেহকে আবৃত করে, রাত্রিও তেমনি একটি প্রাকৃতিক আবরণ, যা সমগ্র সৃষ্টজগতের উপর ফেলে দেয়া হয়। নিদ্রাকে আল্লাহ তা‘আলা এমন করেছেন যে, এর ফলে সারাদিনের ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর হয়ে যায়। চিন্তা ও কল্পনা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মস্তিষ্ক শান্ত হয়। আয়াতের অর্থ এই যে, আমি রাত্রিকে আবৃতকারী করেছি, অতঃপর তাতে মানুষ ও প্রাণীদের উপর নিদ্রা চাপিয়ে দিয়েছি, যা তাদের আরাম ও শান্তির উপকরণ। - কুরতুবী
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন: তাঁর আরও নিদর্শন: রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তাঁর কৃপা অন্বেষণ। নিশ্চয় এতে মনোযোগী সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।-সূরা রোম:২৩
আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিদ্রাকে আল্লাহর নিদর্শন বলেছেন। দিনের আলোয় নিদ্রা আসা স্বভাবত কঠিন, আসলেও তা হয় ক্ষণিকের। অথবা কৃত্তিম উপায়ে অন্ধকার করতে হবে। যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মহান আল্লাহ তাআলা নিদ্রার উপযোগী করে রাত্রিকে অন্ধকারচ্ছন্ন ও আরামদায়ক করেছেন। পুরো পৃথিবী রাতের আঁধারে নিদ্রায় ঢলে পড়ে। যদি সকলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নিদ্রামগ্ন হতো তাহলে একজনের নিদ্রার সময় অন্যজন তার কাজে লিপ্ত থাকত, যার ফলে তার নিদ্রায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হতো। এবং নিদ্রার যে মূল উদ্দেশ্য তা বিঘিœত হত। তাই আল্লাহ তাআলা স্বীয় সর্বময় ক্ষমতা দ্বারা নিদ্রার জন্য একটি সময় বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। সকল জীব জন্তু এ সময় নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে তাদের ক্লান্তি দূর করে, শরীর হয় সতেজ ও উদ্যম। মহান আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহর এই নেয়ামত বান্দাকে স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:‘বলুন, ভেবে দেখ তো, আল্লাহ যদি দিনকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্য কে আছে যে, তোমাদেরকে রাত্রি দান করতে পারে, যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে ? তোমরা কি তবুও ভেবে দেখবে না’ ?-সূরা কাসাস:৭২
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাতের সাথে তার একটি উপকারিতা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘বিলাইলিন তাসকুনুনা ফিহি’ অর্থাৎ এমন রাত দিয়েছেন যাতে তোমরা আরাম,বিশ্রাম গ্রহণ করতে পার।
নিদ্রাহীন সময় কাটানোর পর ক্লান্ত লাগলে বোঝা যায় মানুষের রাতের ঘুম কতটা প্রয়োজন। কারণ মানুষ যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ মস্তিষ্কের কোষগুলো কাজ করে। মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ব্যাটারির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ব্যাটারি চার্জ দিয়ে ব্যবহার করার পর যেমন আবার নতুন করে চার্জ দিতে হয়, ঠিক তেমনি ঘুমের মধ্য দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কের সেলগুলো চার্জ হয়। তখন সকালে নতুন ব্যাটারির মতো মানুষও নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারে।
এজন্য পৃথিবীর প্রতিটি জীবকেই ঘুমাতে হয়। তা সে হাতি হোক, মাছি হোক আর এককোষী অ্যামিবাই হোক। কেউ টানা ঘুমায়। কেউ থেমে থেমে ঘুমায়। কুকুর ১৫ মিনিট ঘুমানোর পর ৫ মিনিট জেগে থাকে, আবার ঘুমায়। ডলফিন সাঁতার কাটতে কাটতে ঘুমায়। তখন তার মস্তিষ্কের এক অংশ ঘুমন্ত ও অন্য অংশ জেগে থাকে। কোনো কোনো পাখি উড়ে উড়ে ঘুমায়।
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে টানা কয়েকদিন রাত জাগলে শরীরের ভিতর এমন সব রোগ চেপে বসে যার ফলে তার জীবন হুমকির মুখে পড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ,ওজন বৃদ্ধি,মানসিক অবসাদ, হার্টের মারাত্মক ক্ষতি, আয়ু কমে যাওয়া, ব্রেনের পাওয়ার কমে যাওয়া, হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হওয়াসহ আরো নানান ভয় থাকে। তাই শরীরের এসব মারাত্মক ক্ষতি বাঁচাতে রাত না জাগার পরামর্শ দেন তারা।
কখনো কি ঘুম থেকে উঠে ভেবেছেন যে, সারারাত আমি মহান আল্লাহর নেয়ামতে ডুবেছিলাম। তিনি যদি ইচ্ছে করতেন তাহলে এ ঘুম থেকেই আমাকে নিয়ে যেতে পারতেন। ফিরিয়ে দিতেন না আমার প্রাণপাখিকে। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন: আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।-সূরা যুমার: ৪
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক জামিয়া বাবুস সালাম, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন