আবাসগৃহ হচ্ছে এমন একটি ছোট্ট রাষ্ট্র, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার মৌলিক উপাদান তথা স্বামী, স্ত্রী, পিতা ও মাতা এবং সন্তান-সন্তুতিকে অন্তর্ভুক্ত করে; যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত নিয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম। ইরশাদ হচ্ছে : “আর আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেন তোমাদের আবাসস্থল।” [সূরা নাহল, আয়াত: ৮০] আর এই ঘরের মর্যাদার কারণে ইসলাম তার বিষয় ও কার্যক্রমসমূহকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহকে তার মৌলিক উপাদান অনুযায়ী বণ্টন করেছে; বিশেষত স্বামী-স্ত্রীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি।আর বিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একটি সুদৃঢ় বন্ধন। যা উভয়েরই পারস্পরিক অধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই অধিকারগুলো হচ্ছে শারীরিক অধিকার, সামাজিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক অধিকার। তাই তাদের কর্তব্য যে, তারা সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবন যাপন করবে এবং কোনো প্রকার মানসিক অসন্তুষ্টি ও দ্বিধা ব্যাতিরেকেই তাদের যা কিছু আছে একে অন্যের জন্য অকাতরে ব্যয় করবে! আলোচ্য নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
মহান আল্লাহ তা’আলা বিয়ের স্থায়িত্ব পছন্দ করেন, বিচ্ছেদ অপছন্দ করেন। ইরশাদ হচ্ছে - ‘তোমরা কীভাবে তা (মোহরানা) ফেরত নিবে ? অথচ তোমরা পরস্পর শয়ন সঙ্গী হয়েছ এবং তোমাদের নিকট সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ২১] এ চুক্তিপত্র ও মোহরানার কারণে ইসলাম স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মাঝে কিছু দায়দায়িত্ব ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। যা বাস্তবায়নের ফলে দাম্পত্য জীবন সুখী ও স্থায়ী হয়। শরী‘আত এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি নজর দেয়, যাতে উভয় গৃহকর্তা তাদের কল্যাণকর সীমারেখার মধ্যে ব্যাপক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে দায়বদ্ধ থাকে। পবিত্র কোরআনুল করীমে ইরশাদ হচ্ছে- ‘যেমন নারীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমন তাদের জন্যও অধিকার রয়েছে ন্যায্য- যুক্তি সংগত ও নীতি অনুসারে। তবে (আনুগত্য এবং রক্ষনা-বেক্ষন ও অভিভাবকত্বের বিবেচনায়) নারীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব পুরুষদের। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা বাকারা, আয়াত : ২২৭] আর তা স্তর ও মানের ভিত্তিতে তিন প্রকার। প্রথমত: স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সমান। যেমন-
১. দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক সততা, বিশ্বস্ততা ও সদ্ভাব প্রদর্শন করা: যাদের মাঝে নিবিড় বন্ধুত্ব, অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক, অধিক মেলামেশা, সবচেয়ে বেশি আদান-প্রদান তারাই স্বামী এবং স্ত্রী। এ সম্পর্কের চিরস্থায়ী রূপ দিতে হলে ভাল চরিত্র, পরস্পর সম্মান, নম্র-ভাব, হাসি-কৌতুক এবং অহরহ ঘটে যাওয়া ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা এবং এমন সব কাজ, কথা ও ব্যবহার পরিত্যাগ করা অবশ্যম্ভাবী , যা উভয়ের সম্পর্কে চির ধরে কিংবা মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। তাই আল্লাহ তা›আলা ইরশাদ করেন- ‘তাদের সাথে তোমরা সদ্ভাবে আচরণ কর।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ১৮] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমাদের মাঝে যে নিজের পরিবারের কাছে ভাল, সেই সর্বোত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে ভাল।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ১৯৬৭] অন্যত্র ইরশাদ করেন -›শুধুমাত্র সম্মানিত লোকেরাই নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে। আর যারা অসম্মানিত, নারীদের প্রতি তাদের আচরণও হয় অসম্মানজনক।” [জামে তিরমিযী]
২. পরস্পর একে অপরকে উপভোগ করা: এর জন্য আনুষঙ্গিক যাবতীয় প্রস্তুতি ও সকল উপকরণ গ্রহণ করা। যেমন সাজগোজ, সুগন্ধি ব্যবহার এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ দুর্গন্ধ ও ময়লা কাপড় পরিহার ইত্যাদি। অধিকন্তু এগুলো সদ্ভাবে জীবন যাপনেরও অংশ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা বলেন-‘আমি যেমন আমার জন্য স্ত্রীর সাজগোজ কামনা করি, অনুরূপ তার জন্য আমার নিজের সাজগোজও পছন্দ করি।’ তবে পরস্পর এ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উভয়কেই হারাম সম্পর্ক ও নিষিদ্ধ বস্তু হতে বিরত থাকতে হবে।
৩. বৈবাহিক সম্পর্কের গোপনীয়তা রক্ষা করা: সাংসারিক সমস্যা নিয়ে অন্যদের সাথে আলোচনা না করাই শ্রেয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে উপভোগ্য বিষয়গুলো গোপন করা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন -‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সে ব্যক্তিই সর্ব নিকৃষ্ট, যে নিজের স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার পর এর গোপনীয়তা প্রকাশ করে বেড়ায়।‘ [সহিহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯৭]
৪. পরস্পর শুভ কামনা করা, সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়া: আল্লাহর আনুগত্য করা এবং দাম্পত্য জীবন রক্ষা করা উভয়েরই কর্তব্য। আর পরস্পর নিজ আত্মীয়দের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করাও এর অন্তর্ভুক্ত । ইরশাদ হচ্ছে - ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ব্যপারে পরস্পরকে সহযোগিতা কর।’ [সূরা মায়েদা, আয়াত : ২]
৫. সন্তানদের লালন-পালন ও সুশিক্ষার ব্যাপারে উভয়েই সমান, একে অপরের সহযোগী।
দ্বিতীয়ত, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য: সুখকর দাম্পত্য জীবন, সুশৃঙ্খল পরিবার, পরার্থপরতায় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অটুট রাখার স্বার্থে ইসলাম জীবন সঙ্গিনী স্ত্রীর উপর কতিপয় অধিকার আরোপ করেছে। তন্মধ্যে নিম্নোক্ত কয়েকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১. স্বামীর আনুগত্য: স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর কর্তব্য। তবে যে কোন আনুগত্যই নয়, বরং যেসব ক্ষেত্রে আনুগত্যের নিম্ন বর্ণিত তিন শর্ত বিদ্যমান থাকবে। যথা: (ক) ভাল ও সৎ কাজ এবং শরীয়তের বিধান বিরোধী নয় এমন সকল বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যদি আমি কোনো মানুষকে অপর কারও জন্য সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তবে মহিলাকে তার স্বামীকে সিজদা করতে নির্দেশ দিতাম।” [সুনানে [ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৮৫৩; জামে তিরমিযি, হাদীস : ১১৫৯] তবে শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াবলীতে স্বামীর আনুগত্য করবে না। বরং স্বামীকে বুঝানোর চেষ্টা করবে। ইরশাদ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন সৃষ্টির আনুগত্য বৈধ নয়। [জামে তিরমিযি]
(খ) স্ত্রীর সাধ্য ও সামর্থ্যের উপযোগী বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করা। এ ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছ- ‘আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তার সাধ্যের বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্বারোপ করেন না। অন্য হাদীসে এসেছে,‘যদি কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে তার সাথে শয্যাশায়ী হতে আহ্বান জানায় এবং যদি উক্ত স্ত্রী তা অস্বীকার করে এবং স্বামী তার ওপর রাগাম্বিত অবস্থায় রাত কাটায়, তাহলে সকাল পর্যন্ত ফিরিশতাগণ তার ওপর অভিশম্পাত বর্ষণ করেন’। [সহিহ বুখারি, হাদীস:৩২৩৭]
(গ) যে নির্দেশ কিংবা চাহিদা পূরণে কোন ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, সে ব্যাপারে স্বামীর আনুগত্য করা আবশ্যক করে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন - ‘নারীদের উপর পুরুষগণ শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী।’ [সূরা বাকারা, আয়াত : ২২৭] অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘পুরুষগণ মহিলাদের অভিভাবক এবং দায়িত্বশীল। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের একের ওপর অন্যদের বিশিষ্টতা দান করেছেন এবং যেহেতু পুরুষগণ তাদের সম্পদ থেকে তাদের স্ত্রীদের জন্য ব্যয় করে থাকে।” [সূরা নিসা, আয়াত : ৩৪] উপরন্তু এ আনুগত্যের দ্বারা বৈবাহিক জীবন স্থায়িত্ব পায়, পরিবার চলে সঠিক পথে। আর স্বামীর কর্তব্য, এ সকল অধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করা। স্ত্রীর মননশীলতা ও পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে সত্য- কল্যাণ ও উত্তম চরিত্রের উপদেশ প্রদান করা কিংবা হিতাহিত বিবেচনায় বারণ করা। এক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ ও উন্নত মননশীলতার পরিচয় দেয়া । ফলে সানন্দ চিত্তে ও স্বাগ্রহে স্ত্রীর আনুগত্য পেয়ে যাবে। (চলবে)
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন