“আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেস্তারা নবীর উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করে, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ও তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠাও”। (সূরা ঃ আহ্সাব-৫৬-আয়াত)
রাসূল (সাঃ) বলেছেন ঃ “যদি তোমরা, আমার উপর দরূদ পাঠ কর; তবে উত্তম এবং সুন্দর দরূদ পাঠ কর।” (হাদীস শরীফ) “আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যারা তাঁকে ভালবাসে।” (সূরা মায়িদা ৫৪-আয়াত)
আর এ ভালবাসা ‘রাসূল-প্রেম’ ছাড়া-অর্জিত হতে পারে না। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা পরিপুর্ণ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষন না আমি তোমাদের নিকট, তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পত্তি অপেক্ষা বেশী প্রিয় হই”। (বুখারী শরীফ) “দরূদ-সালাম ও রাসূল প্রেম” - এ তিনটি কথা একটা অন্যটার সাথে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। যেমন ঃ একটা কাঁচির দুইটা পাত। আল্লাহ নিজে রাসূল প্রেমিক। তাঁর রাসূল প্রেম থেকেই দরূদ ও সালাম এর সূচনা। যার রাসূল প্রেম যত গভীর তার দরূদ ও সালাম তত সুন্দর ও মর্মস্পর্শি। আর, আল্লাহর প্রতি তার ঈমান (বিশ্বাস) তত দৃঢ় ও মজবুত। প্রেম ও ভালবাসা তত বেশী।
দরূদ শরীফ অর্থ ঃ ”দরূদ শরীফ এর আরবী নাম ‘সালাত’। ‘দরূদ’ শব্দটি শব্দটির উৎপত্তি ‘দরদ’ শব্দ হতে। প্রেম ময় (আল-ওয়াদুদ) দরদী আল্লাহ্ তাঁর প্রেমের নূরে প্রথম সৃষ্টি আহ্মদ বা মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর প্রেম আর দরদের সাথে প্রথম দরূদ পড়ার সূচনা করেন সে এক অজানা সময় ও স্থান হতে। এভাবে বহু বছর অতিবাহিত হবার পর আল্লাহ এতে শরীক করে নিলেন ফেরেস্তাদের। তাই, হযরত জিব্রাইল (আঃ), হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর নিকটে বর্ণনা করেন-ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার জন্মের পর এক সহস্র বছর পর্যন্ত একই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু কি যে করবো, তা কিছুই স্থির করতে পারি নাই। এমন সময় খোদা তায়ালা আমাকে “হে জিব্রাঈল! বলে ডাক দিলেন। তখন আমার নাম যে ‘জিব্রাঈল’ তা বুঝতে পারলাম। আমি “লাব্বায়েক-লাব্বায়েক” বলে উত্তর দিলাম। তাতে খোদা তায়ালা, বললেন ঃ “হে জিব্রাঈল। তুমি, আমার পবিত্রতা বর্ণনা কর; আমি তোমাকে সৃজন করেছি।
সৃষ্টিকর্তার জেকের ও প্রশংসা করতে করতে আমার দশ হাজার বছর কেটে গেল, তখন ‘লওহে মাহ্ফুজে’ লিখা-“লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু-মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কলেমাটি দেখে পাঠ করলাম এবং চিন্তা করলাম প্রতিপালক এর নামের সাথে এটা কার নাম-একই সাথে বিজড়িত রয়েছে? তখন আল্লাহর তরফ হতে প্রত্যাদেশ হ’ল “লাওলাকা লামা খালাক্তুল-আফ্লাক”-অর্থাৎ আমি এ পিয়ারা নবীকে যদি সৃষ্টি না করলাম তাহলে কোন কিছুই সৃজন করতাম না।” হযরত জিব্রাঈল বললেন, “হে আল্লাহর হাবীব! আমি আপনার এই উচ্চ মর্যাদার কথা শুনে আবার আমি দশ হাজার বছর পর্যন্ত কেবল আপনার উপর দরূদ শরীফ পড়তে থাকি। ঐ দরূদ পড়ার বরকতে আমার অন্তঃকরণ অতি সমুজ্জল হয়ে যায় এবং হৃদয়ে এক অপূর্ব শান্তি লাভ করি।” (দ্রঃ মজমুয়ে ওয়াজ শরীফ) মৌঃ আজহার আলী। আল্লাহর প্রিয় হাবীব ও আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) এর সম্মানীত বংশধর ও পরিবার বর্গের প্রতি রহমত নাজেল হবার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার নাম ’দরূদ’।
জনাব, জি.এম.এ হামিদ তার লেখা প্রবন্ধ ঃ “মহানবীর (সাঃ) উর্দ্ধলোক ভ্রমণ ঃ অনন্য বিষ্ময়কর সম্মান না” তে লিখেছেন, যখন রাসূল (সাঃ) আল্লাহর আরশে আজিমে পৌঁছান; তখন উনি একা তাই তিনি একাকিত্ব অনুভব করলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এর আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং শান্ত হলেন। আর একটা আওয়াজ ও শুনলেন ঃ “হে প্রিয় মোহাম্মদ (সাঃ) আপনি থামুন; আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।’ আল্লাহর নিকট পৌঁছে এ দু’টো বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলে, আল্লাহপাক বন্ধু দয়াল নবীজি (সাঃ) কে বললেন, “আমার সালাত অর্থ আপনার ওপর দরূদ পাঠ করা। আর আবু বকরের সুরতে এক ফেরেশ্তা সৃষ্টি করে তার আওয়াজ নকল করা হয়েছিল যেন আপনি শান্ত হন।” (২০-০৮-২০০৬) দৈনিক ইনকিলাব।
রাসূল (সাঃ) কে সৃষ্টির পর হতে অনাদিকাল পর্যন্ত রহমত বরকত ও মহব্বতের এই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতিটি চলে আসছে এবং চলতে থাকবে। প্রেমময় আল্লাহ তার এ শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে যেভাবে স্মরণ করে থাকেন এবং তার উপর রহমত ও বরকত বর্ষণ করে যাচ্ছেন এ শ্রেষ্ঠ পদ্ধতিকে তিনি তার প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে জানিয়ে দিতে চাইলেন। সেই সব মানুষকে যারা আল্লাহ ও রাসূলকে বিশ্বাস করে এবং ভালবাসে। যাতে মানুষ এ সুন্দর পদ্ধতিটি অনুসরণ করে নিজেদের মধ্যে রাসূল প্রেম সৃষ্টি করতে পারে এবং বিনিময়ে শান্তি ও মুক্তি পেতে পারে। কারণ; আল্লাহ তার বান্দাদের খুব ভালবাসেন।
দরূদ শরীফ পড়া মূলতঃ প্রেমিক আর প্রেমাস্পদের বিষয়। তাই প্রেমিক উম্মত যদি প্রেমের সাথে তার প্রেমাস্পদ রাসূল (সাঃ) এর জন্য দরূদ পাঠ করে তাহলে এর যে কি বিনিময় তা কেবল তার প্রেমাস্পদই জানবেন। আল্লাহ দান করবেন। প্রেমিকের মূল্যায়ন তো সাধারণ বিষয় নয়। দরূদ ও সালাম পাঠের মাধ্যমে প্রেমিক তার প্রেমের স্তরের গভীরতা অনুযায়ী তার প্রেমাস্পদের নিকট হতে এর পুরস্কার পাবে। দান করবেন দয়ালু দাতা আল্লাহ।
রাসূলের শাফা’য়াত ছাড়া আমাদের মুক্তির কোন পথ নেই। তিনি আমাদের প্রতিটি কঠিন বিপদের সময়ের বন্ধু ও নাজাত দানকারি। আমাদের উপর রাসূল (সাঃ) এর তিনটি হ’ক আছে। যথা ঃ ১. সর্ব বিষয়ে তাঁকে অনুসরণ করা ও তাঁর আদেশ পালন করা। ২. তাঁকে সর্বাধিক ভালবাসা। ৩. তাঁকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করা-সম্মান করা। অনেকে সেটা কেবল মৌখিক করাটাই যথেষ্ট মনে করেন। তাঁকে অন্ধ অনুসরণ-নয়, তাঁর সাথে সত্যিকার ভালবাসা রাখা এর জন্য জ্ঞান অর্জন করা। কেবল শরীয়তি জ্ঞান নয়, মারিফাত জ্ঞান ও। বারো শরীফের ইমাম (রঃ) এর কথায়- “শরীয়ত ধারণা দেয়; মারিফাত দেয় পরিপূর্ণতা।”
দুঃখ জনক হলো তাঁকে যেভাবে ভালবাসা দরকার, ভক্তি ও শ্রদ্ধ করা দরকার তা আমাদের অনেকের মাঝে নেই। তাই-বারোশরীফের সূফী সাধক আওলাদে রাসূল, প্রেমিক হযরত শাহ্ সূফী মীর মাস্উদ হেলাল (রঃ) বলেছিলেন-“মোহাম্মদ (সাঃ) সে কি জিনিস তা যদি জানতে চাও তো আল্লাহর ওলীকে জিজ্ঞাসা কর।” প্রেম-ভালবাসার ধর্ম হ’ল প্রেমিক তার প্রেমাস্পদকে একটি মুহূর্ত ও ভুলে থাকতে পারে না। অথচ আমাদের জন্য তার যে কত দরদ, তিনি যে; আমাদের কম বড় দরদী বন্ধু; তা কোরআন, হাদীস ও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তাই, আমাদেরকে দরূদ ও সালাম পাঠ করতে হবে দরদী বন্ধুর জন্য দরদের সাথে। চোখ বন্ধ করে সবুজ গম্বুজ শরীফ খেয়াল করে। মন-প্রাণ উজাড় করে। প্রেমিক সাধক ইমাম (রঃ) বলতেন-মিলাদ মাহফিল শুরুর পূর্বে “দ্বিল-চিশ্নিছে পড়না চাহিয়ে।” (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন