আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর প্রথম সৃষ্টি নূরে মোহাম্মদী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মানব ছুরতে পৃথিবীতে শুভাগমনের দিন ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব মানব সভ্যতা ও মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন, স্মরণীয় বরণীয় মুহূর্ত। এই নূর মুবারক থেকেই সৃষ্ট জগতের দৃশ্য অদৃশ্য সমস্ত কিছু সৃজন করেছেন পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা‘আলা। এই নূর মুবারক সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ্ সৃষ্টি জগতের সূচনা করেন এবং তাঁকে নবুয়ত ও রিসালতে অভিষিক্ত করে নবুয়ত ও রিসালতের সূচনা করেন। ‘প্রিয়নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন ফরমান: আমি রসুলগণের ভ‚মিকা এবং নবীদের উপসংহার।’’ কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে: স্মরণ করুন, আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, ‘তোমাদের আমি (আল্লাহ্) কিতাব ও হিকমত দিয়েছি, অতঃপর তোমাদের (নবী) কাছে যা কিছু আছে তাঁর সমর্থকরূপে একজন রসূল আসবেন তখন নিশ্চয়ই তোমরা তাঁকে বিশ্বাস করবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে, তিনি (আল্লাহ্) বলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? তাঁরা (নবীগণ) বললেন, আমরা স্বীকার করলাম, তিনি (আল্লাহ্) বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম।’’ [সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত-৮১]
বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট নতুন সুসমাচারে প্রিয়নবীর শুভাগমনের আগাম সংবাদ বিধৃত হয়েছে এভাবে: যোহন (ঈসা আ.) বলেছেন, There is one that comes after me who is stronger than I, the lace of whose sheos I am not worthy to untie, he will baptise you with the spirit and with the fire : আমার পরে এমন একজন আসছেন, যিনি আমার চেয়ে অধিক বলবান, তাঁর জুতার ফিতা খুলে দেয়ার যোগ্যতাও আমার নেই। তিনি তোমাদের ব্যাপ্টাইজ করবেন, মনন ও দ্যুতি দ্বারা। [jhon---1, 26, 21] যিশু (ঈসা আ.) বলেন, I will pray the father he shall give you another comforter that he may abide with you for ever.. আমি আমার স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করবো এবং তিনি তোমাদের আরেকজন সান্ত¦নাদাতা দেবেন, যেন তিনি (মুহাম্মদ) তোমাদের সাথে চিরকাল থাকেন।’ তিনি (যিশু) আরো বলেন, যা হোক, যখন সে সত্য আত্মা আসবেন, তিনি তাবৎ সত্যের দিকে পরিচালিত করবেন। কেননা তিনি নিজের থেকে কিছু বলবেন না, তিনি যা শুনবেন, কেবল সেটাই বলবেন [jhon, xv1, 13]
পবিত্র কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে: তিনি (নবী), নিজের থেকে কিছু বলবেন না, এটা তো ওহী যা তাঁর কাছে প্রত্যাদেশ করা হয়। [সূরা নজম: আয়াত-৩-৪]
আল্লাহ্ আরো বলেন, ‘হে রসূল, আমি আপনার খ্যাতিকে বুলন্দ করেছি। [সূরা আলাম নাশরাহ্, আয়াত-৪]
যার নূর মুবারক সৃষ্টি করে আল্লাহ্ বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীতে নবী-রসূল আগমনের ধারাবাহিকতায় যাঁর পৃথিবীতে সবার শেষে আগমন ঘটেছে এবং নবী-রসূল আগমনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, ইসলামের পূর্ণতা এসেছে এবং যিনি সৃষ্টির জন্য ফজল ও রহমত সেই প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র পৃথিবীতে আগমনের শুভদিনটির মতো খুশীর দিন আর কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দুরূদ পেশ করেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর (নবী) প্রতি দুরুদ পেশ কর এবং তাঁকে যথাযথ তাজিমের (শ্রদ্ধা) সাথে সালাম জানাও। [সূরা আহযাব, আয়াত-৫৬]
আল্লাহর নির্দেশের বাস্তবায়ন ঘটে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) পালনের মাধ্যমে, মিলাদ মাহফিল ও কিয়ামের মাধ্যমে। হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, আল্লাহর নিকট দোয়া কবুলের প্রধান শর্তই হচ্ছে তাতে দুরূদ শরীফ থাকতে হবে যেমন আমরা নামাজে নবীকে দুরুদ ও সালাম জানাই যা বাধ্যতামূলক। যে কারণে বছরব্যাপী মিলাদ মাহফিল কিয়াম আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর মিলাদ কিয়াম সাহিত্য গড়ে উঠেছে, বহু ক্বসীদা রচিত হয়েছে। ঈদ-এ মিলাদুন্নবীর যথার্থ উপলব্দি ও আত্মস্থ করা প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানের কর্তব্য ও ঈমানী দায়িত্ব। কারণ নবীপ্রেম ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ অসম্ভব। এত কিছুর পরেও একটি অতি প্রাচীন পদ্ধতি যা প্রিয়নবীর শুভাগমনের সময় থেকে শুরু হয়েছে তা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। এ রকম একটা পদ্ধতির পুনরুজ্জীবিত করলেন মুজাদ্দিদে জমান হাদীয়ে দ্বিন ও মিল্লাত আওলাদে রসূল (৩৯) হযরত আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)। তিনি ১৯৭৪ সালে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন ১২ রবিউল আউয়াল জশনে জুলুছে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী উদযাপন করতে। জশনে জুলুছ’র আভিধানিক অর্থে ‘জশন’ শব্দের অর্থ খুশী/উৎসব, ‘জুলুছ’ শব্দটি জলসা শব্দের বহুবচন, অর্থ বসা বা উপবেশন, নামাজ আল্লাহর যিকিরের জলসা, একই স্থানে দাঁড়িয়ে/বসে সম্পন্ন করা হয়। ‘হজ্ব’ হলো আল্লাহর যিকিরের ‘জুলুছ’ যা এক বৈঠকে শেষ করা যায় না। কুরআন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় তাবুতে সকীনা ফেরেশতাগণ জুলুছ সহকারে এনেছিলেন। প্রিয় নবী হিজরত করে মদীনা প্রান্তে পৌঁছলে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ‘ইয়া মুহাম্মদ, ইয়া রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলে স্লোগানের সাথে মিছিল সহকারে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। নবীর শুভাগমনের দিন মা আমেনার গৃহাভিমুখে ফিরিশতারা মিছিল সহকারে আগমন করেন। প্রতিদিন ৭০ হাজার ফিরিশতা দিবারাত্রি প্রিয়নবীর রওজা মুবারক প্রদক্ষিণ করে সালাম জানায় যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। হুজুর তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)’র নির্দেশনা সঠিক ও শরীয়তসম্মত। ১৯৭৪ সালে আনজুমান ট্রাস্ট নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে হাজার খানেক নবীপ্রেমিকের সেই জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক বিশাল মহীরুহ হয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সারা রবিউল আউয়াল মাসে জশনে জুলুছ উদযাপন হচ্ছে। ১৯৭৬-৮৬ সাল পর্যন্ত আউলাদে রসূল (৩৯) সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.) এবং ১৯৮৭-২০১৯ সাল পর্যন্ত আওলাদে রসূল (৪০) গাউসে জমান সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.)’র নেতৃত্বে জশনে জুলুছ বের হয়ে আসছে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় এবং অঙ্গসংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র সার্বিক সহযোগিতায়। জশনে জুলুছ ৪৬ বছর উদযাপিত হয়ে আসছে এবং কিয়ামত তক উদযাপিত হতে থাকবে যা বিশ্বময় বিস্তৃতি লাভ করবে ইন্শা-আল্লাহ্। দেশি-বিদেশী মিডিয়া ভাষ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের চট্টগ্রামের জশনে জুলুছে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-জুলুছে পঞ্চাশ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন যাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুছ বললে অত্যুক্তি হবে না। যা UNESCO Heritage -এর অনুর্ভুক্ত হওয়া সময়ের দাবী। এ বছর মহামারী কোভিড-১৯’র কারণে সরকারি নির্দেশনা থাকায় এবার জুলুছ’ হবে না, শুধুমাত্র সংক্ষিপ্তাকারে মিলাদ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ মহান দিবসে যেন প্রাণপ্রিয় নবী রহমাতুল্লালি আলামিন’র সন্তুষ্টি অর্জনে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে নিজেকে সমর্পণ করতে পারি সে দোয়াই করি আল্লাহর নিকট।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন