শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

ওলিদের আল্লাহপ্রেম

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

আল্লাহর ওলিগন আল্লাহর ভালবাসা এমন ভাবে অন্তরে লালন করেছেন যেন আল্লাহ তায়ালাকে ছাড়া তাদের আর কোন পরোয়া নেই, আল্লাহ তায়ালাকে ছাড়া আর কারো প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তায়ালাকে ছাড়া কারো প্রতি কোন ভালবাসা নেই। সব প্রয়োজন, ভালবাসা, চাওয়া- পাওয়া শুধু একমাত্র মাওলাকে লক্ষ্য করেই। তাদের এই ভালবাসা, এই একিন, এই দরদ, এই চিন্তা মহান রবের পথে আমাদের চলতে উদ্ভুদ্ধ করে। মন শীতল করে।
আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুর সাথে দুশমনি রাখবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করব। আমি আমার বান্দার উপর যা ফরজ করেছি, তা দ্বারা কেউ আমার নৈকট্য লাভ করতে পারবে না। আমার বান্দা সব সময় নফল দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমন করে অবশেষে তাকে আমার প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই আমি তাকে ভালবাসি। আর আমি যখন তাকে ভালবাসি তাকে প্রিয় বানিয়ে নেই তখন আমি তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, আমি তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে হাটে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায় আমি তা তাকে দ্না করি। আর যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে দ্বিধা করি না। যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি। (সহিহ আল বুখারী হাদিস নং ৬৫০২)
হযরত শায়খ ফাতাহ রাহঃ বলেন, একবার পথ চলতে এক জনমানবহ’ীন জায়গায় এক বালকের সাক্ষাত পেলাম। সে স্বাভাবিক গতিতে পথ চলছে এবং তার দুটো ঠোট নড়তেছে। আমি তার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম বেটা তুমি কোথায় যাইতেছ? সে বলল চাচা আমি বাইতুল্লায় যাইতেছি। আমার জিজ্ঞাসা করলাম ঠোঁট নেড়ে কী করছ? সে জবাব দিল কোরআনুল কারীম তেলাওয়াত করছি। আমি বললাম এই বয়সেই তুমি ইবাদত বন্দেগী করতে করতে শুরু করেছ? সে বলল চাচা আমার চেয়ে কম বয়সী লোকওতো মারা যায়। আমি তাকে বললাম এত দীর্ঘ পথ তুমি কিভাবে পাড়ি দেবে? সে জবাবে বলল আমার কর্তব্য পথে বের হওয়া, গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব মহান আল্লাহ তায়ালার। তাপপর আমি তাকে সফরের সামান ও বাহনের কথা জিজ্ঞাস করলাম সে জবাব দিল সফরের সামান হল আমার ইয়াকীন আর বাহন হল আমার দুই পা। আমি তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম তোমার আহারের ব্যবস্থা কী করে হবে। সে বলল চাচা আপনি কাউকে আপনার বাড়িতে দাওয়াত করলেন আর এরূপ অবস্থায় আপনি কি ইহা পছন্দ করবেন যে মেহমান তার খাবার নিয়ে আপনার বাড়িতে আসুক? আমি বললাম, না। সে তখন বলল চাচা যাদের আল্লাহর উপর এক্বিন কম তারা খাবার বহন করে কাবার দিকে রওয়ানা হয়। আমি আল্লাহ তায়ালার মেহমান হয়ে খাবার নিয়ে যেতে লজ্জাবোধ করছি। আপনার কি মনে হয় যে, আল্লাহ তাঁর মেহমানকে দাওয়াত করে তাকে ক্ষুধার্ত রাখবেন? এই কথা বলে বালকটি চলে গেল। পরে আমার কাবার নিকটে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে তখন আমাকে বলে যে, চাচা এখনও আপনার এক্বিন দুর্বল রয়েছে।
হযরত আবু আব্দুল্লাহ ক্বারাশী রাহঃ বলেন, একবার অমুসলিম সৈনিকগন স্পেন শহরে প্রবেশ করে বিনা যুদ্ধে শহর দখল করে নিল। শহর দখল করার পর তারা ব্যাপক হারে মুসলমানদের গ্রেফতার করে নির্যাতন শুরু করল। এক পর্যায়ে সংবাদ পাওয়া গেল যে, বন্দিগনকে দীর্ঘ অনাহারে রাখার পর তাদেরকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে আস্তাবলে নিয়ে পশুর মত ঘাস খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। হযরত আবু আব্দুল্লাহ ক্বারশী রাহঃ বলেন, এই সময় আমি শায়েখ আবু ইসহাক ইবনে তারিফ রাহঃ সাথে অবস্থান করতেছিলাম। আমাদের সঙ্গে তিনি খানার মসলিসে বসা ছিলেন। এমন সময় বিছমিল্লাহ বলে তিনি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি কি জান যে আমাদের স্পেনের মুসলামান ভাইদের উপর এক অবর্ণনীয় নির্যাতন চলতেছে। আমি জবাবে বললাম হ্যাঁ, আমি এই ঘটনা শুনেছি। শায়খ কেঁদে কেঁদে এই ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন। শেষে তিনি শব্দ করে চিৎকার করে উঠলেন। আমরা শায়েখের দিকে চেয়ে আছি। আমাদের অন্তর জ্বালা বেড়ে যেতে লাগল। সকলের চোখেই পানি এসে গেল। শায়েখ কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ যতক্ষণ তুমি স্পেনের মুসলমানদের এই নির্যাতন থেকে মুক্ত করবে না, আমিও ততক্ষণ তোমার আহার গ্রহন করব না। এই কথা বলে তিনি খাবার মসলিস থেকে উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি হাসিমুখে আলহামদুলিল্লাহ পড়তে পড়তে ফিরে আসলেন এবং আমাকে বললেন, খেতে বস। আমি নিরবে খেতে বসলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম একটু সময় আগে তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে খানা ত্যাগ করলেন। কিন্তু কিভাবে এখন আবার খেতে বসলেন? পরবর্তীতে আমি জানতে পারলাম শায়খ যখন আহার গ্রহণ করেছেন তার ঠিক পূর্বে স্পেন দখলকারী অমুসলিম সৈনিকরা এক বিকট শব্দ শোনতে পায় এবং তারা ভীত হয়ে পড়ে। তারা মনে করে মুসলিম সৈনিকগন বিরাট দলে তাদের উপর আক্রমন করেছে। মুসলিম সৈনিকগন স্পেন উদ্ধার করতে চলে এসেছে। এই চিন্তায় তারা সব কিছু ফেলে যে যেদিকে সম্ভব পালিয়ে গেল। মুসলমানগন আল্লাহর ইচ্ছায় বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেল এবং কাফেরদের সকল রসদ, অস্ত্র লাভ করল।
হযরত জুন্নুন মিশরী রাহঃ বলেন, আমি একদিন লাকাম পাহাড়ের নিকট ঘুরাঘুরি করতে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম এক ব্যক্তি লাকাম পাহাড়ের নিকট দাড়িয়ে নামাজ আদায় করছে। তার আশেপাশে বন্য প্রাণীরা বসে আছে। আমি তার দিকে অগ্রসর হলাম। আমাকে দেখে বন্য প্রাণীরা চলে গেল। শায়েখ নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন হে আবুল ফয়েজ তোমার অন্তর যদি পরিস্কার হত তবে বন্য প্রাণীরাও তোমার সন্ধান করত। এই পাহাড়ও তোমার প্রতি আকৃষ্ট হত। আমি তাকে বললাম, অন্তর পরিস্কারের অর্থ কি? তিনি জবাব দিলেন, তুমি আল্লাহর এমন নেক বান্দা হয়ে যাও যেন আল্লাহ তায়ালাও তোমাকে ভালবাসতে থাকেন। আমি তাকে বললাম তা কিভাবে হাসিল হবে? তিনি জবাবে বললেন, তোমার অন্তর থেকে যেভাবে শিরিক দূর করেছ ঠিক সেভাবে মাখলুকের মোহাব্বত দূর করে দাও। তখন তুমি এই মর্যাদা লাভ করতে পারবে। যতক্ষন সৃষ্টির মোহাব্বত তোমার অন্তরে থাকবে ততক্ষণ এই মর্যাদা লাভ করতে পারবে না। আমি বললাম আমার জন্য তা অনেক কষ্টসাধ্য। তিনি বললেন যারা আল্লাহ তায়ালার পরিচয় জেনে গেছে তাদের জন্য তা খুবই সহজ।
হযরত মনসুর ইবনে আম্মার রাহঃ দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন মানুষদের ইমানের পথে ডাকতেন, দ্বীন শিক্ষা দিতেন। একদিন তিনি মিশর রওয়ানা হলেন। মিশর গিয়ে দেখলেন সেখানে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ চলছে। বৃষ্টি নেই। মাঠের সব ফসল পুড়ে গেছে। পশুর খাবারও নেই। সব দিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার। মানুষজন আল্লাহর দরবাবে কান্নাকাটি করছে। মানসুর রাহঃ মসজিদের মাঝামাঝি এলেন, আল্লাহর তায়ালার হামদ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দরুদ পড়লেন, লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ভাই সকল, সকলে যার যার তৌফিক অনুযায়ী সদকা কর। সদকার মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করে থাকে। বিপদ দূর হয়ে যায়। এই বলে তিনি তার চাদর বিছিয়ে দিলেন আর বললেন, এই হল আমার অভাবের আঁচল। তোমরা সবাই দান করো। শায়েখের কথায় ছিল সম্মোহনি শক্তি। সাথে ছিল আল্লাহর প্রেম। মানুষজন দান করতে লাগল। মহিলারা তাদের অলংকার পর্যন্ত দান করে দিল। এক পর্যায়ে চাদর ভরে গেল। রহমেতের বৃষ্টিও শুরু হল। মানুষের মুখে আনন্দের হাসি দেখা গেল। সকলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে লাগল।
হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাঃ কে যখন হাত পা বেঁধে বেত্রাঘাত করা হচ্ছিল হঠাৎ তার পাজামার নেয়ার ছিড়ে নিচের দিকে চলে যাচ্ছিল। নিরুপায় ইমাম রাহঃ আকাশের দিকে মুখ করে মৃদুকন্ঠে বলতে লাগলেন, মাওলা আমার অসহায়ত্ব তুমি জান, আমার অবস্থা তুমিতো দেখছ। দয়া করে জনসমক্ষে আমাকে লজ্জিত করোনা। লোকেরা আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগল যে পাজামা নিজে নিজেই উপরে উঠে যাচ্ছে এবং কোমরে শক্ত ভাবে আটকে গেছে।
হযরত জাফর আবু গালিব রাহ বলেন, হযরত ঈসা আঃ এর উপদেশ ছিল , পাপিষ্ঠরা ক্রোধাম্বিত হলেও তোমরা আল্লাহর নিকট প্রিয় হও। তারা ঘৃণা করলেও তোমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হও। তাদের অসুন্তুষ্টির মাঝেও তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি খোঁজে নাও। হাওয়ারীগন বললেন হে আল্লাহর নবী তাহলে আমরা কার সাথে উঠাবসা করব। তিনি জবাব দিলেন, যার প্রভাবে তোমার আমলের পরিধি স¤প্রসারিত হয়, যাকে দেখলে তোমার আল্লাহর কথা মনে হয়, যার কাজকর্ম দেখলে তোমার দুনিয়ার আসক্তি কমে যায় তাদের সাথে উঠাবসা করবে।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন