নিত্যপণ্যের বাজারে সক্রিয় অসাধু সিন্ডিকেট। পেঁয়াজে নৈরাজ্যের পর চাল, আলু ও ভোজ্যতেল নিয়ে চক্রটিা কারসাজি চলছে। হু হু করে বাড়ছে দাম। এসব পণ্যের দাম নাগালে রাখতে সরকার বার বার মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তা বাজারে কার্যকর হচ্ছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বেশি দামেই এসব ভোগ্যপণ্য বিক্রি করছেন। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। যথাযথ তদারকির অভাবে সুযোগ পেলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কেটে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করা হলেও তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ২৩ অক্টোবর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার সিন্ডিকেটের কাছে হেরে যাচ্ছে, এ কথাটি ঠিক নয়’। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ অতি জরুরি। বর্তমানে আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, তেল ও চালসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। এমনিতেই করোনায় অনেকের আয় কমে গেছে, কেউ বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেমে এসেছে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এতে করে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, আলু, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মধ্যবিত্ত সমাজ। বিশেষ করে নির্ধারিত আয় যাদের তারা খুবই করুণ জীবনযাপন করছেন। পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগও চরম আকার ধারণ করছে। করোনাভাইরাসের কারণে অনেকের আয়ের উৎস কমে গেছে, কারো আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক চাকরিজীবীর বেতন-ভাতা কমেও গেছে কিংবা অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিটা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং উদ্বেগজনক। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, সরকার কোনোভাবেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। মাঝে মাঝে মোবইলকোর্ট পরিচালনা করে ১/২ জনকে জরিমানা করলেও তা কোনো কাজে আসছে না। কারণ হাজার হাজার লোকের মাঝে ১/২ জনকে জরিমানা করলে কি আসে যায়? বরং জরিমানার পর তারা আবার দাম বাড়িয়ে তা পুষিয়ে নেয়। ফলে মোবাইল কোর্ট কোনো সমাধান না। সমাধান হলো সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিং করতে হবে। সরকারকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সব ধরনের সিন্ডিকেট পরিচালনাকারীদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। এই ধরনের কঠোর অবস্থান না নিলে তা কোনো কাজে আসবে না। এদিকে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আলুর বাজার স্থিতিশীল করতে মজুদদারদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোনো মজুদদারের কাছে দ্বিগুণ আলু মজুদ থাকলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিমাগারে রাখা আলুর মজুদের তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ২৭ অক্টোবর জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে। চিঠি পাওয়ার দুই দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলায় কী পরিমাণ আলু মজুদ আছে, সে তথ্য দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে মিল পর্যায়ে চালের দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা মানা হচ্ছে না। গত ১ মাস ধরে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে কারসাজি রোধে দু’দফায় আলুর দাম নির্ধারণ করার পরও সংশ্লিষ্টরা কার্যকর করতে পারেননি। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম সরকার ৩৫ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। এতে প্রতি কেজি আলু কিনতে ভোক্তাকে ১৫ টাকা বেশি গুনতে হয়েছে। এছাড়া ২২ অক্টোবর বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকের পর মিল পর্যায়ে সরকার ভোজ্যতেলের দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর হয়নি। এতে পাইকারি বাজারে দাম কমার প্রভাব না পড়ায়, খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১০০ টাকায় ঠেকেছে। সরকার মিল পর্যায়ে খোলা সয়াবিনের দাম ৯০ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। গতকাল মিলগেটে প্রতি লিটার সয়াবিন ৯২-৯৩ টাকায় বিক্রি হয়। আর পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা লিটার। রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে প্রতি লিটার ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। এক মাস আগেও যা ছিল ৯০ টাকা। প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ৮২ থেকে ৮৬ টাকার মধ্যে। পাম অয়েলের দাম ছিল প্রতি লিটার ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে থাকে। অক্টোবরের শেষ পর্যায়ে এসে খুচরায় সয়াবিন তেল ৯৭ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাম অয়েলও বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম ১৬ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ৩২ শতাংশ বেড়েছে।
দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর প্রথম থেকেই মিলাররা কারসাজি করে সব ধরনের চালের দাম বাড়াতে থাকে। মাঝে কিছুটা কমলেও ২ মাস আগে আবারও বাড়তে থাকে দাম। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন পর্যাপ্ত চাল থাকার পরও আড়তদার এবং মিলাররা কারসাজি করে চালের দাম বৃদ্ধি করছে। মিলারদের কারসাজি রোধে এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বৈঠক করে দাম নির্ধারণ করেন। এতে সবচেয়ে ভালো মানের ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম (মিলগেট) ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের মধ্যে বিআর-২৮ চালের দাম ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত এ মূল্যে কেউই চাল বিক্রি করছে না। গতকালও মিলগেটে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৭৫০ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকা। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, মিলগেটে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা বেশি দরে। এছাড়া মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা বিআর-২৮ জাতের চাল সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে ১৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে হঠাৎ করেই অস্থির হয় আলুর বাজার। এক সময় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু সর্বোচ্চ ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। দাম নিয়ন্ত্রণে প্রথম দফায় ৭ সেপ্টেম্বর হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম বেঁধে দেয় সরকার। তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। পরে হিমাগার মালিক ও ব্যসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে ২০ অক্টোবর দাম পুনর্নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদফতর। সে ক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ৩৫ টাকা, কোল্ডস্টোরেজ বা হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৭ টাকা এবং পাইকারিতে ৩০ টাকা কেজি বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু গতকালও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৩৫-৪০ টাকা।
সুজন সম্পাদক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যায়। তারা বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বারবার নির্ধারণ করলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। আসলে সঙ্কট থাকলে সরকারের নির্ধারণ করা মূল্যে পণ্য বিক্রি হবে না। কারণ চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকলে পণ্যের মূল্য বাড়বেই। এ অবস্থায় সরবরাহ না বাড়িয়ে সরকার প্রশাসনিক উপায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তা কার্যকর সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিপরীতে টিসিবি অথবা ডিলারশিপ বা অন্য কোনো উপায়ে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বাড়ালে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। পেঁয়াজ, আলু, কাঁচামরিচসহ বেশ কয়েকটি পণ্য আছে, যা পচনশীল। এগুলো বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। তাই এসব পণ্যের সরবরাহ বিকল্প উপায়ে বাড়লে ব্যবসায়ীরা তখন বাধ্য হয়ে পণ্য ছেড়ে দেবে। এর পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার রক্ষায় যে সব আইন আছে সেগুলোরও যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন