নেই চিকিৎসক, নেই কোন নিবন্ধন। অথবা নিবন্ধন থাকলেও নবায়ন করা হয়নি লাইসেন্স। চিকিৎসক না থাকলে নার্স ও ওয়ার্ড বয়দের ভুয়া চিকিৎসক সাজিয়ে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে হাসপাতালের কার্যক্রম। এমন দশা দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৮ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাড়ে ১৭ হাজার ২৪৪টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ হাজারের মত ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায়, শহরের অলি-গলিতে গড়ে তোলা হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, নিবন্ধন না থাকলে ও লাইসেন্স নবায়ন না করা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তোলা হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। বিশেষ করে রাজধানীর শ্যামলী, মোহাম্মপুর, আদাবর, ধানমন্ডি, মিরপুর, বাড্ডা, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি হাসপাতালে কম খরচে উন্নত চিকিৎসার আশ্বাসে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনে দালাল সিন্ডিকেট। তারা রোগী আনার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এছাড়া ওইসব হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে ভুয়া চিকিৎসদের মাধ্যমে চালানো হয় চিকিৎসা কার্যক্রম।
সর্বশেষ, গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড নামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসার নামে এএসপি আনিসুল করিমকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ওই ঘটনায় একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে মারতে মারতে আনিসুল করিমকে হাসপাতালের দোতলার একটি রুমে ঢোকায়। সেখানে তাকে মেঝেতে উপুড় করে ফেলা হয় এবং তিন-চারজন পিঠের উপর হাঁটু দিয়ে চেপে বসে। কয়েকজন তার হাত ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলে। কয়েকজন কনুই দিয়ে তার ঘাড়ের পেছনে ও মাথায় আঘাত করে। একজন মাথার উপরে চেপে বসে এবং সকলে মিলে পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে আনিসুল করিম নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পরে দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নেয়া হলে চিকিৎসকরা আনিসুলকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে গত ৭ নভেম্বর মোহাম্মদপুরে নামসর্বস্ব কয়েকটি হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় শ্যামলীতে অবস্থিত হাইপোথাইরয়েড সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সোহেল রানা ও মো. রাসেল নামের দুই টেকনিশিয়ানকে দুই বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। র্যাব জানায়, এই প্রতিষ্ঠান হার মানিয়েছে রিজেন্ট কিংবা জেকেজিকেও। ১০ বছর ধরে ল্যাব পরিচালনা করছে হাইপোথাইরয়েড সেন্টার। থাইরয়েডের নানা রিপোর্টসহ হেপাটাইটিস, ব্লাড কালচারসহ চলতো নানা পরীক্ষা। অথচ সেই ল্যাবের বেহাল দশা। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটি প্যাথলজির রিপোর্ট দিতো করোনায় মৃত অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের স্বাক্ষরে। অক্টোবরেও তার নাম ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে রিপোর্ট দেয়া হয়। অথচ এই চিকিৎসক করোনায় প্রাণ হারান মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা বলছেন, দুই একটা টেস্ট করা হলেও বাকিগুলো দেয়া হতো অনুমান করে। এছাড়া ওই দিন মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অবস্থিত সন্ধি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এসময় সেখানকার দুই দালালকে কারাদন্ড দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত ৪ নভেম্বর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত ক্রিসেন্ট ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। র্যাব জানায়, ক্রিসেন্ট ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে অনভিজ্ঞ স্টাফ দিয়ে অস্ত্রোপচারের ফলে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ওই হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় প্রতিষ্ঠানটিকে মোট ১৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটির ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও অননুমোদিত ওষুধ পাওয়া গেছে। এমনকি কোনো ফার্মাসিস্ট পাওয়া যায়নি। এ অপরাধে আরও সাত লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
গত ২৮ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের নুরজাহান অর্থপেডিক্স হাসপাতালে অভিযান চালানো হয়। এসময় ওই হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় জাহাঙ্গীর হোসেনকে দুই বছরের কারাদন্ড ও হাসপাতালটির পরিচালক বাবুর হোসেনকে এক বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুধু তাই নয়, হাসপাতালটি এতোটাই অপরিষ্কার যে ফ্লোরে রক্ত মাখা কাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হতো। তাই হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
র্যাব জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন রাজধানীতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন রোগীরা। কিন্তু একটি চক্র রোগীদের স্বল্প মূল্যে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু ওই সব হাসপাতালে নেই কোনো চিকিৎসক। ওয়ার্ড বয় ও ভুয়া চিকিৎসক দিয়ে দেয়া হয় চিকিৎসা। এসব হাসপাতালগুলোর মধ্যে মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় নুরজাহান অর্থপেডিক্স হাসপাতাল, ক্রিসেন্ট হাসপাতাল লিমিটেড ও মক্কা-মদিনা জেনারেল হাসপাতালের নাম রয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে নোয়াখালীর গুডহিল কমপ্লেক্স হাসপাতাল এবং প্রাইম হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুয়া চিকিৎসার অভিযোগ উঠে। এরপর সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেন ভুক্তভোগী রোগীর পরিবার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভুয়া চিকিৎসকরা প্রথমে কোনো না কোনো ওষুধের দোকানে কাজ করেন। অথবা কোনো প্রকৃত চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কয়েক মাস কাজ করেন। এর মাধ্যমে ওষুধ ও রোগীর ব্যবস্থাপত্র সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নেন তারা। পরবর্তীতে ওই ধারণায় ভর করে টাকার বিনিময়ে ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়েই হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং নিজস্ব চেম্বার খোলে বসেন। এরপর দালাল চক্রের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী সংগ্রহ করেন তারা। এসব ডাক্তার সাধারণত ২০-৩০টি ওষুধের নাম মুখস্থ করে রাখে।
এদিকে, করোনা মহামারির সময়ও সারা দেশে ভুয়া চিকিৎসক ধরা পড়ার তথ্য রয়েছে। গত জুলাই মাসের শুরুতে ভুয়া করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় সরকার নির্ধারিত হাসপাতাল হবার পরও রোগীদের কাছ থেকে বিল আদায় এবং লাইসেন্সবিহীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতাল বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনিয়ম বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েকটি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে কোনোটি সিলগালা, কোনোটির কার্যক্রম বন্ধ এবং কোনোটিকে জরিমানা করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে- রাজধানীর যমুনা জেনারেল হাসপাতাল, সেবিকা হাসপাতাল, মতিঝিল ইসলামী হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতাল। গত ১৩ জুলাই ডেমরার হাজীনগরে এসএইচএস হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিকে র্যাবের অভিযানে ভুয়া চিকিৎসকসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের জেল-জরিমানার পাশাপাশি হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়া হয়।
এর আগে গত ১৪ জুন মোহাম্মদপুরে মুক্তিযুদ্ধ টাওয়ারে যমুনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে লাভলু মিয়া নামে এক ভুয়া চিকিৎসককে আটক করে এক বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, জরিমানা করা হয় হাসপাতালের মালিক ও বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনা এক দালালকেও।
এছাড়া গত ২১ মার্চ করোনাভাইরাসের টিকা বিক্রির অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় একজনকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ মার্চ কিশোরগঞ্জের নান্দাইলের খামারগাঁও গ্রামে শাহীন নামে এক প্রতারক ও তার সহযোগীকে ছয় মাসের কারাদন্ড ও তার সহযোগীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই দিন খাগড়াছড়িতে করোনা চিকিৎসার নামে জার্মান হোমিও হলের চিকিৎসক পরিচয় দেয়া সমীরণ চৌধুরীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ২৮ মার্চ নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় মাইকিং করে প্রতিষেধক বিক্রির সময় দুই যুবককে আটক করে দুই বছর কারাদন্ড দেয়া হয়।
গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে যখনই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে অভিযোগ পাই তখনই আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী অ্যাকশানে যাচ্ছে। নিরাপত্তাবাহিনীর কাছে যখনই খবর আসছে তখনই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে এ ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের পেছনে দুর্নীতি, দুর্বল মনিটরিং এবং জনবলের ঘাটতিও একটি বড় কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এক সময় দেশে হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ছিল। কিন্তু বর্তমানে গলিতে গলিতে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করেই দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানে তদারকি করার নিয়ম থাকলেও জনবলের অভাবে তদারকি করা সম্ভব হয় না। তাই সীমিত জনবল দিয়েই যাতে কাজটি পূর্ণাঙ্গভাবে করা যা, সেটা সরকারকে ভাবতে। না হলে দ্রæত লোকবল বাড়াতে হবে। তবে নিয়মিত তদারকি না করলে হাসপাতালগুলো থেকে অনিয়ম দূর হবে না বলেও মনে করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন