সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে জাতীয় উন্নয়নে তমদ্দুন মজলিসের অবদান শীর্ষক একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলোচনায় অন্যাদের সঙ্গে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। বলা বাহুল্য, এই আলোচনায় যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে আমিই ছিলাম প্রবীণতম। ফলে আমার পক্ষে তমদ্দুন মজলিসের কর্মকান্ড সম্পর্কে যতটা জানা ও বলা সম্ভব ছিল, ততটা আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এ বিষয়টা টের পাই, ওই আলোচনায় আমার দেয়া বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে অন্যদের অবিশ্বাস্য আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে। কারণ তারা অধিকাংশই তমদ্দুন মজলিসকে ‘ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন’ ছাড়া অতিরিক্ত কিছু জানে না। তমদ্দুন মজলিস যে ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন হওয়া ছাড়াও এদেশের বিশেষ পরিবেশে ইসলামী আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, একথা নতুন প্রজন্মের অধিকাংশ লোকেরই জানা নেই। বিশেষ প্রেক্ষাপটে তমদ্দুন মজলিস একই সাথে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং প্রথম ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ঐতিহাসিক অবদান রেখেছে।
এ কথা বলার পেছনে একটি বিশেষ কারণ ও পটভূমি আছে। আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছেই এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে যে ধারণা বহুল প্রচলিত রয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন বা ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন নামে খ্যাত আছে, অপরটি হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলন; আর এ দুটি বিচ্ছিন্ন ও পৃথক আন্দোলন এবং কোনো একটির সাথে আরেকটির কোনো সম্পর্ক নেই। এই বহুল প্রচলিত ধারণায় যারা বিশ্বাসী তারা এমন কোনো সংগঠনের কথা কল্পনাও করতে পারেন না, যেটি একই সাথে দুটি আন্দোলনের সাথে সমভাবে জড়িত ছিল। অথচ সূক্ষ্মভাবে চিন্তা ও বিচার করলে প্রমাণিত হবে আজকের বিশ্বে বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র রয়েছে, তার অভ্যুদয় সম্ভবই হতো না, যদি এই দুটি আপাত বিচ্ছিন্ন আন্দোলন এদেশে সংঘঠিত না হতো। সে নিরিখে এ দাবি করা মোটেই অতিরঞ্জিত কিছু হবে না যে, তমদ্দুন মজলিসই আজকের মুসলিম-প্রধান বাংলাদেশ নামের দেশটির স্বপ্ন দেখেছিল। এই কথাগুলোই আমি বলতে চেষ্টা করেছিলাম উপরে উল্লেখিত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অন লাইন প্রোগ্রামে। আজকের এ লেখার বিষয়বস্তুও তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব, এমন ধারণা ও আশা ছিল।
কিন্তু সব আশাই ভেঙে গেল গত মঙ্গলবারের সংবাদপত্র দেখে। ফ্রান্সের সরকার বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ব্যঙ্গ কার্টুন প্রদর্শন করে যে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করে তা আমরা অবগত ছিলাম এবং এতে ক্ষুব্ধও ছিলাম।
শুধু আমরাই নই, সারা মুসলিম বিশ্বই যে এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ, তাও আমরা জানতাম। আমরা এও জানতাম যে, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে এ ব্যাপারে জনগণ পর্যায়ে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম, সমগ্র মুসলিম বিশে^র এই প্রতিবাদের মুখে ফরাসি সরকার দুঃখ প্রকাশ করবে বা অন্তত নীরব থাকবে।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা কী দেখলাম? বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা যা দেখলাম তা দৈনিক ইনকিলাব-এর গত (৩ নভেম্বর) সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল: ‘ফরাসি মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য করছে ফ্রান্স’। প্রতিবেদনে বলা হয়: বাকস্বাধীনতা নিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে নিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উপকণ্ঠে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ম্যানুয়েল প্যাটি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কার্টুন প্রদর্শন করলে গত ১৬ অক্টোবর এক কিশোর ম্যানুয়েলকে হত্যা করে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁখো ঐ হত্যাকান্ডের জন্য তার দেশের উগ্র মুসলিমদের দায়ী করেন। শুধু এ পর্যন্ত হলেও কথা ছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট একই সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, এরকম ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ অব্যাহত থাকবে। এনিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরপরই ফ্রান্সের দক্ষিণের এক শহরে ৩ পাদ্রীকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। এই হামলার মূল সন্দেহভাজন এক তিউনিসিয়ান। সে পুলিশ অফিসারদের দিকে আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার করেছিল বলে জানা যায়। ঘটনাগুলো আবারও দেশটির মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যকার বিপজ্জনক বৈরিতার চিত্র তুলে ধরেছে।
ফরাসি সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানে বিশেষত পাবলিক স্কুলগুলোতে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে নিন্দা ও নিন্দার অধিকার এবং ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা সংস্কারে কেন্দ্রীয় ভূমিকাসহ তাৎপর্যপূর্ণ বাকস্বাধীনতার অধিকার পুনরায় নিশ্চতকরণের মাধ্যমে প্যাটির হত্যার প্রতিক্রিয়া জানায়। ওই শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ম্যাঁখো বলেছিলেন যে, ফরাসি প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করার কারণে প্যাটিকে হত্যা করা হয়েছে। তবে ফরাসি সরকারের ইসলামবিরোধী ধারণাটি একটি ত্রুটিপূর্ণ এবং অনুমাননির্ভর।
মোটকথা, ফ্রান্সের সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করেও সেটাকে ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা বলে চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এর ফলে ফ্রান্সে বসবাসরত মুসলিমরা অন্যায় বৈষম্যের শিকারে পরিণত হচ্ছে। আমরা ফ্রান্সের সরকারকে আহবান জানাব, সে যেন প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষতার নীতি চালিয়ে যান এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিম বিরোধিতার নীতি ত্যাগ করেন। এটা না করার অর্থ হবে ফ্রান্সে বসবাসরত মুসলিমদের বিরোধিতা অব্যাহত রাখা, যা কোনো মতেই ফ্রান্সের দাবি মতে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সম্প্রদায়নিরপেক্ষতা নয়।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই, ফ্রান্স সুদূর অতীতে বেশ কিছু আফ্রিকান মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসন চালালেও আমরা সে অতীতকে ভুলে যেতে চাই। কিন্তু ফ্রান্সের শাসকরা যদি এখনও মুসলিমদের অতীতের মতো দাস বলে ভাবতে চান, তাহলে তাদের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ও সুন্দর না হওয়ারই আশংকা অধিক। বর্তমান যুগ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার যুগ। বর্তমান যুগেও যদি ফ্রান্সের শাসকরা অতীতের মতো মুসলিমদের দাস বলে ভাবতে চান, তাহলে ফ্রান্সের সাথে মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক কলংকিত ও ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমরা আশা করি, ফ্রান্সের শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী যুগের কথা ভুলে গিয়ে মুসলিমদের প্রতি ন্যায়বিচার ও সাম্যের নীতি অনুকরণ করতে এগিয়ে আসবেন। সেক্ষেত্রে মুসলিমদের সাথে ফ্রান্সের শাসকদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। নইলে শুধু মুখে এক আর বাস্তবে অন্য রূপ আচরণ করলে ফ্রান্সের সরকার ও মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হতেই থাকবে। আশা করি, ফ্রান্সের শাসকরা বাস্তবতার আলোকে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি অবলম্বন করে যথাশীঘ্র মুসলিমদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে উদ্যোগী হবে। মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের যুগ অনেক আগেই চলে গেছে। সেই অতীতের মতো এখনও যদি সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী নীতি অনুসরণ করে, তবে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন