কিংবদন্তি সাংবাদিক তোয়াব খান একদা বলেছিলেন, যশোহর খুলনার ইতিহাস হাতে পেয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সতীশচন্দ্র মিত্রকে লিখেছিলেন: ইতিহাস জাতির গৌরব ঘোষণার জন্য নহে, সত্য প্রকাশের জন্য।
তোয়াব খান আরো বলেছিলেন, দেশ ও জাতির পূর্বাপর ঘটনাবলীর বিবরণ দিতে গিয়ে এই শাশ্বত সত্যের পথ বেয়ে অনেকেই চলতে পারেননি। নিজেদের মনের ভিতর যে সব কথা ছায়া ফেলে, তাঁদের লেখনির মাধ্যমে সেগুলিই ঘটনার বিবরণের প্রকাশ হিসেবে বাইরের লোকজনের সামনে আসে। তাই বহু ইতিহাসই সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ হতে পারেনি। লিখিত হয়েছে অর্ধসত্য, যা পক্ষপাত দুষ্ট এবং মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর।
মুজিব শতবর্ষে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরী সাহেবের স্মরণ কথা ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে একদিন’ পড়ে মনে হলো, এই ঘটনাটি নিয়ে আগেও বেশ কয়েকজন যেসব কথা বলেছেন তা পক্ষপাতদুষ্ট এবং মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে একদিন’ ঘটনাটি ১৯৭৩ সালের মে মাসের মাঝামাঝিতে, মওলানা ভাসানীর অনশন শয্যার পাশে। এই দুই মহান নেতার উপস্থিতিতে যে শ্রদ্ধা, ভক্তি, স্নেহবাৎসল্যের এবং আন্তরিকতার অপরূপ দৃশ্য এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তুলে ধরেছেন তা দেখে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের সৃষ্টি ও তার ইতিহাসে এই দুই ব্যক্তির সারাজীবনের কর্মধারা একত্রে মিলে মিশে এক উজ্জ্বল-প্রজ্জ্বোল কালান্তরের সৃষ্টি করেছে। বি. চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের একটি নান্দনিক চিত্র আমাদের উপহার দিয়েছেন, যা জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য উদাহরণ হিসেবে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
অনশনরত মওলানা তার মজিবরকে বলছেন, বি. চৌধুরী সাহেবের লেখায়, তুমি যদি আজকে খিচুড়ি রান্না করে নিয়ে আসতা তোমার এবং আমার জন্য তা হলে এক সাথে দু’জনে বসে খাইতাম। সেইটা হইত তোমার কাজের মতো কাজ। বঙ্গবন্ধু আবার হাসলেন এবং বললেন, আমি তো সবার মুখে খাবার দিয়ে তারপর আপনার আর আমার কথা ভাবব, তাই না? বি. চৌধুরী সাহেব লিখেছেন, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেম। কারণ, সেখানে কোন তিরস্কারের ভাষা নেই, কোন অশ্রদ্ধার ভাষা নেই। যেন বহুদিনের পরিচিত গুরু- শিষ্যের মতো সম্পর্ক এবং একজন ঐতিহাসিক প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যাকে ছাড়া লেখা যায় না, সেই মানুষটি এত সুন্দরভাবে সহজভাবে কথা বলছেন, সরল শিশুর মতো। সে বিষয়টি আমি এখনো ভুলতে পারিনি। আমার স্মৃতি ও মনের কোঠায় এটা চিরকালের জন্য ছবি হয়ে আছে।
মরহুম আবদুল মান্নান, কে. এম. ওবায়দুর রহমান এবং হাল আমলে কাদের সিদ্দিকী, সৈয়দ আবুল মাকসুদ ও মতিউর রহমান চৌধুরী এই ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের খন্ড খন্ড দৃশ্য আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন; কিন্তু অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অংকিত চিত্রটি যেন সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। এই ঘটনা শুধু বি. চৌধুরী নয়, অন্য আরও একজন তার রাজনীতির জোয়ার ভাটার মধ্যে এই কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনায় তার ব্যক্তি জীবনের উন্নাসিকতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ৬০ বছর যাবৎ রাজনীতির জোয়ার ভাটার মাঝি মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতাকে পরিমাপ করতে পারেননি তিনি। তার লেখা ও বক্তব্য হালকা ও গুরুত্বহীন।
মওলানা ভাসানী জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন। কথা রেখেছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই মহান নেতার আহবানে ইতিহাস গড়ার দায়িত্ব পড়েছিল তার উপর। তিনিও তার জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অবমানাকর একটি বাক্যও উচ্চারণ কারেননি। মওলানা ভাসানী জিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা মজিবরকে কতটুকু চেন ?
অপর ঘটনাটিও সেই ৭৩ সালেরই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন জেনেভায় চিকিৎসারত। মওলানা তখন একটি ভূখা মিছিল নিয়ে গণভবনের (বর্তমানে সুগন্ধা) দিকে রওনা হয়েছেন। গণভবনে পৌঁছার পর রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ তাকে যথাযথভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করে। মওলানা যখন স্মারকলিপি দেন তখন নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন সাহেব তাকে সামগ্রিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে দু-তিনটি ফাইল তার সামনে ধরেন। মওলানা তখন বললেন, ফাইল দিয়ে আমি কী করব? এ সময় উপস্থিত রক্ষীবাহিনীর দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী মওলানা বললেন, দেশের যা অবস্থা তাতে কারোর তো কিছু বলা দরকার। দেশেই তো মিলিটারীও আছে। মওলানাকে এ সময় চা-স্যান্ডউহচ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। পরের দিন এই আপ্যায়নের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। সাংবাদিক এ.বি.এম মুসার ভাষ্য মতে, বঙ্গবন্ধু এই ছবি কেন পত্রিকায় দেওয়া হয়েছে তা বিদেশ থেকে বা দেশে ফিরে জানতে চান। তিনি বলেছিলেন, তোমরা ইতর রাজনীতি শিখলে কোথায়? মওলানাকে তোমরা কতটুকু জান? আমাদের জাতিগত আকাক্সক্ষার রূপায়ন ঘটিয়েছিলেন এই দুই ব্যক্তি এবং তারই ফলে উপমহাদেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে আমরা বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র পেয়েছি।
মুজিব ও ভাসানী যার সম্পর্কে উচ্চ্বসিত প্রশংসা করেছেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনি) সেই রাজনীতিবিদ কাফিলউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র বদরুদ্দোজা চৌধুরী এই দুই ব্যক্তির রাজনীতি ও পরস্পর সম্পর্কের অন্তর্নিহিত দিকটি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তার লেখার একস্থানে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আসল আদর্শই ছিল দেশপ্রেম।’ আজ ইতিহাসের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় সকলেই যেন বুঝতে পরেছেন, মুজিবের দেশপ্রেম যেন সবকিছুর এবং সবার উপরে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বি. চৌধুরী আরও লিখেছেন, মাটি ও মানচিত্রকে ভালবাসা তিনি তার চিন্তা এবং অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সেই জন্য তার অমর স্থান ‘প্রেমের আসনে’ চিরস্থায়ী হয়ে গেল। মুজিব ও ভাসানীকে নিয়ে তার এই লেখা তাদের অনুসারীদেরও ছাড়িয়ে গেল।
পরিশেষে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা একটি ঘটনা দিয়ে আজকের লেখা শেষ করতে হবে। গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ১৯৬৫ সালের জুন-জুলাই মাসের কথা। হঠাৎ একদিন তখনকার শেখ মুজিব ইত্তেফাক অফিসে এসে হাজির। মানিক ভাই ও বঙ্গবন্ধু- তাদের মাঝখান থেকে আমি উঠতে চাইলেও মানিক ভাই আমাকে বসিয়ে রাখলেন।
মানিক ভাই: মুজিব মিয়া! আপনার সম্পর্কে নানা কথা কানে আসছে। আপনি কি পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলতে চান?
বঙ্গবন্ধু: পাকিস্তান তো আমরা বাঙালিরা গড়েছিলাম। আমরা তা ভাংতে চাইব কেন? তবে পাকিস্তানে যদি সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা না হয়, তাহলে সে পাকিস্তানে আমাদের লাভ কী?
মানিক ভাই: আপনি আইয়ুবের বিরুদ্ধে একটি বড় আন্দোলনে নামতে চান। এই আন্দোলনে আপনি কাদের সমর্থন পাবেন? আতাউর রহমান, আবুল মনসুর আহমেদের মত আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা আপনার সঙ্গে নাই। মওলানা ভাসানী এতকাল পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন। এখন শুনি তিনি মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কবলে।
বঙ্গবন্ধু: আতাউর রহমান খানদের নিয়ে আমি ভাবি না। মওলানা সাহেব-বুড়ো বয়সেও তার রক্তে আগুন আছে। আমি এখন গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালে যাদু মিয়ারা তাকে ধরে রাখতে পারবে না।
ইতিহাস বলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই ঠিক উক্তি করেছিলেন। সময় মতো যাদু মিয়ারা তাকে ধরে রাখতে পারেনি। তিনি শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে জেল থেকে মুক্ত করেছিলেন। আইয়ুবেরও পতন ঘটিয়েছিলেন।
আজ বাংলাদেশ আছে, মুজিব নেই। রাজপথ আছে, ভাসানী নেই। দেশ ও জাতির তাগিদে সংকল্পে মরিয়া হয়ে ওঠার কোন লক্ষণ নেই। জাতির এই বেদনার্ত পরিবেশে বলতে হয়, তোমাদের মতো নেতারা কি আর এদেশে আসবে না?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন