ধর্ষন ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্তক অপরাধ। সে ধর্ষন থেকে ধর্ষককে যেমন বেঁচে থাকা জরুরি তেমনই ধর্ষন থেকে নিজেকে বাঁচাতে নারীকেও ভ’মিকা রাখতে হবে। এবং ধর্ষন চেষ্টাকালে নারী কারও নিকট সাহায্য প্রার্থী হলে সাহায্যও করতে হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিরোধকারীদের জন্য রয়েছে পুরষ্কার। হযরত সাঈদ ইবনে জায়েদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে সে শহীদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে সেও শহীদ। (আবু দাউদ, তিরমিযি)
ধর্ষন সৃষ্টি হয় অবৈধ কামভাব (যৌনচাহিদা ) তাড়িত বিষয় থেকে। এটি মুলত তারাই করতে পারে যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই। ধর্ষন, ব্যভিচার সহ সকল প্রকারের অপকর্ম থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো অন্তরে আল্লাহর ভয়কে ধারন করা। আর আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে তাঁর ক্ষমতা এবং অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হলে। আল্লাহ সকল সময় সর্বত্র পর্যবেক্ষনকারী এবং প্রত্যেক বিষয়ের বিচারক। এই বিশ্বাষ যদি কোন ব্যক্তি তার অন্তরে ধারন করতে পারে তাহলে নিশ্চিতভাবে কোন অন্যায়ে লিপ্ত হতে পারেনা। কেননা কোন ব্যক্তি প্রশাসনের সামনে অপরাধ করেনা। কারন তার প্রশাসনের ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান আছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। সন্দেহাতীতভাবে জেনে রাখো আল্লাহর আযাব বড়ই কঠিন। (সুরা বাকারা,আয়াত ১৯৬)
ইসলামে ধর্ষকের শাস্তি : ইসলামে যেমন ব্যভিচার বা যেনার শাস্তি রয়েছে তেমনি যেনার সমগোত্রীয় ধর্ষনেরও কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে ইসলাম। তবে ব্যভিচার সংঘটিত হয় উভয়ের সম্মতিতে তাই ব্যভিচারের ক্ষেত্রে উভয়েরই শাস্তি রয়েছে। আর ধর্ষন সংঘটিত হয় এক পক্ষের বল প্রয়োগের মাধ্যেমে তাই এ ক্ষেত্রে শাস্তি হবে ধর্ষকের ধর্ষিতার নয়। কেননা ধর্ষিতা এখানে জুলুমের শিকার তথা মাজলুম বা অত্যাচারিত আর ইসলামে মাজলুমের কোন শাস্তি নাই। ধর্ষনের ক্ষেত্রে দুইটি বিষয় সংঘটিত হয়। ১) যিনা বা ব্যভিচার। ২) বল প্রয়োগে সম্ভ্রম লুন্ঠন। ইসলামে ব্যভিচারের যে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে তা হলো দুই প্রকার। অবিবাহিত নারী পুরুষের জন্য একশত বেত্রাঘাত। এবং বিবাহিত নারী পুরুষের জন্য পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারি পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করনে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো । মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ্য করে। (সুরা নুর, আয়াত : ০২) হাদিসে রাসুল সাঃ বলেন, অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ‘ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর । আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশ‘ বেত্রাঘাত এবং রজম মেরে হত্যা। (মুসলিম)
এ হাদিসের আলোকে ইসলামী আইন বিশারদগন ভিন্ন ভিন্ন মতের দিকে গেছেন। কোন বিশারদ ব্যভিচারীর শাস্তি দুইটিকেই গ্রহন করেছেন। অর্থাৎ বেত্রাঘাত এবং দেশান্তর। তবে হানাফী মাযহাবের আইনবিদগন কোরআন বর্ণিত শাস্তির মতটিকেই গ্রহন করেছেন। ধর্ষনের মধ্যে যেহেতু দুইটি অপরাধ পাওয়া যায় সুতরাং প্রথমটির জন্য ব্যভিচারের শাস্তিই হবে। আর পরের অপরাধের জন্য কোন কোন আলেম মুহারাবার শাস্তির কথা উল্যেখ করেছেন। মুহারাবার শাস্তি হলো অস্ত্র ভয় দেখিয়ে ডাকাতির যে শাস্তি তাই। মুহারাবার শাস্তির ব্যাপারে কোরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করা হবে, অথবা শূলীতে চড়ানো হবে, অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে, অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্চনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩৩)
এ আয়াতের ভিত্তিতে বিচারক ধর্ষকের জন্য ব্যভিচারের শাস্তির সাথে উল্যেখিত চার ধরনের শাস্তির যে কোন টি দিতে পারে। তবে যখন সমাজে ধর্ষন মহামারী রুপ ধারন করে তখন সমাজকে কলুষ মুক্ত করতে মুহারাবার মত কঠোর শাস্তি দেওয়া জরুরি। আর ধর্ষনের কারনে অথবা ধর্ষন পরবর্তি হত্যাকান্ড সংঘটিত হলে তার একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যদন্ড প্রদান।
ধর্ষন প্রতিরোধে বিবাহের গুরত্ব : আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা “আইয়িম” বিপত্নীক বা বিধবা মহিলা তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাব গ্রস্থ হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাব দুর করে দিবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। ( সুরা আন নুর, আয়াত ৩২) পরের আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে। (সুরা আন নুর, আয়াত ৩৩)
বিবাহের ব্যপারে ইসলামি আইনবিদদের অভিমত হলো, যে ব্যক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে তার জন্য বিয়ে করা ওয়াজিব। দলিল হিসেবে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নের বাণীটি গ্রহন করেছেন, হে যুবকের দল তোমাদের মধ্যে যে বিবাহ করার ক্ষমতা রাখে সে যেন বিয়ে করে। বিয়ে হলো দৃষ্টিকে নিম্নমুখীকারী এবং লজ্জাস্থানকে রক্ষাকারী। আর যে বিয়ে করার ক্ষমতা রাখেনা সে যেন সিয়াম পালন করে। ইহা তার জন্য আত্মরক্ষাকারী। (মুসলিম, ২/১০১৯) তাফসীরে ইবনে কাসীর। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিবাহের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে বলেন, যদি কোন ব্যক্তি বিবাহ করে তাকে আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে সম্পদশালী করে দিবেন। আর বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, বিবাহ হলো দৃষ্টির ও লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী সুতরাং যখন কোন পুরুষ-নারীর বিবাহের প্রয়োজন সঠিক সময়ে বিবাহ হলে তার দ্বারা সমাজে যেনা ধর্ষন বা ইভটিজিংয়ের মত অপরাধ সংঘটিত হবেনা।
ধর্ষিতার প্রতি ইসলামীক দৃষ্টি : সমাজে ধর্ষনের শিকার হওয়া নারীকে বাঁকা চোখে দেখে। তার প্রতি অবহেলা ও নানান কটুক্তি করে থাকে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। কেননা ধর্ষিতা যেহেতু অত্যাচারিত তাই ইসলাম তাকে শাস্তি থেকে যেমন বিরত রেখেছে, তেমনই তার প্রতি খরাপ দৃষ্টিভঙ্গি দিতেও নিষেধ করেছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষনা করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতের ভুলবসত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজে এবং বলপ্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।(ইবনে মাজাহ) অর্থাৎ এখানে যে ব্যক্তি সত্যিকারের ধর্ষনের শিকার তার গুনাহ হয়না । তাহলে তাকে যারা কটুক্তি করবে তারাই অপরাধী হিসেবে গন্য হবে।
মোটকথা সমাজে যখন ধর্ষন মহামারী আকার ধারন করবে তখন সব ধরনের আইন প্রয়োগ সহ প্রতিরোধ গড়ে তোলে এ মাহামারী থেকে সমাজকে রক্ষা করা সকলের কর্তব্য। তাই আসুন আমরা এ ঘৃন্য অপরাধের বিরুদ্ধে নিজ নিজ স্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করেন। আমীন
লেখক : প্রধান মুফতি, কাশফুল উলুম নেছারীয়া মাদরাসা, সিংড়া, নাটোর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন