মহানবী। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যিনি আকৃতিতে ও সুন্দরে যেমন ছিলেন অতুলনীয় ঠিক তেমনি চরিত্রেও ছিলেন অনুপম ও অনুকরণীয়। যার সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায়, ‘লা য়ুমকিনু সানাউহু কামা কানা হাক্কুহু/বা’দ আয খোদা বুযুর্গ তুয়ি কিসসা মুখতাসার’।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবমাননা, ব্যাঙ্গা্মেক কথাবার্তা আর কষ্ট দেয়া নতুন কিছু নয়। মহানবীর জীবদ্দশায়ও কাফির মুশরিকরা বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছে। মহান রব তার প্রতিবাদ করেছেন। পাশাপাশি তাঁর প্রিয় হাবীবকে সান্ত¦না দিয়েছেন। তারা মহানবীকে গণক, পাগল বলে বলে বেড়াত। ‘আর তারা বলে, হে ঐ ব্যক্তি যার প্রতি যিকর নাযিল হয়েছে! তুমি তো নিশ্চয় উন্মাদ’ -(সুরা আল হিজরঃ ৬)। আল্লাহ তাঁর জবাবে এরশাদ করেন, ‘আপনার রবের অনুগ্রহে আপনি গণক নন, পাগলও নন’ -(সুরা আত ত্বুরঃ ২৯)। তারা প্রিয় নবীকে নির্বংশ বা লেজ কাটা বলে কষ্ট দিতে চাইলে মহান আল্লাহ তাদের জবাবে নবীকে কাওসার দান করার ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে উল্টা বংশহীন এবং আবতার বলে মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ‘নিশ্চয় আপনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীই তো নির্বংশ’ -(সুরা আল কাওসারঃ ৩)। আবু লাহাবও বাদ যায়নি নবীকে কষ্ট দেয়ার মতো বাক্য ছুড়ে দিতে। সে প্রিয় নবীজিকে ধ্বংস হতে বলেছিল। আল্লাহ তার জবাবে ‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দু’হাত এবং ধ্বংস হয়েছে সে নিজেও। তার ধন সম্পদ ও তার উপার্জন কোন কাজে আসে নি। অচিরে সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে, আর তার স্ত্রীও’ -(সুরা লাহাব), আবু লাহাবকে দুনিয়া আখিরাতে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আর বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রিয় হাবীবের সম্মান। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আর আমি আপনার (মর্যাদা বৃদ্ধির) জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি’ -(সুরা আল ইনশিরাহঃ ৪)।
সাহাবায়ে কেরাম যখনই দেখতেন কোন মুনাফিক বা মুশরিক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে কথা বা আচরণের মাধ্যমে কষ্ট দিতে অপচেষ্টা করত তখনই জান প্রাণ বাজি রেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য উৎসর্গ করতে সর্বদা সীসাঢালা প্রাচীরের মতো থাকতেন। হযরত আবু সাঈদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কিছু বন্টন করছিলেন। ঘটনাক্রমে আব্দুল্লাহ বিন যুল খুওয়ায়সিরা আত তামীমী এলো এবং বললো, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনসাফ করুন। তিনি এরশাদ করলেন, আফসোস তোমার জন্য! আমি যদি ইনসাফ না করি তা হলে আর কে ইনসাফ করবে? হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমাকে অনুমতি দিন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই’ -(সহীহুল বোখারীঃ ৬৯৩৩)।
পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকে যখনই যেভাবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমান বা ব্যাঙ্গাত্মক করবে বা করার চেষ্টা করবে তখনই তার প্রতিরোধ প্রতিবাদ করা মুমিনের জন্য আবশ্যক। ‘কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে নাযিল হয়েছে সেটার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম’ -(সুরা আল আ’রাফঃ১৫৭)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্মান করতে হবে, কেউ অপমান করতে চাইলে নিজের এবং দীনের স্বার্থে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কেননা, ‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর’ -(সুরা আল আহযাবঃ ৬)। আর এটাই হলো ঈমান। আর ঈমান পরিপূর্ণ হয় না মহানবীর প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা ছাড়া। আবদুল্লাহ ইব্নু হিশাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন উমর ইব্নু খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর হাত ধরেছিলেন। উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসুল! আমার জান ছাড়া আপনি আমার কাছে সব কিছু চেয়ে অধিক প্রিয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ না, যাঁর হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্তার কসম! তোমার কাছে আমি যেন তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হই। তখন উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন, আল্লাহ্র কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হে উমর! এখন (তুমি সত্যিকার ঈমানদার হলে) -(সহিহ বুখারী, ৬৬৩২)।
সেই প্রিয় নবীর অবমাননায় আমরা মুসলমান হিসেবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মান রক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তুলা আবশ্যক। যদি প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। এমন কোন স্থানে বা এমন কোন পর্যায়ে থাকলে যেখান থেকে প্রতিবাদ করতে না পারি তাহলে মন থেকে ঘৃণা পোষণ করতে হবে। মন থেকে ঘৃণা প্রকাশ ঈমানের সর্বশেষ স্থর বা দূর্বলতার পরিচায়ক। রাসুলের অবমমানা করা হয় কষ্ট দেয়ার জন্যই। কেননা, ‘আর যারা আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ -(সুরা আত তাওবাহঃ ৬১)। অন্য ধর্মে আঘাত দিয়ে কথা বলা বাকস্বাধীনতা নয় বরং উসকে দেয়ার অন্যতম পায়তারা।
আমরা দেখছি ধারাবাহিক ভাবে ফ্রান্স রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন বানিয়ে উপস্থাপন করছে। এর জন্য আমরা ক্ষোভ, নিন্দা, প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাই। করনীয় হলো, তাদেরকে বয়কট করতে হবে, পণ্য বর্জন করতে হবে, সকল ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। কারণ, মহানবীর দুশমনের প্রতি মুমিন মুসলমানের সম্পর্ক থাকতে পারে না। ফ্রান্স সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় মদদে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ব্যাঙ্গাত্মক করার প্রতিবাদে আমাদের মুসলমান দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের আবশ্যক এবং কর্তব্য হবে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবমাননায় ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদেরকে আহবান করে ফ্রান্স সরকারের এহেন কর্মকান্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো। পাশাপাশি তাদেরকে এসব নেক্কার ও অপমানজনক কাজ থেকে বিরত থাকার আহবান করা। যদি ফ্রান্স সরকার তা গুরুত্ব হিসেবে না দেখে মুসলমান হিসেবে ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কসহ সকল ধরণের চৃক্তি ও সম্পর্ক ছিন্ন করা। কারণ, ঈমানের লড়াইয়ে যে কোন এক পক্ষ গ্রহণ করা উচিত। আর না হলে মধ্যমপন্থা গ্রহণ করলে তা হবে বিশ্বাসগতভাবে মুনাফেকী। আমাদের ঈমানী দায়িত্ববোধ থেকে তা করতে হবে। নচেৎ আমাদেরই ঈমানী দূর্বলতা বা মুনাফেকী প্রকাশিত হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কিছুই হবে না। কারণ, মহান রব সাড়ে ১৪০০বছর আগে তাদের প্রতিবাদ করেই ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লানত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ -(সুরা আল আহযাবঃ ৫৭)।
সর্বশেষ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীর মাধ্যমে বলতে চাই, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই’ -(সহীহুল বোখারীঃ ১৫)। এই হাদীসের মাধ্যমেই আমাদের করণীয় পরিষ্কারভাবে প্রস্ফুটিত হবে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, পরিচালক, খিদমাতুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন