হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ্ তায়ালা সমস্ত উত্তম গুনাবলী দ্বারা সজ্জিত করেছেন এবং সমস্ত দোষত্রুটি থেকে পবিত্র করে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর পবিত্র সত্ত্বার জন্যই সমগ্র জগৎকে সম্মানিত করেছেন এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্য্য ও লাবণ্যের সুবাসে পুরো জগতকে সুবাসিত করে দিয়েছেন। তাঁরই মাঝে রয়েছে ব্যবহারিক জীবনের অনুপম আদর্শ ও উত্তম চরিত্র। (সূরা আহযাব, আয়াত:২১) তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শের অনন্য মডেল। একবার কিছু অমুসলিম আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে উপস্থিত হলো এবং তাঁকে আরয করলো: হে আবুল হাসান! আপনার চাচার সন্তান (অর্থাৎ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গুণাবলী বর্ণনা করুন! তখন তিনি বললেন: রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব বেশি লম্বা ছিলেন না এবং একেবারে খাঁটোও ছিলেন না, বরং মধ্যম আকৃতি থেকে একটু লম্বা ছিলেন, মোবারক শরীরের রঙ ছিলো লালচে মিশ্রিত সাদা, চুল মোবারক অনেক বেশি কৃষ্ণবর্ণ ছিলো না, বরং কিছুটা বক্র ছিলো, যা কান পর্যন্ত ছিলো, প্রশস্ত কপাল, সুরমা খচিত চোখ, মুক্তা মতো সাদা দাঁত, খাড়া নাক, ঘাড় খুবই স্বচ্ছ যেনো রূপার পাত্র, যখন হাঁটতেন তখন মজবুতভাবে কদম রাখতেন, যেনো উঁচু স্থান থেকে নামছেন, যখন কারো দিকে মনযোগ দিতেন তখন পরিপূর্ণভাবে মনযোগ দিতেন, যখন দাঁড়াতেন তখন লোকদের চেয়ে উচ্চ মনে হতো এবং যখন বসতেন, তখনও সবার মাঝে অনন্য হতেন, যখন কথা বলতেন, তখন লোকদের মাঝে নিরবতা বিরাজ করতো, যখন খুতবা দিতেন, তখন শ্রবণকারীদের মাঝে ক্রন্দন শুরু হয়ে যেতো, মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি দয়ালূ ও মেহেরবান, এতিমদের জন্য স্নেহময় পিতার ন্যায়, বিধবাদের জন্য দয়ালূ ও নম্র, সবচেয়ে বেশি বাহাদুর, সবচেয়ে বেশি দানশীল এবং আলোকিত চেহারার মালিক ছিলেন, জুব্বা পরিধান করতেন, যবের রুটি আহার করতেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বালিশ ছিলো চামড়ার, যাতে খেজুরের গাছের আঁশ ভরা ছিলো, খাট ছিলো বাবলা গাছের, যা খেজুরের পাতার রশি দিয়ে বুনানো ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’টি পাগড়ী ছিলো, একটিকে সাহাব আর অপরটিকে উকাব বলা হতো। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রয়োজনীয় বস্তুর মধ্যে তলোয়ার যুলফিকার, উটনী আদ্ববাআ, খচ্চর দুলদুল, গাধা ইয়াফুর, ঘোড়া বাহার, ছাগল বরকতা, লাঠি মামশুক এবং পতাকা “লিওয়াউল হামদ” নামে মনোনীত ছিলো। হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটকে স্বয়ং নিজেই বাঁধতেন এবং সেটিকে খাবার দিতেন, কাপড়ে তালি লাগাতেন আর জুতার মেরামতও নিজেই করতেন। পরিপূর্ণ মুবারক আকৃতি বর্ণনা করার পর হযরত মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে এবং হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁর মতো আর কাউকে দেখিনি।(শামায়েলে তিরমিযি)
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্ত্বায় সৌন্দর্য্য ও লাবণ্যময়তার আধার ছিলেন, যাঁর দীদারে শুষ্ক ফুলের কলি সতেজ হয়ে উঠে, অন্ধকার অন্তর ঝলমল করতে থাকে, বিষন্ন হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর এমন আশা ও আকাক্সক্ষা থাকতো যে, সর্বদা যেনো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী চেহারার যিয়ারত দ্বারা ধন্য হতে থাকে। তাই সাহাবায়ে কিরাম হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী চেহারার দীদার দ্বারা নিজের চোখকে শীতল এবং অন্তরকে প্রশান্তি দিতো আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার একটি ঝলক তাঁদের অন্তরের হাজারো সুখের আবেশ ছড়িয়ে দিতো। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকৃতির পাশাপাশি চরিত্রেও তাঁর মতো কেউ ছিলো না। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো পরিপূর্ণ উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, শিশু হোক বা বড়, পুরুষ হোক বা মহিলা, বৃদ্ধ হোক বা যুবক, মালিক হোক বা গোলাম সবার সাথেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ এতোই উন্নত হতো যে, লোকেরা প্রভাবিত হয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করতো, তাঁর সৎ চরিত্রের প্রতি প্রভাবিত হয়ে অপরিচিতরাও আপনজন মনে করতো। যারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে দূরে থাকতো তারাও হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাদিক ও আমীন (সত্যবাদী ও আমানতদার) বলতো। অমুসলিম যারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে লেনদেন করতো, তারাও হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়ে যেতো । আর মুসলমান লেনদেনকারীর ঈমান সতেজ হয়ে যেতো এবং তারা তাঁর নামে নিজের প্রাণও উৎসর্গ করে দিতে কুন্ঠিত হতেন না। আফসোস! যেই মাহবুব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্য্য ও লাবণ্যের আলোচনা শুনার জন্য আমরা মাহফিল সাজাই, নারায়ে রিসালতের শ্লোগানে মুখরিত করি, তবে কি সেই সত্ত্বার বাণীকে ছেড়ে আমরা অমুসলিমদের অনুসরন করবো? তবে কি সুন্নাতের পোষাক ছেড়ে নিত্য নতুন ফ্যাশনকে অনুসরন করবো? তবে কি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখের শীতলতা নামাযকে ছেড়ে দিবো? এখনো কি পিতা-মাতার অবাধ্যতা এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথে অসদাচরণ করবো?...... এটাই কি রাসূলের প্রতি ভালবাসার দাবি? প্রতিটি মুসলমানের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা ওয়াজিব। ইরশাদ হচ্ছে- আর আল্লাহ্ ও রাসূলের নির্দেশ পালন করো, যদি ঈমান রাখো’। (সূরা আনফাল, আয়াত :১) আর এটাই মুক্তির পথ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:যে আমার আদেশ মানলো, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যে আমার অবাধ্যতা করলো, সে অস্বীকারকারী হয়ে গেলো। (সহিহ বুখারী, হাদীস: ৭২৮০) সুধী! উপরোক্ত কুরআন- হাদীসাংশ থেকে বুঝা গেল, রাসূলের আনুগত্য জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম, মনে রাখবেন! আনুগত্যে ঐ সকল কাজ অন্তর্ভূক্ত, যা থেকে বিরত থাকার আদেশ রয়েছে (তবে তা থেকে বিরত থাকাই আনুগত্য) এবং ঐ সকল কাজ অন্তভর্‚ক্ত, যা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। যেমন; নামায আদায় করা, রোযা পালন করা এবং অন্যান্য নেক কাজ করা আবশ্যক, অনুরূপভাবে মিথ্যা, গীবত, চুগলী ইত্যাদি গুনাহ থেকে বিরত থাকাও আবশ্যক। তাই মহাকবি আল্লামা ড. মুহাম্মদ ইকবাল বলেন- দরদিলে মুসলিম মক্বামে মুস্তফা আস্ত- আবরু-এ মা যে নামে মুস্তফা আস্ত। কিন্তু আফসোস! আজকাল অনেকে মুসলমান শুধুমাত্র নামেই রয়ে গিয়েছে, না চরিত্রে ইসলামের কোন চিহ্ন দেখা যায়, না আচার আচরণে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচার আচরণের কোন ঝলক দেখা যায়! দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, গুনাহে একে অপরকে সাহায্য তো করে থাকে কিন্তু নেকীর কাজে অভিশপ্ত শয়তান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেয়, ঝগড়া-বিবাদ প্রসারিত হচ্ছে, সুন্নাতকে উপহাস করা হচ্ছে, না বাবা-ছেলের মাঝে সম্মানের তারতম্য রয়েছে, না মা-মেয়ের মাঝে সম্মান রয়েছে। যেদিকেই তাকাই চারিদিকে আমলহীনতা, বিপদগামীতা এবং সুন্নাতের বিরোধীতার হৃদয় জ্বালানো দৃশ্য। মনে রাখবেন! একদিন মৃত্যু আমাদের জীবনের সম্পর্ককে শেষ করে কবরে শুইয়ে দেবে। অতঃপর হাশরের দিনে আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে দাঁড়িয়ে হিসাব দিতে হবে। প্রশ্ন করা হবে: জীবনকে কি কাজে ব্যয় করেছো? যৌবনকে কি কাজে ব্যয় করেছো? বিশেষকরে আমার যুবক ইসলামী ভাইয়েরা! সেই সময় আমরা প্রতিপালকের দরবারে কি উত্তর দিবো, হে মালিক! আমি আমার যৌবনকে গলি, পাড়া-মহল্লায় অযথা বৈঠকে অতিবাহিত করেদিয়েছি বা সারা রাত স্যোশাল মিডিয়ায় অহেতুক কাজে লিপ্ত থেকে নষ্ট করে দিয়েছি। (নাউজুবিল্লাহ) একটু ভাবুন! যদি এই মন্দ কাজের কারণে কিয়ামতের দিন রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন চেহারা মোবারক ফিরিয়ে নেন, তবে কে আমাদের অসহায় অবস্থার সাথী হবে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কার শাফায়াতের ভিক্ষা প্রার্থনা করবো? পক্ষান্তরে যে যুবক নিজের যৌবনকে ইবাদত ও রিয়াযতে অতিবাহিত করে, নিজের যৌবনে কোরআনুল করিম তিলাওয়াত করে, নিজের যৌবন সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাঁধা প্রদানে অতিবাহিত করে, নিজের যৌবনে বৃদ্ধ মাতা-পিতার খেদমত করে, তবে এমন সৌভাগ্যবানকে আল্লাহ্ তায়ালার দরবার থেকে দয়া ও নেয়ামত প্রদান করা হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যে জীবন অতিবাহিত করার মাধ্যমে কিয়ামত দিবসে সমস্ত হাশরবাসীর সামনে অপমানিত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার তৌফিক দান করুন। আমিন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লিখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; রাঙ্গুনিয়া,চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন