তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক চায় তুরস্ক। এজন্য দু’পক্ষের মধ্যে গোয়েন্দা পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত আছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানিয়েছে।
জুমআর নামাজের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এরদোয়ান বলেন, ইসরাইলের শীর্ষস্থানীয় লোকদের সঙ্গে আমাদের সমস্যা। তাদের সঙ্গে কোনো ইস্যু না থাকলে আমাদের সঙ্গে তাদের (ইসরাইলের) সম্পর্ক অন্যরকম হতে পারত। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইলের নীতিমালা আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
এরদোয়ান বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের মূল সমস্যা আসলে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। ফিলিস্তিন নীতিমালা আমাদের রেড লাইন। আমাদের জন্য ইসরাইলের নির্মম ফিলিস্তিন নীতিমালা অগ্রহণযোগ্য।
ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক উন্নয়ন প্রসঙ্গে এরদোয়ান বলেন, আমরা আমাদের সম্পর্কগুলো আরেকটু ভালো অবস্থানে নিতে চাই।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ওয়াল্লা জানিয়েছে, উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
ইসরাইল এবং তুরস্কের ড্রোন এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে সম্প্রতি আর্মেনিয়ার দখল থেকে নার্গোনো-কারাবাখ উদ্ধার করে আজারবাইজান। ইসরাইলি ওয়েবসাইট ওয়ালা জানায়, গেল সপ্তাহের শুরুতে আলিয়েভ ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে এরদোয়ানকে আহ্বান জানান এবং বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও গেল সপ্তাহে ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আঙ্কারা এবং তেল আবিবের মধ্যকার বিভেদ সংক্রান্ত কিছু বিষয় উত্থাপনের জন্য আহ্বান জানান। বলেন, বাকু দুই মিত্রদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী।
এই দুই দেশের মধ্যে ২০১৮ সালে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার হলেও দুই দেশের মাঝে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। যদিও গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়েছে। ফিলিস্তিনের কাছ থেকে জোরপূর্বক দখল করে পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণ, গাজা অবরোধ ও ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা ইস্যুতে ইসরাইলি কার্যক্রমের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের মাভি মারমারা সংকটের পর দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। তখন তুরস্কের একটি জাহাজ বহর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সাহায্য পৌঁছাতে গেলে ইসরাইল সেখানে হামলা চালায়। এতে ১০ ত্রাণকর্মী নিহত হন।
এই হামলার পর তৎকালীন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান বলেন, এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরাইলকে শাস্তি পেতে হবে।
পরে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তুরস্কের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। একই সঙ্গে ওই ঘটনার জন্য তিনি ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেন। পরে তুরস্ক-ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।
২০১৩ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দেশ দুটির প্রধানমন্ত্রীরা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে রাজি হন।
২০১৬ সালে উভয় দেশ পুনর্মিলনের অংশ হিসেবে আবার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। বিভিন্ন সময়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তুরস্ক-ইসরাইল।
২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ফিলিস্তিনিরা। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বিক্ষোভরত ৬২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরাইলি বাহিনী। ওই হামলার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ইতান নাভেহকে বহিষ্কার করে তুরস্ক। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইসরাইলও তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি তুরস্কের অবিচ্ছেদ্য সহমর্মিতার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহু দশক ধরে ফিলিস্তিনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলে আসছে আঙ্কারা। তুর্কি কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলে আসছে, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবনা অনুযায়ী স্বচ্ছ এবং স্থায়ীভাবে ফিলিস্তিন ইস্যু সমাধান না হলে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব নয়।
১৯৬৭ সালে ছয়দিনের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম দখল করে ইসরাইল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশটির এ দখলদারিত্বকে কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তারপরও ১৯৮০ সালে পুরো শহরটিতে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে তেল আবিব।
দাবি করে, স্বঘোষিত ইহুদি রাষ্ট্রের চিরস্থায়ী এবং অবিচ্ছেদ্য রাজধানী পূর্ব জেরুজালেম। গেল বছর জাতিসংঘ ইসরাইলের এ দখলদারিত্বকে পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদি ভোগদখল আখ্যা দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের মূল কারণ জেরুজালেম। ১৯৬৭ সালে দখল হয়ে যাওয়া পূর্ব জেরুজালেমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন ফিলিস্তিনিরা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের লক্ষে তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যাকে ডিল অব সেঞ্চুরি বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি বলে অভিহত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনা অব্যাহতভাবে প্রত্যাখ্যান করে আসছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।
পরিকল্পনা ঘোষণা অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহু ছিলেন। সেখানে ফিলিস্তিনের কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, জেরুজালেম ইসরাইলের অবিচ্ছেদ্য রাজধানী থাকবে।
তুরস্ক এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। আঙ্কারা জানায়, মার্কিন ডিল অব সেঞ্চুরি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রত্যাখ্যান করেছে। দখলদারিত্বের নীতি অব্যাহত রেখে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি সম্ভব নয় বলেও জানায় দেশটি।
প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে ১৯৪৯ সালে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক। এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্য এবং উষ্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। সূত্র : রয়টার্স, সিএনএন, ভয়েস অব আমেরিকা, আল জাজিরা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন