২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিল বিশ্ব। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুতেই করোনা প্রকোপে নতুন করে সঙ্কট তৈরি করেছে। যার প্রভাবে মন্দায় পড়েছে সারা বিশ্ব। করোনার কারণে দেশে দেশে এই সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। ধনী-গরিব সব দেশেই এর প্রভাব পড়েছে। এই মহামারি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে ১৩ লাখ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে, বেশির ভাগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকোচন হবে। কর্মহীন হয়েছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মহামন্দায় বড় বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো বিপাকে পড়েছিল। দশক জুড়ে চলে মহামন্দা। এবারের মন্দা কত দিন থাকবে সেটি নিয়েই চিন্তিত সবাই। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি ২৮ লাখ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতি সঙ্কুচিত হবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এমন তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্ব অর্থনীতির এ পর্যবেক্ষণ সংস্থাটি আরো জানায়, এই সঙ্কট বিনিয়োগকে অনিশ্চিত করে তুলেছে, অর্থনীতির ভারসাম্যে সমস্যা তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২০ ও ২০২১, এই দুই বছরে সারা বিশ্বের ১১ কোটি থেকে ১৫ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্রের তালিকায় চলে আসবে। বিশ্ব জুড়ে পূর্ণকালীন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অন্তত ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে কোভিড নাইনটিন ভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে। এমন খবর প্রকাশ করেছে জাপানের নিক্কেই সংবাদপত্র। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চলতি মাসেই ৯০ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর মাথাপিছু ঋণ আকাশ ছুঁয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২১ সালে বিশ্বের মোট ঋণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির ১২৫ শতাংশে পৌঁছাবে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি সাড়ে ৫ শতাংশের ওপরে সঙ্কুচিত হবে, নতুন করে মন্দায় পড়বে অনেক দেশ। জাতিসংঘের মতে, করোনা মহামারির কারণে ২০৩০ সালে বিশ্বে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ১শ’ কোটি। বিশ^ বাণিজ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিশ^ব্যাপী পণ্য বাণিজ্য বেড়েছে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) তুলনায় এ বাণিজ্য কমে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে জুলাই- সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পণ্য বাণিজ্য বাড়লেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বাণিজ্যের পরিমাণ ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কম। উত্তর আমেরিকার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ দশমিক ১ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ইউরোপ ও এশিয়া। এ দুই অঞ্চলে বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয় যথাক্রমে ১৯ দশমিক ৩ ও ১০ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ১ শতাংশ ও অন্যান্য অঞ্চলে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। তৃতীয় প্রান্তিকে রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও বার্ষিক হারে তা কম। উত্তর আমেরিকার রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ, ইউরোপের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও অন্যান্য অঞ্চলে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও কেবল এশিয়া ব্যতিক্রম। গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের তুলনায় এ বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে তাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে পণ্য আমদানি তৃতীয় প্রান্তিকে বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ দুই অঞ্চলে পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক হারে কমলেও জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বেড়েছে যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৬ ও ১৫ শতাংশ। রপ্তানির মতো আমদানিতেও এগিয়ে এশিয়া। তৃতীয় প্রান্তিকে অঞ্চলটিতে আমদানি বেড়েছে ২ দশমিক ১ শতাংশ। এর মাধ্যমে এশিয়ায় বেড়েছে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় এ সময় আমদানি আরও দশমিক ৭ শতাংশ কমলেও অন্যান্য অঞ্চলে বেড়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। তবে বার্ষিক হারে আমদানি কমেছে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে। এসব অঞ্চলের আমদানি কমেছে যথাক্রমে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
এদিকে, আগামী কয়েক বছরেই আমেরিকাকে ছাপিয়ে বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতি হিসাবে স্থান করে নিতে চলেছে চীন। করোনা মহামারীর জেরে মার্কিন অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছে, তার জেরেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স এÐ বিজনেস রিসার্চ তাদের বার্ষিক রিপোর্টে চীনের এই উত্থানের পূর্বাভাস দেয়া হয়। রিপোর্টে বলা হয়, করোনা মহামারীর জেরে বিশ্ব অর্থনীতিতে পতন হলেও চীনের পক্ষে এটা লাভদায়ক হয়েছে। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে চীন সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছে। ২০৩০ সালের শুরু পর্যন্ত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির স্থান ধরে রাখবে জাপান। তবে ওই বছরের শেষের দিকে দেশটিকে পিছনে ফেলে সেই স্থান দখল করবে ভারত। গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স পর্যায়ক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে থাকবে। এই আবহেই এশিয়া মহাদেশ ও বিশ্বে মার্কিন একাধিপত্যকে ক্রমেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে চীন। চীনকে ঠেকাতে ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। চীন থেকে পণ্য আমদানি ভারত থেকে রপ্তানির প্রায় তিন গুণ। ইতিমধ্যেই চীনকে ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া তাদের নিজেদের দেশের আইনে পরিবর্তন এনেছে। তবে ভারতের অবস্থা সেই তুলনায় অনেক খারাপ। দেশটির সরকারি হিসাবে, ২০২০ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে প্রায় ২৪ শতাংশ জিডিপি নেমে যায়। করোনার সময়ে গোটা বিশ্বের কোনো দেশে এই পরিমাণ জিডিপির পতন হয়নি। লকডাউনের পর অর্থনীতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির পতনের ট্রেন্ড কমেনি। তৃতীয় কোয়ার্টারে ভারতীয় অর্থনীতির আরো সাত শতাংশ পতন হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন