বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ

মুসাফির নজরুল | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

বাংলা উপন্যাসে মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হয়েছে নানা অনুষঙ্গে। সদ্য স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের ক্রম অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা মধ্যবিত্ত মানসে সে স্বপ্ন ভঙ্গের বীজ রোপণ করে তা ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করেছে। এ পর্যায়ে রচিত উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক উপন্যাসে অপরিচিত ও যন্ত্রণাদগ্ধ চেতনার রূপায়ণ ঘটেছে। বাঙালি জীবনের সামগ্রিক অস্থিরতা অবক্ষয়, বিপন্ন, দীর্ণ ও রক্তাক্ত মুখচ্ছবি ফুটে উঠেছে অসংখ্য উপন্যাসে। বাঙালির জাতীয় চেতনার গুণগত বিকাশের ক্ষেত্রে এসব উপন্যাসের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আর্থ-সামাজিক কাঠামো এবং চেতনার এই বিবর্তনের পটভূমিতেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাসের সাফল্য নিহিত।
দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং অপরিমেয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় মানচিত্র জাতির এক মহত্তম প্রাপ্তি। একজন ঔপন্যাসিকের সে প্রাপ্তিই হয়ে উঠেছে সামূহিক অস্তিত্বের বিরল দৃষ্টান্ত, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, রক্তক্ষরণ এবং সাফল্যের চৈতন্যময় অভিব্যক্তি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে বাঙালি জীবনে আত্মসন্ধান, সত্তাসন্ধান প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস প্রচুর। কোনো কোনো উপন্যাসে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও জীবনবোধের অভাব পরিলক্ষিত হলেও অধিকাংশ উপন্যাসেই ঔপন্যাসিকের জীবন চেতনা ও সমাজবোধের গভীরতা তীব্র, তীক্ষ্ণ ও গৃঢ়ভাষী শিল্পকর্মে পরিণত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচনায় শওকত ওসমান (১৯১৭-৯৮) এর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের সংখ্যা চারটি। ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ (১৯৭১), ‘নেকড়ে অরণ্য’ (১৯৭৩) ‘দুই সৈনিক’ (১৯৭২), ‘জলাঙ্গী’ (১৯৭৩)।
শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ (১৯৭১) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার প্রথম দিকে স্বদেশ ভূমি থেকে পলায়নপর মানসিকতার রূপায়ণ ঘটেছে। শিক্ষক গাজী রহমানের অভিজ্ঞতাসূত্রে পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশে খন্ খÐ জীবনরূপ অঙ্কনেই ঔপন্যাসিক মনোযোগী হয়েছেন। ‘নেকড়ে অরণ্যতে’ পাকবাহিনীর বিরিংসা ও লালসায় বিপন্ন বাঙালি নারীর বিনষ্ট জীবনরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন শওকত ওসমান। নারী নির্যাতনের এহেন দৃশ্য একই সাথে মর্মন্তুদ ও বেদনা সঞ্চারী। বাঙালিকে বুট আর বুলেটের আঘাতে বিদ্ধ করেই তাদের আকাক্সক্ষার নিবৃতি ঘটেনি, স্বাধীনতাস্পৃহী এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে অভিনব কায়দায় শাস্তির ব্যবস্থা করে এক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। একটি সিভিল সাপ্লাইয়ের গোডাউনের মধ্যে প্রায় শতাধিক নারীকে ধরে এনে তাদের নেকড়েরা পাশবিক নির্যাতন চালায়। ঘৃণার রঙে আঁকা ‘নেকড়ে অরণ্য’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। শওকত ওসমানের ‘দুই সৈনিক’ উপন্যাসটির বিষয়বস্তুতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রতিচ্ছবি। এ উপন্যাসের পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি আনুগত্য সত্তে¡ও মখদুম মৃধা তার দুই কন্যা সাহেলী ও চামেলীকে রক্ষা করতে পারে না। দুই সৈনিকের প্রধান দু’মদমত্ত অফিসার। তাদের পাশবিক ক্রিয়াকলাপই এ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হিসেবে তরঙ্গায়িত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এক ট্র্যাজিক উপন্যাস শওকত ওসমানের ‘জলাঙ্গী’। এ উপন্যাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধের রক্তিম আবেগ রূপায়ণের প্রশ্নে আন্তরিক ও অনেকাংশে সাফল্যস্পর্শী। বাঁকাজোল গ্রামের প্রতীকে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবন বাস্তবতার একটি সামগ্রিক চিত্র অঙ্কন করেছেন। পঁচিশে মার্চের অব্যবহিত ঘটনাক্রম, জাতীয় জীবনের কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা, পাকিস্তানি অপশক্তির অমানুষিক বর্বরতা, গ্রামাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি প্রভৃতি প্রসঙ্গের বস্তুনিষ্ঠ বিন্যাস এ উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। এ উপন্যাসের পরিণামী দৃশ্য ও ধ্বনি তরঙ্গে ঔপন্যাসিকের জীবনার্থের সার্থকতা প্রতিবিম্বিত।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘দেয়াল’ ঔপন্যাসিকের শ্রেষ্ঠতম শিল্পসৃষ্টি। ব্যক্তি অস্তিত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া রূপায়ণের অনুষঙ্গে সমগ্র জনগোষ্ঠির সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসক্রম এবং তার রূপ ও রূপান্তর বিন্যস্ত হয়েছে উপন্যাসে। রশীদ করীমের ‘আমার যত গøানি’ (১৯৭৩) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে মধ্যবিত্ত মানসের দ্বিধান্বিত ও অন্তর্দ্ব›দ্বময় আত্মস্বরূপের উন্মোচন ঘটেছে। এ উপন্যাসে ঘটনাংশ বিস্তৃত হয়েছে ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত। জাতীয় জীবনের তরঙ্গক্ষুদ্ধ ও গতিশীল ঘটনা প্রবাহের মধ্যে এরফান মিঞার রতিচেতনা এ আত্মভুক্ত অনুভবগুচ্ছ এ উপন্যাসে মুখ্য হয়ে উঠেছে।
বাংলা উপন্যাসের ধারায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আনোয়ার পাশার (১৯২৮-৭১) ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ (১৯৭৩)। এদেশের ইতিহাসের এক দুঃসহ ও নৃশংসতম অধ্যায়ের বিশ^স্ত দলিল এই উপন্যাস। উপন্যাসের নায়ক অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন প্রকৃতপক্ষে আনোয়ার পাশারই আত্মপ্রতিভাসের প্রতিরূপ। পঁচিশে মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস নখাঘাতে ক্ষতবিক্ষত সময়ের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন ঘটেছে এ উপন্যাসে। বিশেষ করে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিমÐলে যে অমানুষিক বর্বরতার ধ্বংসযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, আনোয়ার পাশা বাস্তববাদী শিল্পীর নিরাসক্তিতে তা রূপায়িত করেছেন। সুদীপ্ত শাহীনের অভিজ্ঞতার সেই বীভৎস নগ্নরূপ পাঠককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে সত্য, কিন্তু প্রত্যক্ষ অবলোকনের অবিকল উন্মোচন জীবনের এক বস্তুসত্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। এ উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ সীমিত, কিন্তু এর আবেদন আর দিগন্ত এ সময়-সীমার আগে ও পরে বহু দূর বিস্তৃত। বাঙালির দুঃখ-বেদনা আর আশা-এষণার এ এমন এক শিল্পরূপ যা সব সময় সীমাকে ডিঙিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী অপরূপ সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে।
শামসুর রাহমানের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ (১৯৮৫) মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবী মানুষের অন্তর্ময় জীবনানুভবের শিল্পরূপ। অন্তর্দ্ব›দ্ব, আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্মহননের যে জটিল প্রক্রিয়া কবি-সাংবাদিক নাদিম ইউসূফের চরিত্র ভাবনার রূপ লাভ করেছে। আত্মকেন্দ্রিক, সংবেদশীল অথচ দায়িত্ব সচেতন নাগরিক। মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের সাতে তা সঙ্গতিপূর্ণ। সমষ্টি জীবন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির বিমিশ্র সত্তার এক শিল্প নিপূণ বিন্যাস ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ উপন্যাসকে করেছে নবমাত্রিক ও স্বতন্ত্র। জৈবনিক ব্যর্থতার দর্পণে মুক্তিযুদ্ধের অনিঃশেষ তাৎপর্যের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন শামসুর রাহমান।
সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধের অনুষঙ্গবাহী সার্থক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য। চেতনার মৌল স্বভাবে অন্তর্মুখী ও মনোবিশ্লেষণ প্রবণ হওয়া সত্তে¡¡ও তাঁর উপন্যাসেই মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র অববয়ব বিধৃত হয়েছে। ‘নীল দংশন’ (১৯৮১) ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৮১), ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ (১৯৮৪), ‘অন্তর্গত’ (১৯৮৪), ‘এক যুবকের ছায়াপথ’ (১৯৮৭) প্রভৃতি ও উপন্যাসে সৈয়দ শামসুল হক বিভিন্ন কৌণিক দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময় পরস্পরাকে অবলোকন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অনিঃশেষ চেতনার অঙ্গীকারে তিনি নির্দিষ্ট কালখÐ থেকে মুক্তি দিয়ে এক আবহমান তাৎপর্যে অভিষিক্ত করেছেন মুক্তিযুদ্ধকে।
মিরজা আবদুল হাইয়ের ‘ফিরে চলো’ (১৯৮১) উপন্যাসে জীবনাভিজ্ঞতার অনুভবে এক নতুন প্রান্ত উন্মোচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সূচিত হবার পর যে সকল বাঙালি পরিবার পাকিস্তানে আটকা পড়ে যায়, তাদের উদ্বেগ, অসহায়ত্ববোধ এবং অপরাজেয় দেশপ্রেম এ উপন্যাসের উপজীব্য। এ উপন্যাসের একটি বিরুদ্ধে অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য হিন্দুকুশ পর্বত হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে স্বদেশগামী বাঙালিদের অন্ত-বাহিরকে যথেষ্ট নৈপূণ্যে উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিক। কেবল উপকরণের অভিনবত্বে নয়-ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা ও রূপায়ণ দক্ষতা ‘ফিরে চলো’ উপন্যাসকে অনন্যতা দান করেছে।
শহীদ আখন্দ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলা উপন্যাসের ধারায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তাঁর উপন্যাসে যুদ্ধকালীন ও তৎপরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিধৃত হয়েছে। তাঁর ‘একাত্তরের কালবেলা’ লেখকের বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া ও দেখা ঘটনার আলোকচিত্র। লেখক ফেনী মহকুমার হাকিম থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের যে নির্মম চিত্র স্বচক্ষে দেখেছেন তারই আলোকে সত্য ও জীবন্ত ঘটনা তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। ‘আবার আসিব’ উপন্যাসের মুল উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ অন্বেষণ, অপরদিকে উপন্যাসের নায়কের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের পরও তার আদর্শকে টিকিয় রাখার সংগ্রাম এ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক।
শওকত আলীর ‘যাত্রা’ (১৯৭৬) উপন্যাসের কুশিলব নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ রক্ষার তাগিদে চিরচেনা শহর ছেড়ে তাদের যে যাত্রা, তাতে মাটি ও মানুষের হৃদয় স্পনন্দ প্রাণে প্রাণে অনুভূত। তাঁর এ উপন্যাসে পঁচিশে মার্চ পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনার জীবনালেখ্য প্রতিফলিত হয়েছে। অস্তিত্ব প্রশ্নে শহর থেকে গ্রামের দিকে ধাবমান জন¯্রােতের অন্তর বাহির অনেকটা নিষ্ঠার সঙ্গে রূপদান করেছেন ঔপন্যাসিক।
আবু বকর সিদ্দিকের ‘একাত্তরের হৃদয় ভষ্ম’ (১৯৭১) যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর জীবনের নির্মম-নির্মোহ বাস্তবনিষ্ঠ উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের অন্তে দেশকে এমন অকপট আন্তরিকতায় ইতোপূর্বে কেউ উপস্থাপন করেছেন বলে মনে হয় না। এ উপন্যাস যুদ্ধোত্তর বাঙালি জীবনের ট্রাজিক জীবন সত্যের শিল্পরূপ প্রতিফলিত হয়েছে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) উপন্যাসের বাঙালি জীবনের বিচিত্রপট মানব অস্তিত্বের সঙ্কট ও শ্রেণি বিভাজন ও শ্রেণি সংগ্রামের রক্তিম অন্তঃ¯্রােত এ উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে অসাধারণত্ব দান করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে খÐকালের ঘটনা নয়, একটি জাতির আবহমান অস্তিত্ব সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, লেখক তা নিপূণ দক্ষতায় রূপদান করেছেন এ উপন্যাসে।
রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষরে’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলা উপন্যাসের ধারায় এক নতুন সংযোজন। যুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট সুনিপূণভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এ উপন্যাসে। দিলারা হাশেমের ‘একদা’ ও ‘অনন্ত’ যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কিত এক বাস্তব দলিল। ঔপন্যাসিক এ উপন্যাসের কুশীলবদেরকে বাস্তব সমাজের মানুষরূপে চিত্রিত করেছেন।
আল মাহমুদের ‘উপমহাদেশ’ (১৯৯৪) উপন্যাসে যুদ্ধের বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একজন কবির আবেগঘন ব্যক্তিকথা। তবে যুদ্ধকালীন নয় মাসের ঘটনাক্রম ধরা পড়েছে এ উপন্যাসে।
রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’ (১৯৭৫) স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ঢাকা শহরের অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্থ মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে। এ উপন্যাসের নায়ক জাফরের মানসক্রিয়ার মধ্যে মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র জাফরের অনুভূতি মুক্তিযুদ্ধকালীন নাগরিক মধ্যবিত্তের মানস সক্রিয়তার পরিচয়বাহী। ঔপন্যাসিক উপন্যাসের শেষে খাঁচায় আবদ্ধ একটি টিয়া পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্কেত প্রদান করেছেন।
‘অন্ধ কথামালা’ (১৯৮২) মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও আবেগের রূপায়ণে পরিণততর সৃষ্টি সময়ের দিক থেকে এ উপন্যাস কয়েক ঘণ্টার কাহিনী হলেও রাশীদ হায়দার একটা জনপদ, তার অন্তর্গত ব্যক্তি ও সমষ্টি, ব্যক্তির প্রত্যাশা, অপ্রাপ্তি-সঙ্কট ও যন্ত্রণার যে স্বরূপ উন্মোচন করেছেন তা বাঙালি জীবনের সমগ্রতার স্পর্শ শিহরণে তরঙ্গিত ও স্পন্দিত হয়ে উঠেছে।
রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী মুখ’ (১৯৭৪) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলা উপন্যাসের ধারায় স্বাতন্ত্রের দাবি রাখে। এ উপন্যাসে যুদ্ধকালীন সময়ের নানা ঘটনা পরস্পরা উপস্থাপিত হয়েছে। তাঁর ‘মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী’ এ ধারার অন্যতম উপন্যাস।
আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’ (১৯৭৫) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচিত উপন্যাসের ধারায় উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। এ উপন্যাসে বিধৃত গণমানুষের মানসিকতা ও মুক্তিচেতনার উপস্থাপন অত্যন্ত বিশ^স্ত ও সাবলীল। বাস্তবতার সঙ্গে প্রতীকী উপাদানের মিশ্রজাত কলারূপ স্বমহিমায় ভাস্বর। উপন্যাসে ভীত-সস্ত্রস্ত মানুষের নিস্ক্রীয় আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাই প্রাধান্য লাভ করেছে।
মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ (১৯৭৬) সমাজসত্তার বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির জীবনযন্ত্রণার রূপায়ণ ফুটে উঠেছে। নাগরিক মধ্যবিত্তের পলায়নমুখী ও আত্মসখ সন্ধানী মানসিকতাই খোকা চরিত্রের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। মার্চের উন্মাতাল, রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন সময় প্রবাহে প্রতিবাদ ও দ্রোহের সাথে সময়ের পরিবর্তন পরস্পরা খোকার সমষ্টি বিচ্ছিন্ন চেতনাকেও আলোড়িত করেছে। যুদ্ধে যোগদানের প্রশ্নে মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা এবং সময়ের ভয়াবহতার কাছে অনচ্ছিুক আত্মচেতনাই শেষ পর্যন্ত মুখ্য হয়ে ওঠে এ উপন্যাসের চরিত্র পাত্রদের জীবনে।
আহম্মদ ছয়ার ‘ওস্কার’ (১৯৮৫) স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌল আবেগের সঙ্গে সম্পর্র্কিত এক বোবা মেয়ের পরিবর্তন পরস্পরার মধ্যদিয়ে জাতিসত্তার জাগরণের অন্তর্সত্য বিধৃত হয়েছে এ উপন্যাসে। সেলিনা হোসেনে ‘হাঙর নদীর গ্রেনেড’ (১৯৭৬) মুক্তিযুদ্ধ আক্রান্ত গ্রামীণ জীবনের আবেগী চিত্ররূপ। এ উপন্যাসে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের একটি উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গের চকিত দীপ্ত এক প্রচÐ ক্ষিপ্রতা নিয়ে উদ্ভাসিত। গ্রামীণ জীবন- কাঠামো, যুদ্ধের অভিঘাতে তার রূপান্তর, চরিত্রসমূহের বাস্তবানুগ ক্রিয়াশীলতা এবং সর্বোপরি বুড়ির আত্ম-উজ্জীবন এ উপন্যাসের জীবন দর্শনকে করেছে সমগ্রতাস্পর্শী। উপন্যাসের পরিণামী চিত্র, ঘটনা এবং তার প্রক্রিয়ার রূপায়ণে লেখকের শিল্পদৃষ্টি তী² সঙ্কেতময় ও দৃঢ় সঞ্চারী। হারুন হাবীবের ‘প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম’ (১৯৮২) উপন্যাস উপকরণ নির্বাচন ও বিষয় ভাবনায় এক বিশ^জনীন শিল্প-অভিপ্রায়ে গৌরবান্বিত। বাংলাদেশ এবং যুগো¯øাভিয়ার মুক্তি সংগ্রাম অভিন্নবোধের কেন্দ্রে মিলিত হয়েছে এ উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বিজয়ের উল্লাস আর ত্যাগের মহিমা যেমন ছড়িয়ে আছে এ উপন্যাসে, তেমনি আছে হাসান-ইয়াসমিনের রোমান্টিক প্রেমের প্রতীক শাশ^ত বিশ^জনীনতা।
ইউসুফ শরীফ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলা উপন্যাসের ধারায় অন্যতম শক্তিমান ঔপন্যাসিক। তাঁর অধিকাংশ রচনায় মুক্তিযুদ্ধকে যেমন ধারণ করেছেন, তেমনি যুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিত্রিত করেছে। তাঁর উপন্যাসে ইতিহাসের ধারবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে সার্থকতা নিভুর্ণভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। তাঁর ‘স্বপ্নের চারুলতা’ (১৯৮২) ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’ (১৯৮৩) ও ‘পরম মাটি’ (১৯৮৯) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চিরন্তন আলেখ্য। স্বপ্নের চারুলতা উপন্যাসে তিনি এক হিন্দু ষোড়শী চারুলতার দুঃসহ জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে পাক-বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে চারুলতা ব্রহ্মপুত্রে আত্মহত্যা করে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে। এ উপন্যাসের মতিউল ও কামাল অসম সাহসিকতার সঙ্গে পাক-বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু স্বাধীন দেশে মতিউলকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। ময়মনসিংহ শহর থেকে একটু দূরে একটি হিন্দু পাড়ার যুদ্ধকালীন সামগ্রিক জীবন চিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে এ উপন্যাসে। ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালে ফরহাদ নামের এক রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার নির্মমভাবে হত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালিদের পক্ষে কথা বলাই ছিলো তার অপরাধ, তাই তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয়, সে কথা তার স্ত্রী-সন্তানের অজ্ঞাতেই রয়ে যায়। স্ত্রী ফৌজিয়া অবাঙালি হওয়া সত্তে¡ও তার পরিবারের কাছে ফিরে যায় না। সন্তানদের নিয়ে আঁকড়ে ধরে তাকে এদেশের মাটিতে। ‘পরম মাটি’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে রোস্তমের জীবনের সামগ্রিক আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। রোস্তম ব্রহ্মপুত্র চরে কৃষি কাজ শুরু করে, কিন্তু বন্যায় তার সবকিছ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে জীবন যুদ্ধ সাথের তার চেতনায় জাগ্রত হয় অস্থিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। ল্যাংড়া মুক্তি নামের এক অসাধারণ মুক্তিযোদ্ধা এ উপন্যাসে এক উজ্জ্বল চরিত্র।
হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ (১৯৭৩), ‘সৌরভ’ (১৯৮৪) এবং ‘১৯৭১’ উপন্যাসে যুদ্ধকালীন সময়ের খন্ড খন্ড ঘটনার বিন্যাস ঘটেছে। ‘শ্যামল ছায়া’য় চারজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথন এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতালোককে উন্মোচন করে। ‘১৯৭১’ এর কাহিনি অনেকটা সরলরেখায় উপস্থাপিত।
পরিশেষ এক কথা বলা যায় যে, স্বাধীনতার পর স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতিসত্তা হিসেবে এদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির জটিল ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে পেরিয়ে গেছে বেশ সময়। ঔপন্যাসিকদের বস্তুঘনিষ্ঠ সংবেদনশীল মন রক্তিম অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে স্বপ্নের মূল কেন্দ্রকেই আকর্ষণ করতে চেয়েছে। তাদের উপন্যাস থেকে আমরা বাংলাদেশের সমাজ মানস ও ব্যক্তিমানসের বৈচিত্র্য ও গভীরতাকে স্পর্শ করতে পারি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলেজ শিক্ষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন